তেসরা ডিসেম্বরের ইতিকথা
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তেসরা ডিসেম্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদিন যুদ্ধের হাওয়া পাল্টে যায়। ভারত সেদিন সরাসরি হামলা করে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধও তার পরিণতি লাভ করে। এর মাত্র তেরদিনের মাথায় পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পন করে।
১৯৭১ এর ২৭শে এপ্রিলের পর মন্ত্রী পরিষদের একটি জরুরী সভা আহবান করেন ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। উক্ত সভায় নিয়ম বহির্ভুতভাবে ইন্দিরার অনুরোধে যোগ দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ।
সভায় ইন্দিরা গান্ধী সেনা প্রধানকে বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালীদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। তুমি কি করবে করো। পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে যাও তোমার বাহিনী নিয়ে।"
স্যাম মানেকশ উক্ত সভায় জানান তিনি তার জন্য তাৎক্ষনিকভাবে প্রস্তত নন। এবং শীঘ্রই পূর্ব পাকিস্তানে মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হবে। বৃষ্টির মৌসুমে নদী সহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যাবে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারী বর্ষণের সময় বিমানবাহিনীর সহযোগিতা পাবে না। অপরদিকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে তখন ছিল ফসল কাটার মৌসুম। ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযান শুরু করলে পাকিস্তান পশ্চিমা সীমান্তে বিমান আক্রমণ করলে ফসলের ক্ষতি হবে তাদের।
স্যাম মানেকশ উক্ত সভায় সময় চেয়ে নেন তার বাহিনীকে প্রস্তুত করার জন্য। পরবর্তীতে প্রায় তার কাছে জানতে চাওয়া হতো কি পরিমাণ সময় লাগবে তার প্রস্তুতির জন্য। স্যাম জবাবে বলতো, "আমার ছেলেরা পূর্ব পাকিস্তানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যেতেও এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে। আমাকে তো যেতে হবে যুদ্ধ করতে করতে।"
৩রা ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান ভারতের উপর সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন ভারত পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি মিত্র বাহিনী সরাসরি ঢুকে পড়ে ইস্টার্ণ ফ্রন্টে। ১৩দিনের যুদ্ধের মাথায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলে ইন্দিরা গান্ধী স্যাম মানেকশকে প্রশ্ন করেন, "তুমি বলেছিলে তোমার এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে। তা ১৩ দিনে কিভাবে সম্ভব হলো?" স্যাম মানেকশ জবাব দিয়েছিলেন, "১৩ দিনে বেশী ১৪ দিন লাগলেও তো আমাকে আপনিই বার বার প্রশ্ন করতেন।"
এ কথা সত্যি যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সকল রকম সহযোগিতা আমাদের বিজয় তরান্বিত করেছিল। তবে এর আগেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে এগোচ্ছিলেন ঢাকার দিকে।
৩রা ডিসেম্বরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে ভারত পাকিস্তান সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হওয়া ব্যতীত আছে রংপুরে ১২জন পাকিস্তানী সেনা সদস্যের আত্মসমর্পণ, পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে সকল ফ্লাইট বাতিল, সেদিন বিকেলে কলকাতার এক জনসভায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দানকালে ভারতীয় বিমানঘাঁটি এবং রাডার স্টেশনগুলোতে পাকিস্তানী বিমান হামলা, পাকিস্তানী বিমানবাহিনীর ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট এবং শ্রীনগরে হামলা, গোলাম আযমের করাচী পলায়ন।
এছাড়া শুক্রবার ছিল বলে জুমার নামাযের পর ভারতীয় হামলার প্রতিবাদে একটি মিছিল চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে জমায়েত হয় লাল দীঘির ময়দানে। উক্ত জমায়েতে বক্তব্য রাখে কনভেনশন লীগ প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরী, পিডিপির মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, ছাত্রনেতা আবু তাহের প্রমুখ।
তথ্যসূত্রঃ
১) স্যাম মানেকশর সাক্ষাৎকার।
২) স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র।
৩) বিভিন্ন নিউজ আর্কাইভ।
৪) মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, ডিসেম্বরের দিনগুলি - নুরুজ্জামান মানিক।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.