ঊনিশ এর বাংলা ভাষা আন্দোলনঃ এ তো আরেক একুশ!-৩
২৩ এপ্রিল বাংলা ভাষাকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে শিলচরে ছাত্রদের ধর্মঘট ও বিরাট মিছিল বের হল। কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের ১৯ মে’র আসন্ন হরতাল ও পিকেটিং পরিস্থিতি প্রসঙ্গে শিলং-এ রাজ্যপাল জেনারেল শ্রী নাগেশের উপস্থিতিতে ৬ মে আসাম মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হল।
১৪ মে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস হতে কাছাড়কে বিচ্ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে দিল্লিতে কংগ্রেস হাইকমান্ডারের নিকট কাছাড় কংগ্রেসী প্রতিনিধিদলের স্মারকলিপি পেশ করা হল।
১৯ মে শুক্রবার! শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, বদরপুরে ভোর চারটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত হরতাল। ভাষা সংগ্রামীরা নেমে এসেছেন রাজপথে। সবার হাতে হাতে ঐতিহাসিক সংগ্রাম পরিষদের ইশতেহার!- ‘১৯ মে কাছাড়বাসীর সামনে এক অগ্নিপরীক্ষার দিন।
এই দিন প্রমাণ হবে আমরা আমাদের মাকে, মাতৃভাষাকে কতটুকু ভালোবাসি। ভাষা দিয়েই জাতির পরিচয়। ভাষা না থাকলে জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আজ এই সংগ্রাম ভাষা ও ধর্মরক্ষার সংগ্রাম। তাই আহ্বান জানাই, ওরে ভাই এগিয় এসো, তোমার মাতৃকণ্ঠকে অত্যাচারীর হাত থেকে মুক্ত কর, উত্তর পুরুষের ভবিষ্যৎ নির্মল কর।’
শিলচর স্টেশনে প্রথম ট্রেন ছাড়ার কথা ভোর ৫ টা ৪০ মিনিটে। ভাষা সৈনিকেরা নিয়েছেন অবস্থান। একটা ট্রেনও চলবেনা আজ। প্রায় ২ হাজার ভাষা সৈনিক দাঁড়িয়ে গেলেন রেল ইঞ্জিনের সামনে। কিছুক্ষনের মাঝেই সরকারী বাহিনি ঝাপিয়ে পড়ল আন্দোলনকারীদের ওপর। শুরু হল তুমুল নির্যাতন। বুটের লাথি থেকে শুরু করে বন্দুকের বাট দিয়ে পেটানো এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ!
একটুও দমলেননা আন্দোলনকারীরা। ঠায় দখলে রাখলেন রেল লাইন। এসময় তলপেটে লাথির পর লাথি খেয়ে সংজ্ঞা হারাল গৌরী বিশ্বাস, সীতাদে, রজনী মালাকার, দীপালী দে, হারান মণ্ডল, সুবিনয় ধর, বিধান রায় প্রমুখ ভাষা সৈনিক। ততক্ষনে চতুর জেলা পরিষদ নতুন ফন্দি নিয়ে এগুলো। গায়ের জোরে আন্দোলন বন্ধ করা যাচ্ছেনা।
ডিআইজি লাল সাহেব এবং ডেপুটি কমিশনার দোয়ারা আগমন করলেন। অত্যাচার কিছুক্ষণ স্থগিত রইলো। সবাই আশাবাদী! বেলা ১২ টা পর্যন্ত হরতাল সম্পূর্ণ সফল। কোন ট্রেন ছেড়ে যেতে পারেনি। বিক্রি হয়নি টিকেটও।
ঠিক দুপুর ২ টার দিকে স্টেশন রোডে আন্দোলনকারীদের এরেস্ট করে বহনকরা পুলিশের গাড়িতে আগুন লেগে গেলো। শুরু হল বিশৃংখলা। প্রায় ৩ হাজার আন্দোলনকারী একসংগে শ্লোগান তুললেন মাতৃভাষা জিন্দাবাদ। মুহুর্তেই শুরু হল পুলিশি গুলি বর্ষণ।
সাথে সাথে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লেন কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদরঞ্জন দাস, চণ্ডিচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব ও শচীন্দ্র পাল। আত্মদান করলেন বীর ভাষা সৈনিকেরা! আহত হলেন প্রায় ৩০ জনের মত ভাষা সৈনিক।
এই ঘটনায় সারা ভারত জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়া হয় পূর্ব বাংলায়ও (বর্তমান বাংলাদেশ)। ২১ মে শিলচর সহ সমগ্র কাছাড় জেলায় রেলকর্মীরা কর্মবিরতি পালন করেন। শিলংয়ে বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন শোক পালন করে। শোক পালিত হয় জলপাইগুড়িতে।
কলকাতায় তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। শহীদ স্মরণে শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। ২৩ মে গৌহাটি, শিলং, জাফলং, আইজল ও আগরতলায় পালিত হয় প্রতিবাদ দিবস। বিভিন্ন বাম দল সম্মিলিতভাবে ২৪ মে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে পালন করে প্রতিবাদ দিবস। ২৪ মে বরাকের বুকে বিশ হাজার মানুষ আসাম সরকারের বিদ্বেষনীতির বিরুদ্ধে আমরণ আন্দোলনের শপথ নেয়।
২৬ মে ঈদ উৎসবের দিন বরাক উপত্যকার সর্বত্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে হত্যাকাণ্ডের নীরব প্রতিবাদে সামিল হয়। ২৯ মে পালিত হয় ভাষা শহীদ তর্পণ দিবস। শহীদের চিতাভস্ম নিয়ে অজস্র জনতা সামিল হয় মৌনমিছিলে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.