রাজাকার আদেলের সন্তানকে হকি ফেডারেশনে বসিয়েছেন পাপন!
১৪ই আগস্ট, ২০০০ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে পুরোনো ঢাকার আরমানিটোলার এক বাড়ীতে উত্তোলিত হয় পাকিস্তানী পতাকা! শুনতে অদ্ভুত শোনালেও তখন আসলে এই দেশে পাকিস্তানী সমর্থক এতো বেশি ছিল যে এমন হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা জমিনে এতো বড় ধৃষ্টতা মেনে নিতে পারলেন না স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ সভাপতি কামাল হোসেন। তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন, দলীয় কর্মীদের নিয়ে মিছিলও বের করলেন তিনি।
এর ফলে পরদিন দেশের সকল জাতীয় দৈনিক এবং নিউজ চ্যানেলে খবরটি প্রচারিত হলো। চারিদিকে যখন প্রতিবাদের ঝড়, তখন আরমানিটোলার সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো বাড়ীর দুই সন্তান, একজনের নাম জোবায়েদ আদেল এবং অন্যজনের নাম তারেক আদেল। দল-বল নিয়ে তারা প্রতিবেশী কামাল হোসেনের বাড়ি ঢুকে ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করার প্রতিবাদ করার অপরাধে গুলি চালায় কামাল হোসেনের উপর।
ঘটনাস্থলেই নির্মমভাবে নিহত হন কামাল, গুলি করা হয়েছিল তার ভাই নাজির হোসেনের উপরেও, কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে যান। দিনটা ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন আরেক কামাল।
কামাল হোসেনের জায়গায় যদি সেদিন শেখ কামাল থাকতেন, তিনিও ঠিক একইভাবে প্রতিবাদ করতেন! কিন্তু পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রে ও এ দেশীয় বেঈমানদের বুলেটে ২৫ বছর আগে অসময়ে শেখ কামাল চলে গেলেও তার অসমসাহসী প্রতিবাদী রূপটা যেন ভর করেছিল কামাল হোসেনের ভেতরে, দেশপ্রেম অদ্ভুত এক কো-ইন্সিডেন্স তৈরি করেছিল সেদিন, তাই পাকিস্তানী পতাকা ওড়াবার তীব্র প্রতিবাদ করার অপরাধে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন কামাল হোসেন, তাকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে তারেক আদেল।
আসুন এবার জেনে আসা যাক খুনী তারেক আদেল এবং তার ভাই জোবায়েদ আদেলের পরিচয়। এরা দুজন হচ্ছে একাত্তরে পাকিস্তানীদের সহযোগী, গণহত্যাকারী ও গণহত্যায় মদদদাতা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের নাতি। তাদের বাবা জাহাঙ্গীর আদেল মোনায়েম খানের জামাই এবং সেই নির্লজ্জ ও জঘন্য বাস্টার্ড যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনী জিয়ার আমলে ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হয়, এবং তার শ্বশুর কুখ্যাত গণহত্যাকারী দেশদ্রোহী আবদুল মোনায়েম খানকে হত্যা করা ১২ বছর বয়সী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক বীর প্রতীককে স্বাধীন বাংলাদেশে অবর্ণনীয় কষ্ট আর যন্ত্রণা দিয়েছে, তিলে তিলে তার জীবনটা বিষময় করে তুলেছে।
এই জাহাঙ্গীর আদেল ৫০টির বেশী মামলা ঠুকে দেয় মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে, তার উপর চলে অমানুষিক হয়রানি। এক পর্যায়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকারের জামাইয়ের দেওয়া মামলায় জেল খাটতে হয়। ফলে এক পর্যায়ে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ৭৬-এর দিকে তিনি জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চলে যান। দেশে ফেরেন ১৯৮৩ সালে। তখন তিনি ভাটারা এলাকার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপরেও এই জাহাঙ্গীর আদেল তার পিছু ছাড়েনি, সুযোগ পেলেই ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে সে মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হকের।
আরো অদ্ভুত ব্যাপারটা হচ্ছে এই জাহাঙ্গীর আদেল যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা-গণধর্ষণের অপরাধে ফাঁসিতে ঝোলা কুখ্যাত নরপিশাচ রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর চাচাশ্বশুর। সেই জাহাঙ্গীর আদেলের ছেলে তারেক আদেল এবং জোবায়েদ আদেল পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলনের প্রতিবাদ করায় দিনেদুপুরে গুলি করে মেরে ফেলে আওয়ামী লীগের একজন ওয়ার্ড সহ সম্পাদকের, অথচ সবচেয়ে জঘন্য পরিহাস হচ্ছে এরপরেও তাদের কিচ্ছু হয়নি!
হ্যাঁ, ভুল শোনেননি। এতোটাই ক্ষমতাধর এই আদেল পরিবার যে, তারেক আদেল কামাল হোসেনের বুকের বাম পাশে ৮টি গুলি করেছিল, সেটার ব্যালিস্টিক রিপোর্ট এবং চাক্ষুষ স্বাক্ষী থাকার পরেও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াতের দেশদ্রোহী জোট সরকারের আমলে আদালত থেকে তারা বেনিফিট অফ ডাউট লাভ করে, স্বসম্মানে মুক্তি পায়।
ব্যালিস্টিক রিপোর্টে প্রমাণ হয়েছিল যে, জাহাঙ্গীর আদেলের লাইন্সেন্স করা রাইফেলের বাম ব্যারেল দিয়ে আটটি বুলেট বেরিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল কামাল হোসেনের বুক। গুলি চালিয়েছিল তারেক আদেল। এরপর সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া নাজির হোসেন ভাই হত্যার বিচার চালাতে গিয়ে রীতিমত সর্বসান্ত হয়েছেন, মামলার খরচ চালাতে বিক্রি করেছেন দুটো বাড়ী। তবুও আজ ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও ভাই হত্যার বিচার পাননি, আজো তারেক আর জোবায়েদ ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্তবাতাসে।
এবার আপনাদের এই ইতিহাসের আরো স্ট্রেঞ্জার অংশগুলো শোনাবো। অজস্র অর্থ-বিত্তের মালিক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে নির্বাচন করেছিল ধানমন্ডি এলাকা থেকে, তার মত একটা কুখ্যাত দেশদ্রোহী জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছে, এবং তার দুই সন্তান গত কয়েকদিন আগে স্বাধীন বাংলাদেশে হকি ফেডারেশনের সদ্য ঘোষিত অ্যাডহক কমিটিতে।
যে কমিটিতে জায়গা পাননি রফিকুল ইসলাম কামাল, মামুনুল রশীদের মত দেশবরেণ্য হকি লিজেন্ডদের জায়গা হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এতে স্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল দলের সদস্য এবং বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সহ-সভাপতির কোন আপত্তি নেই। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, এখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অনেকেই থাকলেও এখন সেটা নিয়ে আলোচনা করার কোন স্কোপ নাই। কি অদ্ভুত না?
এবার আমাদের এই স্ট্রেঞ্জার ট্রুথের সবচেয়ে স্ট্রেজেস্ট অংশ! কে বানিয়েছে এই কমিটি, জানতে নিশ্চয়ই আপনাদের ভয়ংকর কৌতূহল হচ্ছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এই দায়িত্ব থাকলেও এই কমিটি গঠনের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন বেশ কিছুদিন ধরে জাতীয় হকির দায়িত্ব নেওয়া বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন।
কি, ধাক্কা খেলেন? মেলাতে পারছেন না তো? দেশের ক্রিকেটে নাজমুল হাসান পাপনের ভুমিকা অনস্বীকার্য, খাজা রহমতউল্লাহর মৃত্যুর পর হকিকে নতুন জীবন দান করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি, তাতেও বিন্দুমাত্র প্রশ্ন নেই।
কিন্তু এটা তিনি কি করলেন? যার বাবা জিল্লুর রহমান বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর হিসেবে এই দেশের মুক্তিসংগ্রামে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, মা আইভী রহমান সারাটা জীবন রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে গৌরবজ্জ্বল ছিলেন, এমন অসাধারণ সৎ এবং গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করা দুজন মানুষের সন্তান হিসেবে, স্বাধীন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্টের সন্তান হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির একজন প্রতিনিধি হিসেবে কিভাবে কোন যুক্তিতে তিনি কুখ্যাত রাজাকার ফ্যামিলির দুজন দেশদ্রোহী খুনীকে হকির অ্যাডহক কমিটির সদস্য করলেন?
এর সাথে আরো জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ হকির ফেডারেশনের বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাদেক খান। তিনি নতুন করে নির্বাচনের জন্য তফসিল জারি না করে অনেকটা গায়ের জোরে এই কমিটি তোইরিতে ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের এই কর্মকাণ্ড নতুন প্রজন্মের কাছে কি বার্তা দেবে?
অনেকেই এখানে তার এই কাজকে ডিফেন্ড করতে আসতে পারেন এই বলে যে যেহেতু আদেল পরিবার প্রচণ্ড প্রভাবশালী, সম্পদশালী, শক্তিশালী, তাই হয়তো পাপন মনে করেছেন যে তাদের কমিটিতে রাখলে হকিতে গতিশীলতা আসবে, হয়তো আদেলের পরিবারের পুরো ইতিহাস তাকে কেউ জানায়নি, তাই তিনি এই ভুল করেছেন।
এই যুক্তির বিপরীতে কেবল একটাই কথা থাকে, সেটা হচ্ছে পাকিস্তানেও অনেক সম্পদশালী আছে, এখন কি আমরা হকিরতে গতিশীলতা আনতে পাকিস্তান থেকে তাদের নিয়ে আসবো? যদি উত্তর না হয়, তাহলে কেন একটা চিহ্নিত পাকিস্তানপ্রেমী রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর পরিবার, যারা স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের চাঁদ-তারা পতাকা ওড়ানোর ধৃষ্টতা দেখাতে পারে, আবার এর প্রতিবাদ করলে একজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে নিস্তব্ধ করে দিতে পারে, সেই খুনীদের নতুন করে পুনর্বাসন করার স্পর্ধা দেখাই আমরা?
কিভাবে পাপন সাহেব তার মায়ের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিনিধি হয়ে রাজাকারদের উত্তরসূরীদের পুনর্বাসন করেন? তিনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে তিনি কি করছেন?
মিস্টার পাপন, অনতিবিলম্বে এই অ্যাডহক কমিটি বাতিল ঘোষণা করে নতুন করে নির্বাচনের জন্য তফসিল জারির ব্যবস্থা করুন। ১৮ বছর ধরে ঝুলে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর কামাল হোসেনের হত্যা মামলার বিচারের পথ সুগম করুন। আপনার সকল ভালো কাজ, আপনার রক্ত, অতীত গৌরব এভাবে রাজাকারের উত্তরসূরীদের তোষণ ও পুনর্বাসনে নষ্ট হয়ে যেতে দেবেন না।
আপনার বাবা-মায়ের সম্মান এভাবে মাটিতে মিশিয়ে দেবেন না। প্রধানমন্ত্রী যেখানে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটা স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর আস্থার মানুষ হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানী শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ দিয়ে তার সাথে বেইমানি করবেন না।
আপনার মা আইভী রহমানকে যে গ্রেনেডগুলো দিয়ে পৈশাচিকভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল, সেগুলো কোন দেশ থেকে এসেছিল, সেটা এভাবে ভুলে যাবেন না। তার রক্তের উপর পাড়া দিয়ে মোনায়েম খানের নাতিদের সাথে হাত মেলাবেন না, প্লিজ!
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ২ টি