শুধু সরকার নয়, সাধারণ মানুষও বড়াইবাড়ির শহীদদের স্মরণ করে না। হায়রে অকৃতজ্ঞ জাতি।
২০০১ সাল ১৮ এপ্রিল, রাত প্রায় চারটা বাজে। রৌমারি গ্রামের মিনহাজ জমিতে পানি দিয়ে বাড়িতে ফিরতেছিল। কিন্তু আচমকা সে দেখতে পেল, রৌমারি সীমান্ত দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বিএসএফ প্রবেশ করছে। মিনহাজ বিডিআর ক্যাম্পের দিকে দ্রুত ছুটতে থাকে। মিনহাজ ক্যাম্পের ইনচার্জকে সব খুলে বলে। সে সময় ক্যাম্পে মাত্র ১০ জন বিডিআর জোয়ার অবস্থান করতেছিলেন। ক্যাম্পের ইনচার্জ সাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন। ক্যাম্পের পাশে বেশ কিছু কলা গাছ ছিল। ইনচার্জ জোয়ানদের বললেন, কলা গাছ গুলো অর্ধেক পর্যন্ত কেটে ফেলে তার মাথায় হেলমেট বসিয়ে দাও। এই রাতে সেগুলোকে দূর থেকে সৈন্য মনে হবে। আর শত্রু পক্ষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হবে। আর এরই মাঝে বিএসএফ সৈন্যরা দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। ক্যাম্পের কাছাকাছি আসতেই তারা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। অন্ধকারে তারা কলাগাছ গুলোকেই বিডিআর জোয়ান মনে করে গুলি বর্ষণ শুরু করে দিল। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে বিডিআর জোয়ানরা কোন গুলি বর্ষণ করছে না। এভাবে ১০ মিনিট অতিবাহিত হবার পর, বিডিআর জোয়ানরা চারটি মেশিনগান দিয়ে তাদের উপর অতর্কিত হামলা শুরু করল। বিডিআরদের সেই মেশিনগানগুলো দিয়ে মিনিটে ২৭ টি করে গুলি বর্ষণ করা সম্ভব হতো। আর অধিক পরিমাণে গুলি বর্ষণ হওয়া দেখে বিএসএফ সৈন্যরা মনে করল, বিডিআররা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। যার কারণে তারা পিছ ফিরে বিশৃঙ্খল ভাবে ছুটতে লাগল। আর এর ফলে বিএসএফ এর ১৬ জন জোয়ান নিহত হল। পরে গ্রামবাসীর হাতে দু’জন বিএসএফ সৈন্য ধরা পড়ে। আর বিপরীত দিকে বিডিআর এর তিন জন জোয়ান শাহাদাত বরণ করল।
রোমারি যুদ্ধের পিছনের ঘটনাঃ
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতাপপুর সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখার ২শ' ৫০ গজ ভিতরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। দেশ স্বাধীনের পর অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ী এলাকা পাদুয়ার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পসহ দু'শ' ৩০ একর ভূমি বিএসএফ অপদখল করে নেয়। ক্যাম্পের আশপাশে বাংলাদেশের জনগণের বসবাস রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যরা এই ক্যাম্প দখলে রেখে আশপাশের বাংলাদেশীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। সীমান্ত লাইন থেকে অনেক ভিতরে অবস্থিত বিএসএফ-এর এই ক্যাম্পটি প্রত্যাহারের একাধিকবার আলোচনা হয়েছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে বিডিআর-এর উপ-মহাপরিচালক ও বিএসএফ-এর আইজি পর্যায়ে প্রতিটি সভায় পাদুয়া গ্রামটি নিয়ে আলোচনা হয়। বিএসএফ পাদুয়া ক্যাম্পের অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে-এ কথা স্বীকার করলেও নানা অজুহাতে ক্যাম্পটি সরিয়ে নিতে গড়িমসি করছিল। এই এলাকাটির কাছাকাছি আরও কয়েকটি অপদখলীয় এলাকা রয়েছে।
১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সিলেট সীমান্তের লাতু এলাকা থেকে কয়েকজন বিডিআর সদস্যকে বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর আজিজুর রহমান। বিডিআর এ সময় পাদুয়া দখলে নিতে বিএসএফকে হুশিয়ারি জানিয়েছিল। এই ঘটনাটি ছাড়া পাদুয়ায় বিএসএফের ফাঁড়ি নিয়ে আর কখনও উচ্চবাচ্য হয়নি। সর্বশেষ ঘটনার দু'মাস আগেও বিএসএফকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এরই প্রেক্ষিতে বিডিআর ১৫ এপ্রিল ২০০১ রাতে পাদুয়া গ্রাম পুনরুদ্ধার করে এবং সেখানে ৩টি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। গ্রামটি পুনরুদ্ধারের সময় কোন পক্ষ থেকে গোলাগুলি হয়নি। পাশাপাশি পাদুয়া গ্রামটি থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে সোনাপুর সীমান্ত পর্যবেক্ষণ চৌকির উল্টোদিকে ভারত একটি পাকা রাস্তা তৈরি করে। সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে জিরো লাইন থেকে ৩০ মিটার দূরে নির্মিত রাস্তাটি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ফলে ঐ সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পাদুয়ার ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিএসএফ অবৈধভাবে নোম্যান্সল্যান্ডে রাস্তা নির্মাণ করছিল। এই নির্মাণ কাজে বাধা দেয়া ছিল বিডিআরের রুটিন মাফিক দায়িত্ব।
ভারতের ইংরেজী দৈনিক টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা প্রণয় শর্মা ২০ এপ্রিল নতুন দিল্লী ডেটলাইনে লিখেছেন, ‘‘ভারত ফুটপাথ বিতর্কের প্রসঙ্গটি জনসমক্ষে আনেনি। সীমান্ত গাইড লাইনে বলা আছে, সড়কসহ কোন প্রতিরক্ষামূলক নির্মাণ জিরো লাইনের ১৫০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিএসএফ নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছিল। গত সপ্তাহান্তে বিডিআর ফুটপাথ নির্মাণ বন্ধ করতে ঐ এলাকায় অভিযান চালায়।’’
আর এই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিএসএফ পাদুয়া ঘটনার মাত্র তিনদিনের মধ্যে বড়াইবাড়ী অপারেশন চালায়। বাংলাদেশের বড়াইবাড়ি, হিজলামারী, খেওয়ারচর, বিডিআর ক্যাম্পগুলো যেমন দুর্গম তেমনি অনুন্নত। বিএসএফ'রা ১৬ এপ্রিল দুপুরে বড়াইবাড়ি অপারেশন পরিকল্পনা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহেন্দগঞ্জ-কামালপুর পাকা সড়ক নির্মাণ সহজ করা এবং বড়াইবাড়ির চার কিলোমিটার অতি উর্বরা জমি ভারতীয়দের দখলে আনা। ধুবরী, মহেন্দ্রগঞ্জ, গৌহাটি থেকে রাতেই তিন প্লাটুন ক্যাটস আই কমান্ডো ও দু'শর বেশি অতিরিক্ত বিএসএফ এসে গোপনে অবস্থান নেয় মাইনকারচর ক্যাম্পের আশেপাশে।
এদিকে বাংলাদেশী পত্রবাহক (বিডিআর-এর বিভিন্ন চিঠি বিএসএফ ক্যাম্পে পৌঁছায়) লুৎফর রহমান মাইনকারচর বিএসএফ ক্যাম্প ঘুরে এসে বলেছিলেন সেখানে ভারতীয় সেনাসদস্যরাও ব্যাংকারে অবস্থান নিয়েছে। প্রস্তুত আছে মর্টার, কামান, মেশিনগান ও সাঁজোয়া যান। বাংলাদেশ সীমান্তে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার না থাকায় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের বিডিআর'রা বিএসএফ-এর আক্রমণের প্রস্তুতি আগে বুঝতে পারেনি। কিন্তু বিকাল ৫টায় বিএসএফ-এর কাছ থেকে ফ্ল্যাগ মিটিং-এর একটি রহস্যময় প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি আসায় বড়াইবাড়ী ফাঁড়ির বিডিআর কমান্ডার নজরুল ইসলামের সন্দেহ হয়। কোন সংঘাত, সংঘর্ষ, অঘটন নেই তবুও কেন বিএসএফ ফ্ল্যাগ মিটিং-এর জন্য প্রস্তাব দিল। আসলে বিএসএফ চেয়েছিল ফ্ল্যাগ মিটিং এর জন্য বিডিআরের ৫/৬ জন বড়াইবাড়ী ক্যাম্পে ভারতের সীমানায় গেলে তারা বিডিআরদের আটকে রেখে বড়াইবাড়ী হামলা করবে। পরে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে খবর ছড়ানো হতো বাংলাদেশের বিডিআররা প্রথমে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করে আক্রমণ করেছে। এই অজুহাতে তাদের বড়াইবাড়ী অপারেশন হতো সাকসেসফুল।
ফ্ল্যাগ মিটিং-এর জন্য পাঠানো ওই চিঠিটি ষড়যন্ত্রমূলক মনে হওয়ায় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের কমান্ডার নজরুল ইসলাম ভারতীয়দের পাতানো ফাঁদে পা দেননি। উল্টো রাতে ক্যাম্পে ১০ জন সহযোগীকে তিনি সারারাত সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। কাঁটাতারের বেড়ার মাঝে পূর্ব অংশের গেট দিয়ে রাত ৩টার দিকে ভারতীয় কমান্ডো, সেনা ও বিএসএফ-এর প্রায় চারশত সদস্যের যৌথ-বাহিনী ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে ঢুকে পড়ে বড়াইবাড়ী সীমানায়। শুকিয়ে যাওয়া খাল দিয়ে তারা ক্রস করে এগিয়ে তিনদিক থেকে বড়াইবাড়ী ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আর এরপরই ঘটে সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ!
১৮ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আ.ল.ম. ফজলুর রহমান বলেন, ‘বিনা কারণে রৌমারী সীমান্তে বিএসএফয়ের গুলীবর্ষণ, ও প্রাণহানির জন্য ভারতকে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।' ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং ১৯ এপ্রিল মন্তব্য করেন যে, ‘পাদুয়ায় বিডিআরের অবাঞ্ছিত প্রবেশে শেখ হাসিনা সরকারের সায় ছিল না।'
২০ এপ্রিল বিকেলে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, ‘সিলেটের তামাবিল এলাকার পাদুয়া থেকে বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর-এর ঘেরাও তুলে নেয়া হয়েছে। ভারতও তার বিরোধপূর্ণ রাস্তাটি ভেঙ্গে দিয়েছে।' ২১ এপ্রিল ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার মনিলাল ত্রিপাঠি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বড়াইবাড়ীতে রাতের আধারে সীমান্ত অতিক্রম করে শত শত ভারতীয় সৈন্যের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ, বিডিআর সৈন্যদের হত্যা, বাংলাদেশের গ্রাম লুট ও জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় যখন সারাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার দাবি উঠেছে ঠিক তখনই তৎকালীন সরকার প্রধান ২২ এপ্রিল দিবাগত রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে আধাঘণ্টাব্যাপী এক টেলিফোন সংলাপে বসেন এবং এই সময়ে ৩ বার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিডিআরের ভূমিকায় (বীরত্বের জন্য) দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে নিজ দেশে বাজপেয়ী সরকারের মুখ রক্ষা করতে বাংলাদেশের সরকার প্রধান দুঃখ প্রকাশ করলে ভারতীয় পক্ষ থেকে তাদের দেশে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এ ঘটনায় দায়ভার এককভাবে বিডিআর প্রধানের উপর চাপিয়ে দেয়।
কিন্তু বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় (২১-৪-২০১১) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর এতে সমর্থন থাকবে। এই আস্থা নিয়েই আমি অগ্রসর হয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিনি। খুব কাছ থেকে দেখেছি।' পত্রিকাটি আরও জানায়, ‘ভূমি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বিডিআর প্রধানকে নিরুৎসাহিত করলে তিনি নিজ উদ্যোগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন।
মূলত, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এত প্রাণহানির মতো সংঘর্ষ এর আগে আর কখনো ঘটেনি। কুড়িগ্রাম ও সিলেট বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আওয়ামী সরকারের নীতি-নির্ধারকরা উদ্বিগ্ন ছিল। এই ঘটনায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রীতিমত হতচকিত হয়ে যায়। প্রথমে ভারত সরকার বিষয়টি হজম করার চেষ্টা করলেও প্রচার মাধ্যম ও বিরোধী দলের চাপে পড়ে এ নিয়ে সোচ্চার হয়। ঘটনাটি ভারত ও তার বিশাল সামরিক বাহিনীর ইজ্জতের ওপর একটা বড় ধরনের আঘাত ছিল। স্বভাবতই তারা ক্ষিপ্ত হয় বাংলাদেশের উপর। আর এই ক্ষোভের বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলে। আওয়ামী সরকারের একটি মহল বিডিআর-এর ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। পাদুয়া দখলমুক্ত করার পর তা আবার ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়ায় সিলেটসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
সরকার শহীদ সিপাহীদের জাতীয় মর্যাদায় দাফন ও পুরস্কৃত করা তো দূরে থাক সরকারের একজন মন্ত্রীও রৌমারী পরিদর্শনে যাননি দীর্ঘদিন। এমনকি এ সময় বিডিআর প্রধানসহ বড়াইবাড়ীর বীর জওয়ানদের বদলী করা হয় (শান্তিস্বরূপ)।
বাংলাদেশ রাইফেলসের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর_জেনারেল ফজলুর রহমান সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেনঃ ২০০১ সালে পদুয়া এবং রৌমারিতে ভারতকে মোকাবেলা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো, এবং সেখানে ভারত শোচনীয় ভাবে আমাদের কাছে পরাজিত হয়। আমি পুরস্কার হিসাবে, এক সরকার আমাকে পদচ্যুত করে এবং আরেক সরকার আমাকে চাকরীচ্যুত করে।
আজ সেই রৌমারি দিবস। সেই তিন বীর বিডিআর জোয়ানের শাহাদাত দিবস। কিন্তু মিডিয়ায় তাদের কোন সংবাদ আর স্থান পায় না। তাদের বীরত্বগাধা দেশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় না। হে বীর শহীদ! আমরা লজ্জিত। তোমাদের প্রকৃত সম্মান আমরা দিতে পারি নি এবং এখনও পারছি না। বাংলাদেশে আজ কত দিবস পালিত হয় কিন্তু রৌমারির সেই বীরদের শাহাদাত দিবসের কথা শুধু সরকার নয় সাধারণ মানুষও স্মরণ করে না। হায়রে অকৃতজ্ঞ জাতি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
রোমারি যুদ্ধের পিছনের ঘটনাঃ
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতাপপুর সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখার ২শ' ৫০ গজ ভিতরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। দেশ স্বাধীনের পর অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ী এলাকা পাদুয়ার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পসহ দু'শ' ৩০ একর ভূমি বিএসএফ অপদখল করে নেয়। ক্যাম্পের আশপাশে বাংলাদেশের জনগণের বসবাস রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যরা এই ক্যাম্প দখলে রেখে আশপাশের বাংলাদেশীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। সীমান্ত লাইন থেকে অনেক ভিতরে অবস্থিত বিএসএফ-এর এই ক্যাম্পটি প্রত্যাহারের একাধিকবার আলোচনা হয়েছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে বিডিআর-এর উপ-মহাপরিচালক ও বিএসএফ-এর আইজি পর্যায়ে প্রতিটি সভায় পাদুয়া গ্রামটি নিয়ে আলোচনা হয়। বিএসএফ পাদুয়া ক্যাম্পের অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে-এ কথা স্বীকার করলেও নানা অজুহাতে ক্যাম্পটি সরিয়ে নিতে গড়িমসি করছিল। এই এলাকাটির কাছাকাছি আরও কয়েকটি অপদখলীয় এলাকা রয়েছে।
১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সিলেট সীমান্তের লাতু এলাকা থেকে কয়েকজন বিডিআর সদস্যকে বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর আজিজুর রহমান। বিডিআর এ সময় পাদুয়া দখলে নিতে বিএসএফকে হুশিয়ারি জানিয়েছিল। এই ঘটনাটি ছাড়া পাদুয়ায় বিএসএফের ফাঁড়ি নিয়ে আর কখনও উচ্চবাচ্য হয়নি। সর্বশেষ ঘটনার দু'মাস আগেও বিএসএফকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এরই প্রেক্ষিতে বিডিআর ১৫ এপ্রিল ২০০১ রাতে পাদুয়া গ্রাম পুনরুদ্ধার করে এবং সেখানে ৩টি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। গ্রামটি পুনরুদ্ধারের সময় কোন পক্ষ থেকে গোলাগুলি হয়নি। পাশাপাশি পাদুয়া গ্রামটি থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে সোনাপুর সীমান্ত পর্যবেক্ষণ চৌকির উল্টোদিকে ভারত একটি পাকা রাস্তা তৈরি করে। সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে জিরো লাইন থেকে ৩০ মিটার দূরে নির্মিত রাস্তাটি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ফলে ঐ সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পাদুয়ার ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিএসএফ অবৈধভাবে নোম্যান্সল্যান্ডে রাস্তা নির্মাণ করছিল। এই নির্মাণ কাজে বাধা দেয়া ছিল বিডিআরের রুটিন মাফিক দায়িত্ব।
ভারতের ইংরেজী দৈনিক টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা প্রণয় শর্মা ২০ এপ্রিল নতুন দিল্লী ডেটলাইনে লিখেছেন, ‘‘ভারত ফুটপাথ বিতর্কের প্রসঙ্গটি জনসমক্ষে আনেনি। সীমান্ত গাইড লাইনে বলা আছে, সড়কসহ কোন প্রতিরক্ষামূলক নির্মাণ জিরো লাইনের ১৫০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিএসএফ নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছিল। গত সপ্তাহান্তে বিডিআর ফুটপাথ নির্মাণ বন্ধ করতে ঐ এলাকায় অভিযান চালায়।’’
আর এই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিএসএফ পাদুয়া ঘটনার মাত্র তিনদিনের মধ্যে বড়াইবাড়ী অপারেশন চালায়। বাংলাদেশের বড়াইবাড়ি, হিজলামারী, খেওয়ারচর, বিডিআর ক্যাম্পগুলো যেমন দুর্গম তেমনি অনুন্নত। বিএসএফ'রা ১৬ এপ্রিল দুপুরে বড়াইবাড়ি অপারেশন পরিকল্পনা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহেন্দগঞ্জ-কামালপুর পাকা সড়ক নির্মাণ সহজ করা এবং বড়াইবাড়ির চার কিলোমিটার অতি উর্বরা জমি ভারতীয়দের দখলে আনা। ধুবরী, মহেন্দ্রগঞ্জ, গৌহাটি থেকে রাতেই তিন প্লাটুন ক্যাটস আই কমান্ডো ও দু'শর বেশি অতিরিক্ত বিএসএফ এসে গোপনে অবস্থান নেয় মাইনকারচর ক্যাম্পের আশেপাশে।
এদিকে বাংলাদেশী পত্রবাহক (বিডিআর-এর বিভিন্ন চিঠি বিএসএফ ক্যাম্পে পৌঁছায়) লুৎফর রহমান মাইনকারচর বিএসএফ ক্যাম্প ঘুরে এসে বলেছিলেন সেখানে ভারতীয় সেনাসদস্যরাও ব্যাংকারে অবস্থান নিয়েছে। প্রস্তুত আছে মর্টার, কামান, মেশিনগান ও সাঁজোয়া যান। বাংলাদেশ সীমান্তে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার না থাকায় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের বিডিআর'রা বিএসএফ-এর আক্রমণের প্রস্তুতি আগে বুঝতে পারেনি। কিন্তু বিকাল ৫টায় বিএসএফ-এর কাছ থেকে ফ্ল্যাগ মিটিং-এর একটি রহস্যময় প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি আসায় বড়াইবাড়ী ফাঁড়ির বিডিআর কমান্ডার নজরুল ইসলামের সন্দেহ হয়। কোন সংঘাত, সংঘর্ষ, অঘটন নেই তবুও কেন বিএসএফ ফ্ল্যাগ মিটিং-এর জন্য প্রস্তাব দিল। আসলে বিএসএফ চেয়েছিল ফ্ল্যাগ মিটিং এর জন্য বিডিআরের ৫/৬ জন বড়াইবাড়ী ক্যাম্পে ভারতের সীমানায় গেলে তারা বিডিআরদের আটকে রেখে বড়াইবাড়ী হামলা করবে। পরে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে খবর ছড়ানো হতো বাংলাদেশের বিডিআররা প্রথমে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করে আক্রমণ করেছে। এই অজুহাতে তাদের বড়াইবাড়ী অপারেশন হতো সাকসেসফুল।
ফ্ল্যাগ মিটিং-এর জন্য পাঠানো ওই চিঠিটি ষড়যন্ত্রমূলক মনে হওয়ায় বড়াইবাড়ী ক্যাম্পের কমান্ডার নজরুল ইসলাম ভারতীয়দের পাতানো ফাঁদে পা দেননি। উল্টো রাতে ক্যাম্পে ১০ জন সহযোগীকে তিনি সারারাত সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। কাঁটাতারের বেড়ার মাঝে পূর্ব অংশের গেট দিয়ে রাত ৩টার দিকে ভারতীয় কমান্ডো, সেনা ও বিএসএফ-এর প্রায় চারশত সদস্যের যৌথ-বাহিনী ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে ঢুকে পড়ে বড়াইবাড়ী সীমানায়। শুকিয়ে যাওয়া খাল দিয়ে তারা ক্রস করে এগিয়ে তিনদিক থেকে বড়াইবাড়ী ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আর এরপরই ঘটে সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ!
১৮ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আ.ল.ম. ফজলুর রহমান বলেন, ‘বিনা কারণে রৌমারী সীমান্তে বিএসএফয়ের গুলীবর্ষণ, ও প্রাণহানির জন্য ভারতকে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।' ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং ১৯ এপ্রিল মন্তব্য করেন যে, ‘পাদুয়ায় বিডিআরের অবাঞ্ছিত প্রবেশে শেখ হাসিনা সরকারের সায় ছিল না।'
২০ এপ্রিল বিকেলে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, ‘সিলেটের তামাবিল এলাকার পাদুয়া থেকে বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর-এর ঘেরাও তুলে নেয়া হয়েছে। ভারতও তার বিরোধপূর্ণ রাস্তাটি ভেঙ্গে দিয়েছে।' ২১ এপ্রিল ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার মনিলাল ত্রিপাঠি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বড়াইবাড়ীতে রাতের আধারে সীমান্ত অতিক্রম করে শত শত ভারতীয় সৈন্যের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ, বিডিআর সৈন্যদের হত্যা, বাংলাদেশের গ্রাম লুট ও জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় যখন সারাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার দাবি উঠেছে ঠিক তখনই তৎকালীন সরকার প্রধান ২২ এপ্রিল দিবাগত রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে আধাঘণ্টাব্যাপী এক টেলিফোন সংলাপে বসেন এবং এই সময়ে ৩ বার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিডিআরের ভূমিকায় (বীরত্বের জন্য) দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে নিজ দেশে বাজপেয়ী সরকারের মুখ রক্ষা করতে বাংলাদেশের সরকার প্রধান দুঃখ প্রকাশ করলে ভারতীয় পক্ষ থেকে তাদের দেশে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এ ঘটনায় দায়ভার এককভাবে বিডিআর প্রধানের উপর চাপিয়ে দেয়।
কিন্তু বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় (২১-৪-২০১১) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর এতে সমর্থন থাকবে। এই আস্থা নিয়েই আমি অগ্রসর হয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিনি। খুব কাছ থেকে দেখেছি।' পত্রিকাটি আরও জানায়, ‘ভূমি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বিডিআর প্রধানকে নিরুৎসাহিত করলে তিনি নিজ উদ্যোগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন।
মূলত, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এত প্রাণহানির মতো সংঘর্ষ এর আগে আর কখনো ঘটেনি। কুড়িগ্রাম ও সিলেট বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আওয়ামী সরকারের নীতি-নির্ধারকরা উদ্বিগ্ন ছিল। এই ঘটনায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রীতিমত হতচকিত হয়ে যায়। প্রথমে ভারত সরকার বিষয়টি হজম করার চেষ্টা করলেও প্রচার মাধ্যম ও বিরোধী দলের চাপে পড়ে এ নিয়ে সোচ্চার হয়। ঘটনাটি ভারত ও তার বিশাল সামরিক বাহিনীর ইজ্জতের ওপর একটা বড় ধরনের আঘাত ছিল। স্বভাবতই তারা ক্ষিপ্ত হয় বাংলাদেশের উপর। আর এই ক্ষোভের বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলে। আওয়ামী সরকারের একটি মহল বিডিআর-এর ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। পাদুয়া দখলমুক্ত করার পর তা আবার ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়ায় সিলেটসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
সরকার শহীদ সিপাহীদের জাতীয় মর্যাদায় দাফন ও পুরস্কৃত করা তো দূরে থাক সরকারের একজন মন্ত্রীও রৌমারী পরিদর্শনে যাননি দীর্ঘদিন। এমনকি এ সময় বিডিআর প্রধানসহ বড়াইবাড়ীর বীর জওয়ানদের বদলী করা হয় (শান্তিস্বরূপ)।
বাংলাদেশ রাইফেলসের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর_জেনারেল ফজলুর রহমান সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেনঃ ২০০১ সালে পদুয়া এবং রৌমারিতে ভারতকে মোকাবেলা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো, এবং সেখানে ভারত শোচনীয় ভাবে আমাদের কাছে পরাজিত হয়। আমি পুরস্কার হিসাবে, এক সরকার আমাকে পদচ্যুত করে এবং আরেক সরকার আমাকে চাকরীচ্যুত করে।
আজ সেই রৌমারি দিবস। সেই তিন বীর বিডিআর জোয়ানের শাহাদাত দিবস। কিন্তু মিডিয়ায় তাদের কোন সংবাদ আর স্থান পায় না। তাদের বীরত্বগাধা দেশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় না। হে বীর শহীদ! আমরা লজ্জিত। তোমাদের প্রকৃত সম্মান আমরা দিতে পারি নি এবং এখনও পারছি না। বাংলাদেশে আজ কত দিবস পালিত হয় কিন্তু রৌমারির সেই বীরদের শাহাদাত দিবসের কথা শুধু সরকার নয় সাধারণ মানুষও স্মরণ করে না। হায়রে অকৃতজ্ঞ জাতি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ১ টি
২০ এপ্রিল ’১৬ রাত ০২:৩০
প্রতিবেশির সাথে ঘটা ক্ষত কম মনে করাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? আপ০নি পারবেন আপনার প্রতিবেশির সাথে সমস্যা জিইয়ে রেখে সুখে থাকতে?