সবার সহযোগী বাবুল আক্তারকে সহযোগীতা করা কঠিন!
দেশজুড়ে আলোচিত নাম বাবুল আক্তার। যারা নিকট থেকে তার সহযোগীতা পেয়ে হয়েছেন ধন্য, আজ তাদের পরিধিও ছাড়িয়ে গেছেন বাবুল আক্তার। সবাই বিস্ময় নিয়ে আজ জানছে, পুলিশে একজন বাবুল আক্তারও আছেন! বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে নিয়োজিত থেকে একজন বাবুল আক্তার সীমাহীন অসাধ্য সাধন করে যে রুপকথাময় গৌরব গাঁথা সৃষ্টি করেছেন তার তুলনা নেই।
বাবুল আক্তার-
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অর্থাভাবে চুরি করতো এক যুবক। ধরা পড়ার পর সে বাবুল আক্তারকে খুলে বলে তার অপরাধ জীবনের আদ্যোপান্ত। বাবুল আক্তার জেল থেকে মুক্ত হয়ে তার সাথে দেখা করতে বললেন। একদিন সে ঠিকই হাজির হলো। বাবুল আক্তার তাকে কিছু টাকা দিয়ে একটা আখ মাড়াইয়ের মেশিন কিনে দেন। যুবক থ। বুঝতে পারছে না, এটা আদৌ সম্ভব কিনা। প্রথম দিন সে দেড় হাজার টাকার মতো আখ বিক্রি করেছে। তা থেকে একটাকাও খরচ না করে নিয়ে এলো এই বাবুল আক্তারের কাছে। বললো, “স্যার আমার উপার্জনের প্রথম টাকা আপনার নিতেই হবে। বাবুল আক্তার ফিরিয়ে দিলেন তাকে। ক’দিন পর আবার এলা সে। বলো “স্যার দাঁড়ানো অবস্থায় পা দেখা যায় এমন কোন ছবি পাইনি আপনার। আমি ক্যামেরাম্যান আনছি। একটা ছবি তুলতে দিয়েন। অতঃপর ছবি তোলা হলো। তার পরের কাহিনী- যুবকটি বাবুল আক্তারের ছবিটা বাঁধিয়ে তার ঘরের দরোজার সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন ব্যবসা শুরুর আগে ঐ ছবিতে বাবুল ভাইয়ের পায়ে সালাম করে ব্যবসা শুরু করে।
চট্টগ্রামের আরেকটি ঘটনা। জামালখান মোড়ে একদল ছিনতাইকারী ছিনতাই করে পাশের বড় ড্রেনে নেমে পালিয়ে যায়। সংবাদ পেয়ে দ্রুত ছুটে আসে পুলিশের টিম। কিন্তু মোবাইল টিম আসার আগেই সেখানে পৌঁছে যান বাবুল আক্তার। নিজেই নেমে পড়েন ময়লা আবর্জনাপূর্ণ ড্রেনে। ধাওয়া করেন তাদের বহুদূর। ঘটনাটা তখন নগরীতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সচরাচর দেখা যায়, নালা নর্দমায় একটা পাঁচশ টাকার নোটও যদি পড়ে যায়, আমরা সেটা নিজেরা তুলি না; চারপাশে দেখতে থাকি, ভবঘুরে কোন ছেলেকে পাওয়া যায় কিনা। প্রয়োজনে কিছু নোট দিয়ে ঐ পাঁচশ টাকার নোটটা তুলে নিই। ভাবি, যে মানুষটা নির্দেশ দিলে তিন থানার ওসি (কোতোয়ালী জোনের অন্তর্ভুক্ত তিনটি থানা কোতোয়ালী, খুলশী ও বাকলিয়া) ঐ নালায় নামতে বাধ্য, সেখানে তার মতো একজন সিনিয়র অফিসার নালায় নেমে পড়েছেন কর্তব্যের খাতিরে!
একবার পর্দার কাপড় কিনতে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে টেরিবাজার গেছেন বাবুল আক্তার। দোকানদার কী করবে না কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বাবুল আক্তার পর্দার কাপড় দেখাতে বললেন। দোকানদার সবচেয়ে ভালো মানের পর্দার কাপড় দেখালেন। বাবুল ভাই হেসে তার সীমাবদ্ধতার কথা দোকানদারকে জানালেন। এও বললেন, এত দামী পর্দা কেনা মানে তার বেতনের পুরোটাই চলে যাওয়া! দোকানদার নাছোড়বান্দা। তিনি এটাই দেবেন এবং টাকা নেবেন না। দোকানদারের অনুরোধে তিনি পর্দার কাপড় নিলেন, তবে শর্ত একটাই কিস্তিতে পরিশোধ করে দেবেন এবং তা-ই করলেন এই বাবুল আক্তার।
দেশ কাঁপানো বাবুল আক্তার
২০০৭ সালে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেন নরসিংদীতে সংঘটিত ছয় খুনের রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব। নরসিংদীর ভেলানগরে ওই বছরের ১৮ মে একই পরিবারের ছয় সদস্যকে খুন করে ঘরের ভেতরেই লাশগুলো বস্তাভর্তি করে রাখা হয়েছিল চার দিন। ঘটনার তদন্তের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চান র্যানব অফিসার বাবুল। অনুমতি পাওয়ার পর শুরু করেন অভিযান।
ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ঘুরে গ্রেফতার করেন ঘটনার মূল হোতা বীরুকে। তার সূত্র ধরে পুরো হত্যারহস্য উন্মোচন করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। মামলার বিচার শেষে আসামিদের ফাঁসির রায় দেন আদালত।
এছাড়া স্কুলশিক্ষিকা তানিয়া হত্যারহস্য উদ্ঘাটন, ১৪ বছরের কিশোর জাভেদকে অপহরণকারীদের হাত থেকে অক্ষত উদ্ধার ও অপহরণরহস্য উদ্ঘাটন, গৃহকর্মী রুমাকে হত্যার পর পুড়িয়ে সব আলামত নষ্টের পরও সূত্রহীন সেই হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করে আসামিদের গ্রেফতার, রাউজানের বেসরকারি ব্যাংকের ভল্ট থেকে সাড়ে ৩৪ লাখ টাকা চুরির হোতা গ্রাজুয়েট চোরচক্রকে গ্রেফতার, চট্টগ্রামের ভয়ংকর ডাকাত সর্দার খলিলকে নয় সহযোগীসহ গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধার, অজ্ঞান-মলমপার্টি-মোটরসাইকেল চোরচক্র গ্রেফতার, সিএনজি চোর ও গামছা পার্টি আবিষ্কার, ডাকাতির প্রস্তুতির সময় রকেট লঞ্চার, ছয় অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার, রাউজানের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়ার কাছ থেকে জি-থ্রি রাইফেল উদ্ধার, চট্টগ্রামের কাদের ডাকাত ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার ত্রাস কিলার ওসমানকে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করেছেন বাবুল আক্তার।
২০১৩ সালে কক্সবাজারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় গ্রেফতার করেন বেশ ক'জন দুর্ধর্ষ জলদস্যুকে। এ কারণে এলাকায় জেলেরা মিষ্টি বিতরণ করেছিল। র্যাতবে থাকাকালীন পুরান ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার জাল সনদ, সনদ তৈরির কারখানা এবং এই অপকর্মের দুই হোতাকে আটক করেন বাবুল আক্তার।
তিনি অনুসন্ধান করে ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকায় সন্ধান পান জেএমবির আস্তানার। সেখান থেকে ৮টি হ্যান্ডগ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ জেএমবির সামরিক প্রধান জাবেদসহ আটক করা হয় পাঁচজনকে।
জাবেদকে নিয়ে পরদিন ৬ অক্টোবর ভোরে পুলিশ আরেকটি অভিযানে গেলে তার সহকর্মীদের ছোঁড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয় জাবেদ।
কর্মজীবন
পুলিশের ২৪ তম ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে র্যারব-২-এ কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি জেলা পুলিশের হাটহাজারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার পদেও কর্মরত ছিলেন।
পরে পদোন্নতি পেয়ে বাবুল আক্তার দীর্ঘদিন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর বদলি হয়ে সিএমপিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দিয়ে দক্ষিণ সুদান গিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই তিনি দেশে ফিরে নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করেন।
তবে সিএমপির অপরাধ দমনে আলোচিত চেৌকস পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে চাহিদাপত্র দিয়ে সিএমপিতে আনেন পুলিশ কমিশনার আব্দুল জলিল মন্ডল। এরপর ছুটি কাটিয়ে ২৬ আগস্ট সিএমপিতে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে যোগদান করেন।
চলতি বছরের ৫ এপ্রিল তাঁর পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি হলে তিনি সিএমপি থেকে ঢাকা পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করেন। ঘটনা এমন হয়েছিল যে- হাটহাজারী এবং কক্সবাজার থেকে বাবুল আক্তারের বদলি ঠেকাতে জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল।
পরিচয়
বাবুল আক্তার ১৯৭৫ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপার মদনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়া ও মা শাহিদা বেগম। ২০০৪ সালে মাহমুদা আক্তারের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেন। তাদের সংসারে দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির ও আক্তার তাবাচ্ছুম তানজিলা। মাহির ক্যান্টেনমেন্ট পাবলিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে।
অপরাধ দমনে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাবুল আক্তার পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পিপিএম (সেবা) (২০০৮), ২০০৯ পিপিএম (সাহসিকতা), ২০১০ সালে আইজিপি ব্যাজ, ২০১১ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসিকতা)। সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে ২০১২ সালে সিঙ্গার-চ্যানেল আই (সাহসিকতা) পুরস্কার লাভ করেছেন বাবুল আক্তার। এর মধ্যে চারবার অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপারের মর্যাদা।
কী মানবিকতা, কী আইন রক্ষা, কী নীষ্ঠা, কী কর্তব্য পালন! যেন প্রতিটি মানবিক আকর্ষনীয় ক্ষেত্রেই বিরাজমান শূণ্যতাকে পূর্ণ করতে এসেছিলেন বাবুল আক্তার! আজ তারই ওপর চালানো হয়েছে বর্বরতা। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে চুড়ান্ত বর্বর কায়দায়! নির্মম পরিহাস একজন মানবপ্রেমী পুলিশ অফিসার বাবুল আক্তারের জীবনে। যিনি মানুষের সেবা করে চট্টগ্রামে আলোচিত হয়ে সদ্য পদন্নোতি প্রাপ্ত হয়েছেন। যখন পুরো দেশের মানুষকে সহযোগীতা করে পুলিশকে নিয়ে ভিন্ন গাথা লিখে ছড়িয়ে দেবেন দেশময়। যখন গোটা দেশের সেবা করে পরিচিত হবার কথা একজন দৃষ্টান্তহীন বাবুলের! তখন কিনা আক্রান্ত হিসেবে পরিচিত হলেন বাংলাদেশে। যেন গোটা দেশের পরিচয় একজন বাবুলকে গ্রাস করে নিলো!
অসামান্য নিবেদিত প্রাণ বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার নেপথ্যে কারা? এখন পর্যন্ত একে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও বাবুল আক্তারের মত একজন সৎ ও কর্মপরায়ন বিরল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চালানো এই বর্বরতা মোটেই সরল অংকের বিষয় নয়। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন এই ঘটনার অনেক গভীর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি ৩০ মে বাবুল আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসের অংশ বিশেষ ছিলো – “...চেষ্টা করেছি সর্বদা সততা ও ন্যায়ের সাথে কাজ করতে, সত্যের পক্ষে থাকতে। তবে পুলিশের চাকরিতে সকলকে সন্তষ্ট করা সম্ভব নয়। হয় অভিযোগপত্র না হয় চুড়ান্ত রির্পোট। এর মাঝামাঝি কোন অবস্থানে থাকার সুযোগ নেই। সে কারনে অনেকের বিরাগভাজন হয়ে থাকতে পারি। তবে এতটুকু বলতে পারি নিজ স্বার্থের জন্য কিছু করিনি। ক্ষমা চাইছি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে।...“
জনগণের প্রকৃত সহযোগী বাবুল আক্তারের ওপর চালানো এই বর্বরতা মোটেও সহজ ও সরল কিছু নয়। এমন একজন বহুকল্যানীর বুরুদ্ধে ঘটা ঘটনার নেপথ্য খুজে বের করা প্রকৃত পক্ষেই দূরহ। কারন সাধারন মানুষের সেবা করে বাবুল আক্তার অনেক দৈত্যের বিরাগ ভাজন হয়ে গেছেন। সবার সহযোগী বাবুল আক্তারকে সহযোগীতা করা তাই সত্যিই কঠিন! মহান সৃষ্টিকর্তা এই মহামানব পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে অটল রাখুন। তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে জান্নাত দান করুন। এই প্রার্থনাই আমাদের সকলের।
(বাবুল আক্তার সম্পৃক্ত তথ্যগুলোঃ ব্লগ এবং জাতীয় দৈনিক থেকে সংগৃহীত)
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৩ টি
০৬ জুন ’১৬ বিকাল ০৩:৫০
স্যালুট ইউ বস! সব কিছুর প্রতিশোধই নেয়া হবে। এদেশে কোন জঙ্গি দাঁড়াতে পারবে না।