রমজান কাদিরভঃ অন্যরকম এক নেতা

বর্তমান সময়ে আলোচিত একটি নাম রমজান কাদিরভ। মিশরের জনপ্রিয় ফুটবলার সালাহকে সম্প্রতি তিনি চেচনিয়ার নাগরিকত্ব দেন। রমজান কাদিরভ চেচনিয়া রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি। বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী এই নেতা ২০০৭ থেকে চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। অথচ তিনি শুরুতে স্বাধীনতাকামী গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। তার ভাষায় তিনি চেচনিয়ার স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য কেন্দ্র সরকার মস্কোর আনুগত্য করেন। তিনি আরো বলেন এই স্বাধীনতা আমাদের বহুভাবে পিছিয়ে দিয়েছে, অনেক রক্ত ঝরিয়েছে। আমরা এর অবসান চাই। আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আমরা এখন স্বাধীনতা চাই না।
তার জন্ম ১৯৭৬ সালের ৫ অক্টোবর। প্রথম জীবনে চেচনিয়ার স্বাধীনতার জন্য গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার পিতা আহমেদ কাদিরভও ছিলেন একজন গেরিলা নেতা। পরবর্তীকালে তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ৯ মে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। পিতার মৃত্যুর পর রমজান কাদিরভ প্রথমে চেচনিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী, পরে প্রধানমন্ত্রী এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি মনোনীত হন।
স্কুলজীবনেই রমজান কাদিরভের শৌর্যবীর্যের প্রকাশ ঘটতে থাকে। খেলাধুলায় তিনি ছিলেন এক নম্বর। বিশেষ করে কুস্তি ও বক্সিংয়ে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। যুবক বয়সে তিনি একবার বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মাইক টাইসনের সাথেও লড়েছিলেন। বিচিত্র ও খেয়ালি চরিত্রের কারণে তার প্রতি মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই। কথিত আছে, তিনি একবার চেচনিয়ায় তার এক আত্মীয়ের বিয়েতে পাঁচ কেজি ওজনের সোনার গয়না উপহার দিয়েছিলেন। তিনি বাঘ, কুমির, সাপ এসব ভয়ঙ্কর প্রাণী পোষেন। তার পোষা একটি অজগর তার প্রাসাদে সব সময় ছাড়াই থাকে। ওই অজগর সাথে নিয়ে তার অনেক ছবি বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে তার অনুসারীর সংখ্যা কয়েক লাখ।
তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা গুজব ছড়ায়। ২০০৪ সালের এপ্রিলে একবার খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, রমজান কাদিরভ তার বডিগার্ডের গুলিতে নিহত হয়েছেন। কিন্তু পরে ওই খবর মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং পরের মাসেই তিনি চেচনিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে তার রয়েছে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। প্রেসিডেন্ট পুতিনই তাকে চেচনিয়ার নেতা মনোনীত করেছেন।
২০০৬ সালের ১ মার্চ চেচনিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সার্গেই আব্রামভ পদত্যাগ করলে রমজান কাদিরভকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি অধ্যাদেশে পুতিন চেচনিয়ার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে আখলানভকে সরিয়ে কাদিরভকে মনোনয়ন দেন। পরে চেচনিয়ার পার্লামেন্ট তা অনুমোদন করে।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কাদিরভের কর্মকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর এক ভাষণে তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আজ থেকে চেচনিয়ায় অতীত। তিনি গেরিলা যুদ্ধের অবসানেরও ঘোষণা দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত চেচনিয়াকে পুনর্গঠন ও দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। উইকিলিকস ও কয়েকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ তোলা হয়। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার জাতীয় রাজনীতিতে চেচেন নেতা রমজান কাদিরভের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
এ মুহূর্তে যদি রাশিয়ায় জরিপ চালানো হয়, বর্তমানে দেশটিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মিডিয়াব্যক্তিত্ব কে বা দেশটির সবচেয়ে সক্রিয় রাজনীতিবিদের নাম কী? তাহলে রমজান কাদিরভের নাম প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশিয়ার প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে প্রতিদিনই তার নাম ও ছবি জ্বলজ্বল করে। প্রতি মাসেই তার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আসলে কাদিরভের কথাবার্তা, বক্তৃতা-বিবৃতি বা কর্মকাণ্ড যাই বলি না কেন, সব কিছুতেই সংবাদ হওয়ার মতো কিছু না কিছু খোরাক থাকে। তাই সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে। গ্রোজনির বিশাল জনসভায় তার ‘আই অ্যাম নট চার্লি’ বক্তব্য তো এখন একটি স্লোগানে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া বিরোধী রাজনীতিবিদ বরিস নেমতোসভের হত্যার বিচার দাবি, প্রতিবেশী অঞ্চলের সাথে বৈরিতার অবসানের দাবি এবং সন্ত্রাসবাদে জড়িতদের আত্মীয়স্বজনকেও বিচারের আওতায় আনার বিতর্কিত দাবি তাকে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে।
অতি সম্প্রতি চেচেন এই নেতা রাশিয়ার বিরোধী দল সম্পর্কে সোচ্চার হয়েছেন। বিরোধী নেতাদের তিনি ‘জনগণের শত্রু’ বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি। তার এ বক্তব্যকে অনেকে ‘স্ট্যালিন আমলের কথা’ স্মরণ করিয়ে দেয়ার সাথে তুলনা করেছেন। এ নিয়ে শুধু মিডিয়া নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পক্ষে-বিপক্ষে কথার লড়াই শুরু হয়েছে। সমালোচকদের বক্তব্য হচ্ছে, স্ট্যালিন আমলে যেমন সরকারের কোনো কাজের, বিশেষত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সমালোচনাকে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হতো, বিরোধী দলের নেতাদের সম্পর্কে রমজান কাদিরভের সাম্প্রতিক বক্তব্যও অনেকটা সে রকমই মনে হচ্ছে। সরকারের বিরোধিতা করা মানেই যেন জাতীয় স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা।
চেচনিয়ার দায়িত্ব পাওয়ার পর কাদিরভের কিছু কর্মকাণ্ড বিশেষ করে বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনে কঠোরতা আলোচনায় উঠে আসে। তার এসব কর্মকাণ্ডের প্রতি ক্রেমলিনের উদাসীনতা নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। সবাই আশা করছিল, ক্রেমলিন তাকে থামানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু তা না হওয়ায় তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বাড়তেই থাকে। এতে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের দূরত্ব বাড়তেই থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যে তিনটি ঘটনায় পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিরোধ দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে এই চেচনিয়া একটি। অন্য দু’টি হচ্ছে কিয়েভ আর ইউক্রেনের দ্বন্দ্ব।
চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার জন্য কাদিরভ যতই পুতিনের বাহবা পান না কেন, চেচনিয়ার স্বাধীনতাকামীরা কিন্তু থেমে নেই। এর মধ্যে কয়েক দফা চেষ্টা হয়েছে রমজান কাদিরভকে হত্যা করার। কিন্তু প্রতিবারই তিনি কোনো না কোনোভাবে বেঁচে গেছেন।
নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে গত প্রায় এক দশক তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। চেচনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে অনেক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এখন চেচনিয়াই একমাত্র রিপাবলিক স্টেট, যারা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে আছে।
এটি সম্ভব হয়েছে পুতিনের সাথে রমজান কাদিরভের সখ্যের কারণে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর রাশিয়ার শাসকেরা চেচনিয়া সম্পর্কে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। একে আয়ত্তে রাখতে দুই দফা সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াতে হয়েছে। প্রথম দিকে চেচেন স্বাধীনতাকামীরা তাদের ভূখণ্ড থেকে রুশ সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়েছে। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি দেশের নাগরিক হতে চেয়েছে। কিন্তু মস্কো তা মেনে নেয়নি। কঠোর হাতে ‘বিদ্রোহী’দের দমনের পথে গেছে। বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে সর্বাত্মক অভিযান চালিয়েছে। ২০০২-০৩ সালের দিকে বিদ্রোহীদের একটি অংশ সরকারের সাথে আলোচনায় সম্মত হয়। সেই থেকে চেচনিয়ায় মস্কোর পছন্দমতো সরকার পরিচালিত হয়ে আসছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.