২১ ফেব্রুয়ারি : দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল—সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলা ভাষা মর্যাদার সাথে ব্যবহার করতে হবে। এই দাবি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় কখনো কখনো জোরালো হয়েছিল, তা আজ যেন অমাবস্যার অন্ধকারে অন্তর্ঘাতমূলক অবস্থায় পতিত হয়েছে, যার ফলে সরকারি পর্যায়ে বাংলাভাষা ব্যবহারের শিথিলতা এখন আগের চেয়ে আরও বেড়েছে!
একটি উদাহরণ দিই, ১৩৯০ সনের ২৮ মাঘ এক সরকারি নির্দেশে বলা হয়েছিল—‘সরকারি নথিপত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করা শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী অসদাচারণ বলে গণ্য হবে এবং প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর)-এ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বাংলা ভাষা ব্যবহারে আগ্রহ ও দক্ষতার বিষয়টি উল্লেখ থাকতে হবে।’ এ নির্দেশ জারির পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে আলাদা একটি ছক সংযোজন করা হয়েছিল। এর ফলে বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ছিল এবং বাংলা ব্যবহারের উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারি প্রশাসনে ভাষা বিষয়ে জটিলতা ও স্থবিরতা অনেকটা কেটে গিয়েছিল।
আমরা জানি, একটি ফাইলে যে নোট দেওয়া হয় তার সাথে একটি কার্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী যুক্ত থাকেন এবং সেই নোট অনুযায়ী বিভিন্ন জনের ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়। সেখানে যদি অভিন্ন ভাষায় নোট লেখা হয়, তবে অনাবশ্যক জটিলতা কমে যায়, কাজের গতি বাড়ে। কিন্তু মুষ্টিমেয় কর্মকর্তার হীনমন্যতার কারণে অভিন্ন ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়ছে! শুধু তাই নয়, কোনো কোনো সরকারি কর্তা ব্যক্তির ইংরেজি ভাষা তোষণের কারণে এবং সরকারের উদাসীনতার জন্য উল্লিখিত বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ছকটি ১৩৯৯ সনে বাতিল করা হয়, যা ১৩৯৮ সন পর্যন্ত নিয়মিত পূরণ করা হতো। ১৩৯৯ সনে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন ছাপা হয়, তাতে এই ছকটি আর ছাপা হয়নি! এ বিষয়টি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সেই সময়ে বিস্মিত করেছিল। কিন্তু এর পরবতীতে প্রশাসনে বাংলা ভাষা ব্যবহারের মূলে কুঠারাঘাত করার এই বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়নি। কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকেও প্রতিবাদ উঠেনি। এইভাবে চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হচ্ছে বাংলা ভাষা।
পূর্ববর্তী (১৩৯০) সরকারি নির্দেশে বলা হয়েছিল—‘এখন থেকে মন্ত্রী ও সচিবের কাছে পাঠানো নথিতে বাংলা নোট লিখতে হবে। নইলে তা বিবেচনার জন্য গৃহীত হবে না।’ আমাদের আশ্চর্য হতে হয়–স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষত সরকারি প্রশাসনে–প্রতিষ্ঠানে যতটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল, সেই অগ্রগতির ধারাটুকু ধীরে ধীরে রুদ্ধ করা হয়েছে! এমনকি বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেই সময়ে কিছু বাস্তবধর্মী আইন ও কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল, তা বাংলা প্রচলনে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।
বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বলে গর্ব করা এবং বাংলা ভাষার দরদী বলে জিগির তোলা সরকারকে দেখছি, তারা সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বৈরশাসকের শাসনামলের চেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারছেন না! বরং এ সরকারের আমলে বাংলা ভাষা প্রচলনের পূর্ববর্তী নিয়ম-নির্দেশ অবজ্ঞা করা শুধু হচ্ছে না, বাংলা ভাষা প্রচলনের সম্ভাবনা ও শক্তিকে সংকুচিত করা হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তাহলে আমরা কি ভাবব না—এই সরকার বাংলা ভাষার কাঙ্খিত মিত্র হয়ে উঠতে পারেনি!
অথচ ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দৃপ্ত উচ্চারণে ঘোষণা দিয়েছিলেন—‘ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করবো না। কারণ তাহলে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এই অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে, তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলী খানের ভাষ্যানুযায়ী বঙ্গবন্ধু যেদিন দপ্তরে বসেছিলেন, সেদিনই ইংরেজিতে লেখা একটি নথি নিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে। ইংরেজিতে লেখা নথি দেখে বঙ্গবন্ধু উষ্মা প্রকাশ করে প্রশ্ন করেছিলেন যে এই স্বাধীন দেশেও কি তাকে ইংরেজিতে লিখিত নথি দেখতে হবে। অতঃপর তিনি তাকে এই মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ দিয়েছিলেন যে এখন থেকে সকল নথি বাংলায় লিখিত হতে হবে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করার জন্য বলেছেন অথচ তার সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা এখন কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে, তা বিবেচনা নেওয়া জরুরি। শুধু দাপ্তরিক কাজে নয়, আইন-আদালতসহ প্রায় সর্বস্তরে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহার কমছে, ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে। আমরা ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে নিজেদের অহং প্রকাশে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎপর হলেও—বাংলা ভাষার বিকাশে তৎপর কতটুকু, তা বিবেচনায় টেনে আনা উচিত। ভাষা ব্যবহারের জন্য হঠাৎ হঠাৎ করা কিছু পদক্ষেপ ও ঘোষণা এসেছে কিন্তু একটি জাতীয় ভাষানীতি আমরা ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৭০ বছর পার হওয়ার পরও প্রণয়ন করতে পারেনি!
এর ফলে বাংলা ভাষা নিয়ে বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশে শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি, খাদ্যনীতি, ক্রীড়ানীতি, বাল্যবিবাহনীতি এবং আরও কত নীতি আছে! কিন্তু ভাষানীতি নেই! একটি ভাষানীতি থাকলে—শিক্ষার মাধ্যম কী হবে, প্রশাসনের ভাষা কী হবে, বানানরীতি কী হবে, আদিবাসীদের ভাষা কী পর্যায়ে থাকবে, ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষার অবস্থান কী হবে, কম্পিউটারে ভাষার পরিস্থিতি কী হবে, পরিভাষা কী হবে, রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা কী হবে—এগুলো নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা ও দিক-নির্দেশনা থাকত। কিন্তু সে দিকে খেয়াল নেই সংশ্লিষ্ট কারোরই! ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি আমারা বিবেচনায় নিতে পারি। তারা তো জাতীয় ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না। আমরা উল্লিখিত দেশের কথা বাদই দিলাম, পাশের দেশ নেপালের কথাই বলি, সে দেশেও একটি ভাষানীতি আছে, তারা উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে অথচ আমরা এখনো আমাদের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছি না!
শহীদ দিবসে কি শুধু গতানুগতিক এক আনুষ্ঠানিকতায় আমরা ফুল দিতে যাব? নাকি পাকিস্তানি আমলের মতো বাংলা প্রচলনের শিথিলতা, সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষা প্রচলনে গাফিলতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্লোগানমুখর মিছিলের সৃষ্টি করব? সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যে মিছিল শুধু শহীদ মিনারে যাবে না, অন্যখানেও যাবে। শহীদ দিবসের এইমাসে তাই বিবেক জাগানো এমন প্রশ্ন নিয়ে জেগে উঠি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.