পপগুরু আজম খান, সালাম তোমায়

আজ ৫ জুন। পপগুরু, পপসম্রাট আজন খানের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের আজকের এই দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কয়েক দশক তরুণদের বিনোদনের মূল খোরাক ছিল আজম খানের পপ সংগীত৷ মানুষের মনের কোঠায় তিনি পপগুরু বা পপসম্রাট হিসেবেই জায়গা করে নিয়েছেন৷ তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক৷ বাংলাদেশে পপ সংগীতের অন্যতম পথপ্রদর্শক তিনি৷ তার পপ আঙ্গিকের সংগীত বাংলাদেশের যুব সমাজের কাছে পেয়েছে বিপুল সমাদর৷ শুধু বাংলাদেশেই নয় গোটা উপ মহাদেশেও আজম খান পেয়েছেন অসাধারণ জনপ্রিয়তা৷
আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আজিমপুরের এক সরকারি কোয়ার্টারে৷ তার আসল নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান৷ স্কুল শিক্ষার পর ১৯৭০ সালে ঢাকার টি.এন.টি কলেজ থেকে স্নাতক লাভ করেন৷ বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সরকারের সচিবালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা; মা জোবেদা বেগম একজন সংগীত শিল্পী। জন্ম- জীবনকাল- যুদ্ধ- কাজ- মৃত্যু সবমিলিয়ে তিনি পুরো জীবনটাই ঢাকায় কাটিয়েছেন।
শৈশব থেকেই আজম খানের সংগীতের প্রতি অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। নিজ আগ্রহ ও মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি নিয়মিত সংগীতচর্চা অব্যাহত রাখেন। তিনি ছিলেন ক্রান্তি শিল্পিগোষ্ঠীর একজন সদস্য। উক্ত শিল্পিগোষ্ঠীর সদস্যরূপে তিনি পাকিস্তানি শোষণকে বিষয় করে গণসংগীত গেয়ে গণআন্দোলনকে বেগবান করতে ভূমিকা রাখেন। সত্তরের প্রথমার্ধে বংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় তাঁর প্রথম কনসার্ট৷ তার পর থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশ জুড়ে৷ ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা পপ সংগীতের এক প্রবাদ পুরুষ৷

আজম খানের ব্যান্ডদল
স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে হলিউড থেকে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে বেস্ট পপ সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২, কোকাকোলা গোল্ড বোটলসহ লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, কাউন্সিল অব আরবান গেরিলা ঢাকা ’৭১ ও রেডিও টুডের পক্ষ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা লাভ করেন। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে ৫ জুন ২০১১ সালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
সঙ্গীত জীবন
আজম খানের কর্মজীবনের শুরু ষাটের দশকের একবারে শুরুতে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সালের পর লাকী আখন্দ, হ্যাপী আখন্দ, নিলু, মনসুর এবং সাদেককে নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল উচ্চারণ।

১৯৭২ সালে বিটিভিতে এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে ও চার কালেমা সাক্ষী দেবে গান দু’টি সরাসরি প্রচার হলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে রেললাইনের ঐ বস্তিতে শিরোনামের গান গেয়ে সারা দেশ ব্যাপী হৈ-চৈ ফেলে দেন আজম খান। ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং পিলু মমতাজের এর সাথেও বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তিনি। বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান জীবনে কিছু পাবোনা। বাংলা গানের ইতিহাসে এটিই প্রথম হার্ডরক সংগীত বলে বিবেচিত।

একাত্তরে মাত্র ২১ বছর বয়সে যুদ্ধে অংশ নেন আজম খান৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মূখ সমরে অংশ নেন। সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত “অপারেশান তিতাস” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপারেশনের লক্ষ্য ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান রুপসী বাংলা হোটেল) এবং হোটেল পূর্বাণীর গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তার এই অপারেশনের ফলে ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা বুঝতে পারে এ দেশে একটা যুদ্ধ চলছে।এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন। যা পরবর্তীতে তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়।
আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন। যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্বও পান। যুদ্ধের মাঠেও থেমে থাকেনি তার সংগীত সাধনা। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো।
পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয় সংযোজন আজম খান বাংলা পপ গানের জগতে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভুত হন। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং অসাধারণ জনপ্রিয় এই নতুন ধারার গানের স্রষ্টা হিসেবে শ্রোতাদের নিকট তিনি পপগুরু, পপসম্রাট প্রভৃতি নামে নন্দিত হন। ১৯৮২ সালে এক যুগ নামে তাঁর প্রথম অডিও ক্যাসেট বের হয়। তাঁর একক অ্যালবাম সংখ্যা ১৭ এবং দ্বৈত ও মিশ্র অ্যালবাম ২৫টির অধিক। বিশ্বের বেশ ক’টি দেশে কনসার্ট পরিবেশন করেন আজম খান৷ এসব কনসার্টে শুধু প্রবাসী বাঙালিই নয় বহু বিদেশী সংগীতানূরাগীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি৷ বাংলা সংগীতের নানা ধারার গান পপ আঙ্গিকে গেয়েছেন আজম৷তার ১৭ টিরও বেশি হিট গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে বাজারে, কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ১ টি