আমরা বুঝতেও পারি না আমাদের ত্যাগের কোরবানি কিভাবে নিছক ভোগসর্বস্ব উৎসবে পরিনত হয়!
"তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দাও" মুসলিম সম্প্রদায়ের কোরবানি সংক্রান্ত সমসাময়িক বহুল উচ্চারিত ইতিহাস বয়ান করে পাঠকের বিরক্তির কারণ হবো না। তবে বর্তমান সমাজের কোরবানি দানের পদ্দতি বিষয়ে কিছু কথা বলার তাগিদ থেকে লিখতে শুরু করলাম। লেখার শুরুতে তুলে ধরা উদ্ধৃতিটিতে বলা হয়েছে- "তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দাও"। প্রচলিত অর্থে আমরা প্রিয় বস্তু বলতে কোরবানির পশুটিকেই বুঝি। এটা একটা মস্ত ভুল! কোরবানির দিন কয়েক আগে কিংবা ঠিক আগের রাতে বাজার থেকে কিনে আনা অন্যের খামারে বড় হওয়া গরুটি আপনার প্রিয় বস্তু কিভাবে হলো? পশু কেনা থেকে পশুর গলায় ছুরি চালানোর মধ্যেকার আপনার শ্রম, সময়, অর্থ, কেনা পশু এই সবগুলো উপকরনের মধ্যে আপনার প্রিয় কোনটি? নিঃসন্দেহ আপনার 'অর্থ'। আপনি সারা বছর খেটে তিল তিল করে জমানো উপার্জিত অর্থ দিয়ে কোরবানির পশুটি কিনছেন। "তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুর কোরবানি দাও" এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার প্রিয় বস্তু আপনার 'টাকা'! আদত আপনার কোরবানিও সেটা। পশুটা একটা মাধ্যম, একটা উপলক্ষ্য মাত্র।
শুধু পশু জবাই করাটাই যে কোরবানি নয়, পবিত্র কোরআনের সুরা হাজ্জের নিম্নবর্তী আয়াতটিও সে কথাই প্রমাণ করে।
لَن يَنالَ اللَّهَ لُحومُها وَلا دِماؤُها وَلٰكِن يَنالُهُ التَّقوىٰ مِنكُم ۚ كَذٰلِكَ سَخَّرَها لَكُم لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلىٰ ما هَدىٰكُم ۗ وَبَشِّرِ المُحسِنينَ
অর্থাৎ, এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। (.....)
কোরবানির সময়টা ইলেক্টনিক কোম্পানিগুলোর ফ্রীজ বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায়। গরমকাল যেমন তাদের বৈদ্যুতিক পাখা বেচার মৌসম, কোরবানির ঈদও তেমনি ফ্রীজ বেচার মৌসম। কারণ কোরবানির গোস্ত মজুদ করতে ফ্রীজের প্রয়োজন অপরিহার্য। বেচাও হয় প্রচুর। বিষয়টা কোরবানির শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে তাঁর উদ্দেশ্য কোরবানি দিই। আর কোরবানিকৃত পশুর গোস্ত ফ্রীজে ঢুকিয়ে মজুদ করি। যেখানে উৎসর্গকৃত পশুর গোস্তের এক তৃতীয়াংশ নিজের জন্য আর দুই তৃতীয়াংশই বন্টন করে দিতে হয় আত্মীয় এবং দুস্থ-দরিদ্রের মাঝে। কি আশ্চর্য! বাজার থেকে পশু কিনে এনে, জবাই করে নিজেই প্রায় পুরো পশুর গোস্ত ভোগ করাটাকে আমরা কোরবানি বলে চালিয়ে দিই। এদেশের মানুষের ধর্ম পালনের পদ্দতিতেই আছে বড় ধরনের অধর্ম!
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতে গিয়ে দেখলাম বাসার নিচে বিশাল সাইজের একটা গরু বাঁধা। গরুটিকে ঘিরে কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চার উচ্ছাসের শেষ নেই। ওদের কথা শুনে বুঝলাম এটা তাদেরই কোরবানির গরু। খেয়াল করলাম ক্ষানিকটা দুরে বছর সাতেকের একটা মেয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। চুপচাপ বসে দেখছে গরুটিকে ঘিরে তারই বয়সি অন্য বাচ্চাদের আনন্দ উচ্ছাস। পাটকাঠির মত স্বাস্থ। রোগক্লিষ্ট শীর্ন দেহ। রুক্ষ চুল। নোংরা জ্বীর্ন আর শত ছিন্ন একটা ফ্রক পরা। কৌতুহলবশত আমি চলার গতি কিছুটা শ্লথ করে দিলাম। খেয়াল করলাম মেয়েটি ভয়ে ভয়ে গরু নিয়ে খেলারত বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করছে "এটা কি তোমাদের গরু? যাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে তাদের হাসি উচ্ছাসের নিচে চাপা পরে প্রশ্নটি কারো কানেই পৌছলো না, কিন্তু আমার বুকের গভীরে তীরের ফলার মত এসে বিঁধলো।
মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে দুটি ঈদ নিঃসন্দেহে নিস্কন্টক আনন্দের উপলক্ষ। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ভুলে এই দিন সকল মুসলমান এক কাতারে শামিল হবে এটাই ঈদের শিক্ষা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় বিষয়টি নিছক পূথিগত। প্রকৃতার্থে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যকার ফাড়াকটা ঈদের দিনে আরো দৃশ্যমান আরো প্রকট, সুষ্পষ্ট এবং সুতীব্র হয়ে উঠে।
অবস্থা সম্পন্ন বাবাটি যখন তার সন্তান কে নতুন জামা কাপড় বানিয়ে দেয়, ঘরময় যখন বাহারি রকমের সুস্বাদু খাবারের গন্ধ মৌ মৌ করে তখন পাশের বস্তির গরীব বাবার অবুঝ সন্তানটি বুঝে উঠতে পরে না 'তারাও তো মুসলমান, নামায পড়ে, রোজা রাখে' তারপরও কেন তাদের নতুন জামা তো দুরে থাক পুরোনো জামাটি ধুয়ে ইস্ত্রি করে পরার স্বামর্থও জুটে না! বোবা দৃষ্টি নিয়ে সে তখন হয়তো বস্তির ভাঁঙা চালের ফুটো দিয়ে অসীম আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। তার ছোট্ট বুকে জমতে থাকে চোপ চোপ অভিমানের পারদ। সেই অভিমান কতকটা এই সমাজের বিত্তবান মানুষের উপর, ক্ষানিকটা তার সৃষ্টিকর্তার প্রতিও।
সারা বছর না হোক অন্তত ঈদের দিনই গরীব মানুষ বুঝতে পারে তারা কতটা গরীব! তাদের জন্ম হয়েছে ঈদের দিন ধনীর দালান বাড়ির কার্নিশ ঘেঁষে আসা সুগন্ধি খাবারের ঘ্রাণ নেয়ার জন্য। এঁটো থালা বাসন ধুয়ে গত রাতের উচ্ছিষ্ট খাবারটা পাওয়ার জন্য। কোরবানির পশুর ভূড়ি পরিস্কার করে দিয়ে কয়েক টুকরা মাংশ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার জন্য। 'তবে কি তারা সৃষ্টিকর্তার কাছেও অবহেলিত ? বৈশম্যের এই প্রাগৈতিহাসিক যন্ত্রনায় ভোগ করতে করতে যদি কখনো এই ভাগ্যাহত মানুষ গুলোর মনে এই প্রশ্ন উদিত হয় তবে সমাজের মানুষের কাছে অনুরোধ বিনা বিচারে তাদেরকে অবিশ্বাসি দের কাতারে দন্ডায়মান করবেন না।
শুধু পশু জবাই করাই কোরবানি নয়। কষ্টপার্জিত টাকায় কেনা কোরবানির পশুর মাংশ সমাজের দুস্থ দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়াই কোরবানি। এই সত্যটা এখন শুধু হাদিস গ্রন্থের মধ্যেই আটকা পড়ে আছে। মুসলমান সমাজে ধর্মের এই বিধানের শিকি ভাগও প্রয়োগ নেই। কোরবানির দিন মাংশ প্রত্যাশিদের কয়েক টুকরা মাংশ দেয়া হয়, যার চার আনা চর্বি আর বার আনাই হাঁড়। দান বা বন্টন বলতে এটাই। আমরা বুঝতেও পারি না আমাদের ত্যাগের কোরবানি কিভাবে নিছক ভোগসর্বস্ব উৎসবে পরিনত হয়!
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
শুধু পশু জবাই করাটাই যে কোরবানি নয়, পবিত্র কোরআনের সুরা হাজ্জের নিম্নবর্তী আয়াতটিও সে কথাই প্রমাণ করে।
لَن يَنالَ اللَّهَ لُحومُها وَلا دِماؤُها وَلٰكِن يَنالُهُ التَّقوىٰ مِنكُم ۚ كَذٰلِكَ سَخَّرَها لَكُم لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلىٰ ما هَدىٰكُم ۗ وَبَشِّرِ المُحسِنينَ
অর্থাৎ, এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। (.....)
কোরবানির সময়টা ইলেক্টনিক কোম্পানিগুলোর ফ্রীজ বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায়। গরমকাল যেমন তাদের বৈদ্যুতিক পাখা বেচার মৌসম, কোরবানির ঈদও তেমনি ফ্রীজ বেচার মৌসম। কারণ কোরবানির গোস্ত মজুদ করতে ফ্রীজের প্রয়োজন অপরিহার্য। বেচাও হয় প্রচুর। বিষয়টা কোরবানির শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে তাঁর উদ্দেশ্য কোরবানি দিই। আর কোরবানিকৃত পশুর গোস্ত ফ্রীজে ঢুকিয়ে মজুদ করি। যেখানে উৎসর্গকৃত পশুর গোস্তের এক তৃতীয়াংশ নিজের জন্য আর দুই তৃতীয়াংশই বন্টন করে দিতে হয় আত্মীয় এবং দুস্থ-দরিদ্রের মাঝে। কি আশ্চর্য! বাজার থেকে পশু কিনে এনে, জবাই করে নিজেই প্রায় পুরো পশুর গোস্ত ভোগ করাটাকে আমরা কোরবানি বলে চালিয়ে দিই। এদেশের মানুষের ধর্ম পালনের পদ্দতিতেই আছে বড় ধরনের অধর্ম!
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতে গিয়ে দেখলাম বাসার নিচে বিশাল সাইজের একটা গরু বাঁধা। গরুটিকে ঘিরে কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চার উচ্ছাসের শেষ নেই। ওদের কথা শুনে বুঝলাম এটা তাদেরই কোরবানির গরু। খেয়াল করলাম ক্ষানিকটা দুরে বছর সাতেকের একটা মেয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। চুপচাপ বসে দেখছে গরুটিকে ঘিরে তারই বয়সি অন্য বাচ্চাদের আনন্দ উচ্ছাস। পাটকাঠির মত স্বাস্থ। রোগক্লিষ্ট শীর্ন দেহ। রুক্ষ চুল। নোংরা জ্বীর্ন আর শত ছিন্ন একটা ফ্রক পরা। কৌতুহলবশত আমি চলার গতি কিছুটা শ্লথ করে দিলাম। খেয়াল করলাম মেয়েটি ভয়ে ভয়ে গরু নিয়ে খেলারত বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করছে "এটা কি তোমাদের গরু? যাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে তাদের হাসি উচ্ছাসের নিচে চাপা পরে প্রশ্নটি কারো কানেই পৌছলো না, কিন্তু আমার বুকের গভীরে তীরের ফলার মত এসে বিঁধলো।
মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে দুটি ঈদ নিঃসন্দেহে নিস্কন্টক আনন্দের উপলক্ষ। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ভুলে এই দিন সকল মুসলমান এক কাতারে শামিল হবে এটাই ঈদের শিক্ষা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় বিষয়টি নিছক পূথিগত। প্রকৃতার্থে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যকার ফাড়াকটা ঈদের দিনে আরো দৃশ্যমান আরো প্রকট, সুষ্পষ্ট এবং সুতীব্র হয়ে উঠে।
অবস্থা সম্পন্ন বাবাটি যখন তার সন্তান কে নতুন জামা কাপড় বানিয়ে দেয়, ঘরময় যখন বাহারি রকমের সুস্বাদু খাবারের গন্ধ মৌ মৌ করে তখন পাশের বস্তির গরীব বাবার অবুঝ সন্তানটি বুঝে উঠতে পরে না 'তারাও তো মুসলমান, নামায পড়ে, রোজা রাখে' তারপরও কেন তাদের নতুন জামা তো দুরে থাক পুরোনো জামাটি ধুয়ে ইস্ত্রি করে পরার স্বামর্থও জুটে না! বোবা দৃষ্টি নিয়ে সে তখন হয়তো বস্তির ভাঁঙা চালের ফুটো দিয়ে অসীম আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। তার ছোট্ট বুকে জমতে থাকে চোপ চোপ অভিমানের পারদ। সেই অভিমান কতকটা এই সমাজের বিত্তবান মানুষের উপর, ক্ষানিকটা তার সৃষ্টিকর্তার প্রতিও।
সারা বছর না হোক অন্তত ঈদের দিনই গরীব মানুষ বুঝতে পারে তারা কতটা গরীব! তাদের জন্ম হয়েছে ঈদের দিন ধনীর দালান বাড়ির কার্নিশ ঘেঁষে আসা সুগন্ধি খাবারের ঘ্রাণ নেয়ার জন্য। এঁটো থালা বাসন ধুয়ে গত রাতের উচ্ছিষ্ট খাবারটা পাওয়ার জন্য। কোরবানির পশুর ভূড়ি পরিস্কার করে দিয়ে কয়েক টুকরা মাংশ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার জন্য। 'তবে কি তারা সৃষ্টিকর্তার কাছেও অবহেলিত ? বৈশম্যের এই প্রাগৈতিহাসিক যন্ত্রনায় ভোগ করতে করতে যদি কখনো এই ভাগ্যাহত মানুষ গুলোর মনে এই প্রশ্ন উদিত হয় তবে সমাজের মানুষের কাছে অনুরোধ বিনা বিচারে তাদেরকে অবিশ্বাসি দের কাতারে দন্ডায়মান করবেন না।
শুধু পশু জবাই করাই কোরবানি নয়। কষ্টপার্জিত টাকায় কেনা কোরবানির পশুর মাংশ সমাজের দুস্থ দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়াই কোরবানি। এই সত্যটা এখন শুধু হাদিস গ্রন্থের মধ্যেই আটকা পড়ে আছে। মুসলমান সমাজে ধর্মের এই বিধানের শিকি ভাগও প্রয়োগ নেই। কোরবানির দিন মাংশ প্রত্যাশিদের কয়েক টুকরা মাংশ দেয়া হয়, যার চার আনা চর্বি আর বার আনাই হাঁড়। দান বা বন্টন বলতে এটাই। আমরা বুঝতেও পারি না আমাদের ত্যাগের কোরবানি কিভাবে নিছক ভোগসর্বস্ব উৎসবে পরিনত হয়!
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.