বজ্রদুর্যোগ: বাংলাদেশের নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বজ্রপাত প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য গুলোর মধ্যে একটি। এটি মানুষের পরিচিত সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটিও বটে। সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার প্রায় সমান মাত্রার স্ফুলিঙ্গ আর ভয়াবহ গর্জন বহুকাল ধরেই মানুষের পিলে চমকানোর কাজটি দায়িত্বের সাথে পালন করে আসছে। বাংলাদেশে ইদানিং বজ্রপাত একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটা শুধু এখন আর ভয় দেখায় না। সাক্ষাত মেরে ফেলে। বাংলাদেশে এটা এখন একটি দুর্যোগের নাম। নতুন এই দুর্যোগের নাম বজ্রদুর্যোগ। ২০১০ সাল থেকে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৯ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২ হাজারেরও বেশি। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। যে সংখ্যা ৯শ’ ৯৬ জন। ২০১৫ সাল থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
আবহাওয়া অফিসের এক হিসাবে দেখা যায় গত আট বছরে (২০১০ থেকে ২০১৭) পর্যন্ত বজ্রপাতে যত মৃত্যু হয়েছে তার ৩৩ শতাংশই হয়েছে মে মাসে। ২০১০ সালের ১৭ মে বজ্রপাতে মারা যায় ৭ জন। ২০১১ সালের ২২ ও ২৩ মে মারা যায় ৪৫ জন। ২০১২ সালের ২ মে মারা যায় ১৪ জন। ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে মারা যায় ৩২ জন। ২০১৪ সালের ৩০ মে মারা যায় ৮ জন। ২০১৫ সালের ১৬ ও ১৭ মে মারা যায় ৩৩ জন। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মে মারা যায় ৫৭ জন। ২০১৭ সালের ৯ মে মারা যায় ২১ জন। ২০১৮ সালে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটে। চলতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় এপ্রিল মাসের শেষ দুই দিন ২৯ ও ৩০ এপ্রিল। এই দুই দিনে বজ্রপাতে মারা যায় ৩২ জন। চলতি বছর (২০১৮) মে মাসের ২ তারিখে মারা যায় ১০ জন। ৩ মে মারা যায় ২০ জন। ৬ মে মারা যায় ৪ জন। ৮ মে মারা যায় ৮ জন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে সারা দেশে ৫ হাজার ৭৭২টি বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে ২০১১ সালে ৯৭৮, ২০১২ সালে ১ হাজার ২১০, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৪১৫, ২০১৪ সালে ৯৫১ ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ২১৮ বজ্রাঘাত হেনেছে বাংলাদেশে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ফোরাম থেকে সংগৃহীত রিপোর্টে দেখা যায় শুধু গত এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখের মধ্যেই সারা দেশে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে ৪৮ জন। এর মধ্যে শিশু ১৪, নারী ৩ ও পুরুষ ৩১ জন। গত ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭৪ জন। এর মধ্যে শিশু ৫৪, নারী ৩৬ ও ১৮৪ জন পুরুষ। ২০১৪ সালে ৩৯ শিশু, ২৮ নারী ও ১৪৩ পুরুষ মিলিয়ে ২১০, ২০১৩ সালে ৫৫ শিশু, ৫৩ নারী ও ১৭৭ পুরুষসহ ২৮৫ জন মারা যায়। ২০১২ সালে মারা যায় ৩০১ জন, এর মধ্যে রয়েছে ৬১ শিশু, ৫০ নারী ও পুরুষ। ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন, যার মধ্যে ৩১ শিশু, ২৮ নারী ও ১২০ পুরুষ। সংস্থাটির ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের কয়েক বছরের বজ্রপাতের ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের মধ্য অঞ্চল অর্থাৎ ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর অঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চল বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে শীতের আগ পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রচুর জলীয় বাষ্প ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মেঘের ভেতরে যায়। জলীয় বাষ্পের কারণে মেঘের ভেতরে থাকা জলকণা ও বরফ কণার ঘর্ষণের ফলে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। সাধারণত মাটি থেকে আকাশের ৪ মাইল সীমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ এই বজ্রপাতের ছোবলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় যে কোনো প্রাণী। এমনকি গাছের ওপর পড়লেও গাছটি মারা যায় কয়েকদিনের মধ্যেই। আবহাওয়াবিদগণ বলছেন, মৌসুমী বায়ুর আগমনের মাসগুলোতে এপ্রিল মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এই সময়ে আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা বেশি থাকে। বেড়ে যায় ঝড় বৃষ্টি। বজ্রপাত তারই অনুষঙ্গ। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যে বৃষ্টিপাত হয় তাতে বজ্রপাতের সংখ্যা থাকে কম।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বজ্রমেঘ, বজ্রঝড় ও বজ্রপাত কোন একক প্রতিফলন নয়। এটি আবহাওয়ার অনেক উপাদানের সমষ্টিগত ফল। বিশ্বে বজ্রপাত নির্ণয়ের জন্য পরিচালিত গবেষণা কেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লাইটনিং লোকেশন নেটওয়ার্কের এক তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৮শ’রও বেশি। যা ২০১১ সালে ছিল ৯শ’ ৭৮টি। পরবর্তী বছরগুলো থেকেই তা বাড়তে থাকে। একজন আবহাওয়াবিদ জানান, দেশের কিছু জায়গা বজ্রপাত প্রবণ। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ এবং ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ৫০ শতাংশেরও বেশি বজ্রপাত হতে পারে। কয়েকটি দেশের হিসাব কষে এই ফল দেয়া হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয় কঙ্গোয় ভূমি থেকে এক হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতায় কিফুকা পর্বতের এক গ্রামে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে দেড়শ বার। পরবর্তী অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা, উত্তর ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪৫ বার বজ্রপাত হয়। সেই হিসেবে বছরে এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ কোটি বার।
বজ্রপাতের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। অথচ একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্ট বিদ্যুৎ যথেষ্ট। সাধারণত আমরা বাসাবাড়িতে মাত্র ২২০ ভোল্ট ও শিল্প-কারখানায় ১২শ’ ভোল্টের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকি। এছাড়া, জাতীয় গ্রিডে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।
বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সরকার সারাদেশে তাল গাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, থাইল্যান্ড তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যু হার কমিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় মে মাসের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, চলতি বছর ৩ মে পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৩২ লাখ তালবীজ রোপণ করা হয়েছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাল গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে এসব তাল গাছ বড় হয়ে বজ্রপাত ঠেকাতে অন্তত ১৪ বছর সময় লাগবে। এর আগে প্রযুক্তি নির্ভর কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ছবিঃ লাইটেনিং ডিটেক্ট সেন্সর
আবহাওয়া দফতর বজ্রপাতের আগাম সংকেত জানাতে লাইটেনিং ডিটেক্ট সেন্সর বসানোর উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দেশের ৮ স্থানে এই সেন্সর বসানো হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, পটুয়াখালী, নওগাঁর বদলগাছি, খুলনার কয়রা ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় স্থাপিত প্রতিটি সেন্সর থেকে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত মনিটরিং করা যাবে। ঝড় বৃষ্টির সময় কোন জেলার কোন এলাকায় বজ্রপাত হতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে আবহাওয়া বিভাগ। বজ্রপাতের দশ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা এই সংকেত দেয়া যাবে। চলতি বছরের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তি যাত্রা শুরু করবে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.