ভয় ভয়!
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘মহাজীবন’ কবিতায় লিখেছেন- ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ কবির এ বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কেননা পেটে ক্ষুধা থাকলে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ কোনো কিছুই মন ছুঁতে পারে না। সব কিছুকেই নিরস, বিবর্ণ ও গন্ধহীন মনে হয়। মানুষ তখন তার ক্ষুধা নিবৃত্তির উপায় খুঁজে বের করতেই দিনমান পার করে দেয়। জীবনের অন্য কোনো অনুষঙ্গই তখন আর প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় না।
শান্তিপূর্ণ একটি সমাজে জানমালের নিরাপত্তাসহ মানুষ বসবাস করতে চায়। হিংসা-হানাহানি, বিবাদ-বিসংবাদ, মারামারি-কাটাকাটি মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ চায় নির্ভয়ে চলাফেরা করতে, মান-ইজ্জত সহকারে বসবাস করতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এ চাওয়া সব সময় পূরণ হয় না। নানা কারণে সমাজের শান্তি বিনষ্ট হয়; মানুষের জীবন হয়ে ওঠে নিরাপত্তাহীন। সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের কারণে সমাজ হয়ে ওঠে অশান্তিময়।
দেশের অবস্থার কথা বিশদ ব্যাখ্যা করে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। সব দিকে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি বিদ্যমান। স্বস্তির বালাই নেই, আছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। নির্ভয়ে জীবনযাপন এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। একটা শঙ্কা সবাইকে যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে সব সময়, চার দিকের এ ভীতিকর পরিস্থিতির কথাই বলেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। বলেছেন, ‘গোটা দেশ ভয়ের চাদরে ছেয়ে গেছে। সরকার যা ইচ্ছা তাই করছে।’ তিনি বলেছেন, ‘এ সরকার অনির্বাচিত। তাই তাদের জবাবদিহিতা নেই।’
‘ভয়’ দু’টি অক্ষরের একটি ছোট্ট শব্দ। কিন্তু এর তাৎপর্য বিশাল। জীবনে কখনো কোনো কারণে ভয় পায়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে বয়স বা সময়ের ব্যবধানে ভয়ের রকমফের ঘটে। ছোটবেলায় যে বস্তুটিকে মানুষ ভয় পায়, বড় হয়ে সেটাকে আর ভয় পায় না। বিচ্ছু, শুয়াপোকা, তেলাপোকাকে শিশুরা ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু বড় হয়ে ওই প্রাণীগুলোকে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, পায়ে পিষে মেরে ফেলে দ্বিধাহীনচিত্তে। ছেলেবেলায় ভূতের ভয় ছিল না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বড় হওয়ার সাথে সাথে সে ভয় কেটে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে মানুষের ভয় পাওয়া আজীবন থেকে যায়। যেমন- বিষধর সাপকে ছেলে-বুড়ো সবাই ভয় পায় (সাপুড়ে বাদে); ভয় পায় বাঘ, ভালুক, হায়েনা ইত্যাদিকে। আবার মানুষও কিন্তু মানুষকে ভয় পায়। সমাজে এমন কিছু মানুষ সৃষ্টি হয়, যাদেরকে অন্যরা বিভিন্ন কারণে ভয় পায়। ডাকাত, গুণ্ডা, খুনি, ধর্ষক, মাস্তান, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের মানুষ সঙ্গত কারণেই ভয় পায়। নিজের ও পরিবারের জানমাল-ইজ্জত-আব্রুর হেফাজতের জন্য এ শ্রেণীর মানুষ ভয়ের কারণ। শুধু কি ভয় পায়? কখনো কখনো এদের সমীহ করে চলতে হয়। না হলে নানা ধরনের বিপদ ও ঝামেলা জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে। আর সে জন্যই মানুষ অনেক সময় অত্যাচারিত হয়েও মুখ বুজে সব সহ্য করে। প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলে। এর কারণ হলো, ভয় যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন তার সাহস সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। মানুষ যখন দেখে তারা যে লোকটিকে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে, ভয় পায়, সে সমাজের উঁচুতলার মানুষদের সাথে উঠবস করছে, আসন পাচ্ছে মর্যাদার, তখন ওই ভয়ঙ্কর লোকটিকে উঠতে-বসতে সালাম না ঠুকে কোনো উপায় থাকে কি? এর ফলেই সমাজে খারাপ মানুষদের প্রভাব দিনদিন বেড়েই চলেছে।
আর এ বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে মাহমুদুর রহমান মান্নার বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে না। সর্বগ্রাসী একটা ভয় যেন মানুষকে গ্রাস করেছে। নিঃশঙ্কচিত্তে, নির্ভয়ে বসবাস করার দিন যেন ফুরিয়ে গেছে। ঘরে-বাইরে কোথাও নেই নিরাপত্তা।
মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন তো করছেই না, উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মানুষের জীবন অনিরাপদ করে তোলার অভিযোগ প্রতিনিয়তই শোনা যাচ্ছে। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে খুন, গুম, ধর্ষণসহ মারাত্মক অপরাধের খবর। কিন্তু এসবের যেন কোনো প্রতিকার নেই। অপরাধীরা দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়ালেও তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতাও যেন কারো নেই। আর তাদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.