বঙ্গবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিিত হয়।নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটি সফর করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ভাষণ দেন।ঐ ভাষণে তিনি ত্রিদিব রায়ের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাকে তিরষ্কার করেন এবং ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের আদিবাসীরা(পাহাড়ী জনগোষ্ঠী) সবাই বাঙালী।
তিনি আদিবাসীদের ভাষা, ধর্ম,সাহিত্য,সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবনে কেউই হস্তক্ষেপ করবে না বলে তাদের আশ্বস্ত করেন।তিনি আরও বলেন যে এতদিন পাহাড়ীদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদাও দেয়া হয়নি।এখন সেই দিনের অবসান হয়েছে, পাহাড়ীরা দেশের যেকোন নাগরিকের মর্যাদা পাবে।
তিনি সেই সময়ে বাঙালীদের পাহাড়ী জায়গাজমি জোর করে দখল করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী দেন।ঐ সময় সরকার পাহাড়ীদের ভূমি অধিকার বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।উল্লেখ্য,পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে ব্যাপক হারে নোয়াখালী,কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং মুক্তিযদ্ধের সময় বিশেষ করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যর সীমান্ত এলাকা বর্তমান রামগড় এবং মাটিরাংগা থানার আসালং,বড়বিল,তবলছড়ি ইত্যাদি এলাকায় ব্যাপকভাবে বর্তমান ফেণী জেলা থেকে বাঙালীরা সরকারি মদতে অনুপ্রবেশ করে পাহাড়ীদের জায়গাজমি দখল করে নেয়।স্বাধীনতার পরও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে এবং নানা কৌশলে পাহাড়ীদের ভীটেমাটি হতে উৎখাত করা হয়।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের ২টি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়।একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন "মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা" নিজেই এবং অন্য আসনে তাঁর সহযোগী "চাইথোয়াই রোয়াজা"।উভয় আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তারা সহজেই জয় লাভ করেন।
রাজা ত্রিদিব রায় এবং অংশুয়ে প্রু চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী ভূমিকা এবং তাদের প্ররোচনায় কিছু পাহাড়ী যুবকের রাজাকার এবং সিভিল আমর্ড ফোর্সে যোগদান করার অজুহাতে অনেক সুযোগসন্ধানী বাঙালী, পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে স্বাধীন বাংলাদেশ বিরোধী বলে চিহ্নিত করতে থাকে।জেলা প্রশাসক জিন্নাত আলী তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের সংখ্যালঘু করার জন্য সেখানে বাঙালী পুনর্বাসনেে সুপারিশ করেন।তবে পাহাড়ীদের সৌভাগ্য যে তিনি খুব বেশি দিন জেলা প্রশাসক ছিলেন না।তারপর জেলা প্রশাসক হিসেবে আসেন সরাফত উল্লাহ।তিনিও বেশিদিন জেলা প্রশাসক ছিলেন না।এরপরে আসেন আব্দুল কাদের।পূর্বে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে উপ-সচিব এবং বঙ্গবন্ধুর একজন বিশ্বাসভাজন ব্যাক্তি ছিলেন।আব্দুল কাদের সত্যিকারের মানবদরদী ছিলেন।তিনি পাহাড়ী আদিবাসীদের সরলতা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।তিনি এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এ.কে.এম ফজলুল হক মিঞা বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে সক্ষম হন যে পাহাড়ের পাহাড়ী আদিবাসীরা অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ।পাকিস্তান আমলে তাদের(পাহাড়ীদের) সবসময় পাকিস্তানবিরোধী বলে সন্দেহ করা হতো এবং সেজন্য সেসময় তাদের উপর অনেক অত্যাচার ও অবিচার করা হয়।কেবলমাত্র রাজা ত্রিদিব রায় এবং অংশুয়ে প্রু চৌধুরী পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করায় তাদের সকলকে বাংলাদেশ বিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী হিসাবে মনে করার কোন যুক্তি নেই।
১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাংগামাটি সফরে আসেন।এসময় তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য, পাহাড়ী প্রধান এবং গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দান কালে ঘোষণা করেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তিনি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে ৩টি জেলায় বিভক্ত করেছেন।
পরে বাকশাল গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বাকশালে যোগদান করার আহ্বান জানান।কিন্তু লারমা বাকশালে যোগদান করেননি।এর কিছুদিন পর বাকশালের গভর্নর এবং জেলাা ম্যাজিস্ট্রেট পদ্ধতি চালু করা হয়।শরদিন্দু শেখর চাকমাকে সাতক্ষীরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় এবং গবর্নর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় ডাকা হয়।শরদিন্দু শেখর চাকমা ঢাকায় এসে একদিন এমপি হোস্টেলে লারমার সাথে দেখা করেন।আলাপকালে লারমাকে তিনি বলেন স্রোতের বিপরীতে যাওয়া ঠিক হবেনা।এতে বঙ্গবন্ধু আরো বিক্ষুব্দ হবেন এবং পাহাড়ীদের ক্ষতির সম্ভাবনাটা একটু বেশিই হবে।তাই তার বাকশালে যোগদান করা উচিৎ।এর কয়েকদিন পরই লারমা বাকশালে যোগদান করেন।পরবর্তীতে রাঙ্গামাটির তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ফজলুল হক শরদিন্দু শেখর চাকমাকে বলেন যে তিনি এবং জেলা প্রশাসক আব্দুল কাদেরও লারমাকে বাকশালে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিলেন।উল্লেখ্য তাদের উভয়েরই সাথে লারমা একটা সুসম্পর্ক ছিলো।
বাকশাল গঠন করার পরে বঙ্গবন্ধু মানিকছড়ির মং চীফ মং প্রু সাইন এবং বান্দরবনের বোমাং চীফ মংশুয়ে প্রু চৌধুরীকে যথাক্রমে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবনের গবর্নর নিয়োগ করেছিলেন।পাহাড়ীদের অত্যন্ত আস্থাভাজন জেলা প্রশাসক আব্দুল কাদেরকে রাঙ্গামাটি জেলার গবর্নর নিয়োগ করা হয়।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বর মাসে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আত্মগোপন করেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.