ডিভোর্স কেন হচ্ছে?
বর্তমান সময়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ তথা ডিভোর্সের পরিমাণ আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছে। কেউই শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছে না যে, কোনো দম্পতির কখনই ডিভোর্স হবে না। যেকোনো সময় যে কারো ডিভোর্স হতে পারে, জনমনে এ ধরনের একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঢাকায় প্রতি এক ঘন্টায় একটি ডিভোর্সের আবেদন হচ্ছে। এতটাই খারাপ পরিস্থিতি বাংলাদেশের। আসুন জানার চেষ্টা করি কেন হচ্ছে ডিভোর্স?
শারীরিক-মানসিক সমস্যা
যৌন সমস্যা দাম্পত্যে ফাটল ধরায় খুব দ্রুত। শরীরী প্রেম দাম্পত্যের এক বিশেষ চাহিদা। সেই শরীরই যখন নিয়ন্ত্রণ হারায় তখন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রভাবিত হবেই! যৌন চাহিদার পার্থক্য, ইমপোটেন্স, ফ্রিজিডির মতো যৌনসমস্যা নিয়ে চিকিত্সক বা কাউন্সেলরের কাছে যাওয়ার কথা এখনো বেশির ভাগ দম্পতিরই অজানা। ফলে শোবার ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে তৈরি হয় এক তিক্ত, প্রেমহীন পরিবেশ। এই তিক্ততাকে সঙ্গী করেই জীবন কাটিয়ে দেন বেশির ভাগ দম্পতি আর কেউ কেউ আশ্রয় নেন ডিভোর্সের।
পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক কারণ
অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্ত দেখা যায় যে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাথে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারে না পুত্রবধূ বা শাশুড়ি ছেলের ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশি নাক গলাচ্ছেন। বা শাশুড়ি বউমার সাথে ছেলের সামনে এক রকম এবং ছেলের পেছনে আরেক রকম ব্যবহার করেন। এদিকে ছেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা সংসার করাও সম্ভব নয়। আলোচনা করেও যখন সমস্যার সমাধান হয় না, তখন বহু ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স
বাড়ির এক বা একাধিক সদস্য মিলে যখন অন্য কোনো সদস্যের ওপর শারীরিক, মানসিক নির্যাতন চালায়, তখন তাকে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা পারিবারিক অত্যাচার বলা হয়। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন কিন্তু এমনটা মোটেও ভাববেন না যে, পুরুষরা এই পরিস্থিতির আওতার বাইরে। নির্যাতিত ব্যক্তিটিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নানা ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করে অত্যাচারীরা, যার মধ্যে অনেকগুলোই চোখে দেখা যায় না। ভয় দেখিয়ে, গোপন অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলে, অপমানিত করে, লজ্জা দিয়ে, আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে অত্যাচারী সদস্যরা পরিস্থিতিটা এমনভাবে তৈরি করে যে, নির্যাতিত ব্যক্তিটি নিজের অজান্তেই হার মানতে বাধ্য হয়। যারা এর থেকে মুক্তি পাবার জন্য মরিয়া হয়ে যান, তারা দ্বারস্থ হন ডিভোর্সের।
তৃতীয় ব্যক্তি
দাম্পত্যের মতো একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ মানেই বিপদের সংকেত। স্বামী বা স্ত্রীর এক বা একাধিক বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ঘনিষ্ঠতার সীমারেখা ঠিক কোথায়? কেউ জানে না। অথবা বলা যায় একেক দম্পতির ক্ষেত্রে এই অদৃশ্য রেখাটি একেক জায়গায় অবস্থিত। কিন্তু আমরা যতই উদার হই না কেন, নিজেদের ব্যক্তিগত গন্ডির ভেতরে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ কেউই মেনে নিতে পারি না। পরকীয়া সম্পর্কের পেছনে থাকতে পারে নানা কারণ। যেমন পুরনো প্রেম, দাম্পত্যে একঘেয়েমি বা শুধুই সাময়িক মোহ বা ইনফ্যাচুয়েশন।
মনের মিলের অভাব
দাম্পত্যের ক্ষেত্রে মনের মিল এক বিশেষ ধরনের বোঝাপড়া যা স্বামী-স্ত্রীকে কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং তাদের একসাথে থাকার প্রেরণা যুগিয়ে চলে। বেশির ভাগ দম্পতির বৈবাহিক জীবনে ছোটখাট অমিল থাকেই। তাই ঠিক কী কারণে মনের মিলের অভাব ডিভোর্সের মতো বিপদ ডেকে আনে তা বোঝা খুবই দুরূহ। ডিভোর্সের পেছনে এটা খুবই জটিল একটি কারণ।
টিনএজে কিংবা ৩২ বছরের পর বিয়ে করা
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ২৭-৩০ বছরের মধ্যে বিয়ে করেন তাদের দাম্পত্য জীবন তুলনামূলক বেশি মজবুত ও স্থায়ী হয়ে থাকে। অন্যদিকে যারা টিনএজ (১৩-১৯ বছর) বা ৩২+ বয়সে বিয়ে করে তাদের ডিভোর্সের হার বেশি। বিশেষ করে কম বয়সে বিবাহ বন্ধনে যারা আবদ্ধ হয় তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বয়সে বেশি ফারাক থাকলে সেটাও ডিভোর্সের দিকে ঠেলে দেয়। যেসব দম্পতির বয়সের পার্থক্য ১ বছর তাদের ডিভোর্সের হার ৩ শতাংশ। বয়সের পার্থক্যটা পাঁচ বছরে দাঁড়ালে ১৮ শতাংশ এবং ১০ বছর হলে ৩৯ শতাংশ দম্পতির বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে থাকে।
সঙ্গীর প্রতি নেতিবাচক ভাব প্রদর্শন
মনোবিজ্ঞানী জন গটম্যান ডিভোর্সের পেছনে চারটি প্রধান কারণকে দায়ী করেছেন। যে দম্পতিদের মাঝে এই চারটি বিষয় উপস্থিত থাকে, তাদের ডিভোর্স হওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক।
১. সঙ্গীকে ছোট করে দেখা, অবজ্ঞা করা।
২. সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্রের ব্যাপারে লাগাতার সমালোচনা করা।
৩. দাম্পত্য জীবনের কোনো সংকটে বা কঠিন পরিস্থিতে নিজেকে সবসময় নির্যাতিত কিংবা ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করা।
৪. একে অন্যের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া।
বাদানুবাদে নীরবতা পালন
যখন সঙ্গীর সাথে কোনো বিষয়ে আপনার মতের মিল না হয় বা ঝগড়া হয়, তখন সে যদি বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায়, তখন কি আপনি চুপ মেরে যান? ঝামেলা নিয়ে কথা বলতে চান না? তাহলে এটা খারাপ লক্ষণ। ২০১৩ সালে জার্নাল অব ম্যারেজ অ্যান্ড ফ্যামেলিতে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, সমস্যার সমাধান না করে এ ধরনের নীরবতা পালন বা কথা বলতে না চাওয়ার স্বভাবটা দাম্পত্য জীবনকে ডিভোর্সের দিকে ঠেলে দেয়। প্রায় সাড়ে ৩৫০ নব-দম্পতির সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এই তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল।
২০১৪ সালে কমিউনিকেশন মনোগ্রাফ জার্নালে আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যেসব দম্পতির একজন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চেয়ে বিনিময়ে সঙ্গীর কাছ থেকে নীরবতা পায়, তারা দাম্পত্য জীবনে খুব একটা সুখী নয়। গবেষক পল শ্রড বলেন, এটা খুবই কঠিন একটি বিষয়। কারণ স্বামী-স্ত্রী দু’জনই একে অপরকে সৃষ্ট সমস্যার জন্য দায়ী ভেবে থাকেন। একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে নয়, সমস্যার সমাধানের জন্য কে কতটা অবদান রাখার চেষ্টা করছে সেদিকে নজর দেয়া উচিত। পরস্পরের যদি সম্মান ও শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ন রেখে দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার জন্য খোলামেলাভাবে কথা বলা জরুরি।
দাম্পত্য জীবনকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষক গটম্যান ও অন্যান্য গবেষকরা ‘ওরাল হিস্টোরি ইন্টারভিউ’ নামের একটি সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন। সেখানে দম্পতিদেরকে তাদের দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বলতে দেয়া হয়। দম্পতিদের কথা পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করে গবেষকরা ভবিষ্যদ্বাবাণী দিতে সক্ষম হয়েছিলেন কোন কোন দম্পতি ডিভোর্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০০ সালে জার্নাল অব ফ্যামেলি সাইকোলজি-তে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ৯৫ জন নবদম্পতির ‘ওরাল হিস্টোরি ইন্টারভিউ’ নিয়ে সেগুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে কোন কোন দম্পতির বৈবাহিক বন্ধন কতটা মজবুত কিংবা দুর্বল। যেসব বিষয় পর্যালোচনা করা হয়েছে সেগুলো হলো:
১. একে অন্যের প্রতি ভালোলাগা, ভালোবাসার নমুনা।
২. দম্পতিদের মধ্যে কে কে ‘আমরা’ শব্দের উপর বেশি জোর দিচ্ছে। আর কারা বারবার ‘আমি’ বলছে।
৩. একে অন্যের বক্তব্যগুলোকে কতটা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হচ্ছে।
৪. নেতিবাচক কথার পরিমাণ।
৫. বিয়ে বা দাম্পত্য জীবন নিয়ে হতাশা।
৬. কে কে তাদের বিয়েকে ‘ঝামেলা’ হিসেবে বর্ণনা করছে।
পশ্চিমাদের পাশাপাশি বাংলাদেশেও বিগত কয়েক বছরে ডিভোর্স বেড়েছে ভয়াবহ পরিমাণে। ২০১৫ সালে শুধুমাত্র ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনেই ডিভোর্স কার্যকর হয়েছে মোট ৩,৫৩০টি!
পারিবারিকভাবে হোক বা প্রেম করে- উভয় ক্ষেত্রেই ডিভোর্সের পরিমাণ আশঙ্কাজনক। রেস্টুরেন্টে বসে কয়েক ঘণ্টার প্রেমালাপ বা সপ্তাহে দু’দিন ঘোরাঘুরি করা আর বিয়ের পর এক ছাদের নিচে থাকার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। যতই পূর্ব পরিচিত হোক না কেন, বিয়ের পরই একজন মানুষকে গভীরভাবে চেনা যায়। দাম্পত্য জীবনে যারা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, সঙ্গীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তারা সুখী হতে পারে না। অন্যদিকে পারিবারিকভাবে হওয়া বিয়ের ক্ষেত্রে দু’জন অপরিচিত মানুষের স্বভাবগত পার্থক্যের পাশাপাশি পূর্বের প্রেমের সম্পর্ক, সত্য গোপন করা, সন্দেহ প্রবণতা, বোঝাপড়ার অভাব, অনীহা কিংবা ভয়ের কারণে শারীরিক সম্পর্ক উপভোগ না করা বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.