মৃত্যু হলে আমার লাশটি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও
বঙ্গবন্ধু থেকে সম্মাননা গ্রহণ করছেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার রিগান
ফাদার মারিনো রিগান পঞ্চােশর দশকে বাংলাদেশে আসা একজন ইতালিও ধর্ম প্রচারক, দার্শনিক, লেখক ও অনুবাদক। পরবর্তীতে যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে তাকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়া হয়। যিনি ধর্ম আর দেশের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে বাঙালির বন্ধু হিসেবেই সমধিক পরিচিত। সেই ফাদার মারিনো রিগান আর নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি এদেরই একজন হয়ে এদের পাশে দাঁড়ান পরম বন্ধুর মত। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা-লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের কারণে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজ চোখে দেখে যুদ্ধপীড়িত ও যুদ্ধাহত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন, চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ঢেলে সাজালেন নিজের ক্ষুদ্র চিকিৎসাকেন্দ্রটি। সেই সাথে তাদের আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থাও করলেন।
তার কাছে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন ফাদার মারিনো রিগান সম্পর্কে বলেন-
‘১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে আমার মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হয়। শত্রুর বুলেট আমার মুখের বামপাশ দিয়ে ঢুকে চোয়ালের দাঁতসহ ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিহ্বার একটি টুকরাও সেই সঙ্গে উড়ে যায়। দলের চিকিৎসকদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়ার পর আমি আরও ভাল চিকিৎসার জন্য চলে যাই ফাদার রিগনের চিকিৎসাকেন্দ্রে। ফাদার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করান। সে সময় আমার চিকিৎসা করতে গিয়ে ফাদার নিজের জীবনের যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তার ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। তখন ওপরে ছিল ঈশ্বর, নিচে ফাদার রিগন।হয়তো তার কাছ থেকে চিকিৎসা সেবাটা না পেলে বাঁচতেই পারতাম না। শুধু আমার নয়, তিনি অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন। তাই ফাদার রিগনও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন সহযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু।’
মুক্তিযুদ্ধে ফাদার রিগানের চিকিৎসার কিছু খন্ডচিত্র
বিপদে প্রকৃত বন্ধু চেনা যায়। মিশন থেকে ছুটির প্রস্তাব আসলে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বলেন-বাঙালির দুঃসময়ে তিনি তাদের পাশে থাকবেন না, তা তো হয় না। তিনি যেন আর সবার মতোই জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষায় লেখা তার দিনলিপিতে উঠে আসে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড চিত্র। অন্যসব ধর্মযাজকের মত তিনি শুধুমাত্র ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেই নিয়োজিত থাকেননি, সেইসাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন শিল্প, সংস্কৃতি আর শিক্ষামূলক বহুমাত্রিক কাজে।
তার হাতেই ইতালিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট, নির্বাচিত কবিতা ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসংখ্য কবিতা। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এদেশের মুক্তিযুদ্ধে, সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাঁকে প্রদান করেছেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য তিনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় পুরগানস্কার ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।
লাল সবুজ পতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় ফাদার রিগানের কফিন
ফাদার রিগান ২০০১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর চিকিৎসার জন্য ইতালি গমন করেন তিনি। রবীশঙ্কর মৈত্রী জানান, ফাদার ম্যারিনো রিগানের শেষ ইচ্ছা ছিল ইতালিতে তার যদি মৃত্যু হলেও মরদেহটি যেন বাংলাদেশে পাঠানো হয়। স্বজনদের কাছে ফাদার রিগানের মিনতি ছিল, 'মৃত্যু হলে আমার লাশটি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও।'
মারিনো রিগানের শেষ ইচ্ছা ছিল খুলনার শেলাবুনিয়ায় সমাহিত হবেন। জীবিত অবস্থায় তিনি বহুবার এ কথা বলেছেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তবে শেষ বেলায় তার কফিন ঢেকে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের লাল সবুজের পাতাকায়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.