স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ দের কথা- ২
মোহাম্মাদ মোস্তফা কামাল
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে একটি ছেলে রোজ মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে সৈনিকদের অনুশীলন দেখে অবাক হয়। স্বপ্ন বোনে একদিন সেও শৃংখলাপূর্ণ সেনা বাহিনীতে এভাবেই অনুশীলন করবে। সাহসী ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। শিকালের দুরন্ত ও পরাধীনতা না মানা ছেলেটির নামই সিপাহী মোহাম্মাদ মোস্তফা কামাল। বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্ব যাবে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল নামে ডাকে। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি সেনা বাহিনীর একজন হাবিলদার ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন একজন গৃহিনী।
প্রচন্ড দুরন্তপনা মোস্তফা কামালের পড়াশোনার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। সারাক্ষন এখানে সেখানে ছোটাছুটি আর সৈনিকদের মনোরম শৃঙ্খলা দেখে কেটে যায়। ৫ম শ্রেণী পাশ করেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান মোস্তফা কামাল। উদ্দেশ্য বাবার অমতেও সেনাবাহিনীতে যোগদান করা! অবশেষে দূরন্ত কিশোর মোস্তফা সেনাবাহিনীতেই যুক্ত হয়ে গেলেন। অবশেষে ১৯৬৮ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁর চাকুরি চূড়ান্ত হওয়ার পর পিতা-মাতা ছেলের সন্ধান পান৷ এবার মনের মত সেই বাহিনীর জীবনে নিজেকে উজাড় করে দিলান তিনি। চলতে লাগলো মোস্তফা কামালের সৈনিক জীবন। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের কিছু পূর্বে পদন্নতি পেয়ে অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হন মোস্তফা কামাল। কিন্তু রক্তে যার স্বাধীনতা ও মুক্তির নেশা।
রক্তে যার পরাধীনতা মেনে না নেয়ার অদম্য স্পৃহা তাকে শত পদন্নোতি দিয়েও বেধে রাখ যায়না। ২৫ মার্চের কালো রাত্রির জঘন্যতাই মোস্তপফা কামালের শপথ পরিবর্তন করে দিলো। তিনি দিব্য দৃষ্টিতে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার কাতারে দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন মুক্তিযুদ্ধের কোন বিকল্প আর নেই। এদিকে প্রতিটি সামরিক ছাউনিতে বাঙ্গালী সেনা সদস্যদের মাঝে প্রচন্ড ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। এই ক্ষোভ দমনের অজুহাতে রেজিমেন্টগুলোকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘন ঘন বদলি করা হতে লাগলো। যত বদলি করা হল তত জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পেতে লাগলো।
সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালী অফিসারদের ছাড়িয়ে গেলো সাধারন সৈনিকদের ক্ষোভ। এর মাঝেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টক কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা হল। পাকিস্তানি অফিসারদের উদ্দেশ্য এবার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেলো। বিদ্রোহ করে বসলেন মেজর শাফায়েত জামিল। কিছু বাঙ্গালী সদস্যের সহায়তায় ২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অবাঙ্গালি অফিসারদের এরেস্ট করে নিরস্ত্র করে ফেললেন। অন্যদিকে সিলেটে মেজর খালেদ মোশারফ একটি দল নিয়ে বিদ্রোহে যোগ দেন। এবার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় বাঙ্গালীরা অবস্থান গ্রহন করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে থেকে মোস্তফা কামাল সব দেখে এসেছেন। মুহুর্ত বিলম্ব না করে মোস্তফা কামাল যুক্ত হয়ে যান বাঙ্গালী সেনাদের স্বমন্বয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। বাড়ি তখন সদ্য জন্মা শিশুপুত্র, নববিবাহিতা স্ত্রী, বাবা, মা, ভাই, বোন দাদী! সকল মায়া ভুলে দেশের মায়ায় যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন অভিজ্ঞ মোস্তফা কামাল।
১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টার গানশীপ, নেভাল গানবোট ও এফ-৮৬ বিমানযোগে মুক্তিবাহিনীর ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। গঙ্গাসাগর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দরুইন গ্রামে নিয়োজিত আলফা কোম্পানির ২নং প্লাটুনের একজন সেকশন কমান্ডার মোস্তফা কামাল। এই ২ নাম্বার প্লাটুনকেই দরুইন গ্রামের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দ্বায়িত্ব অর্পন করা হয়। মোট ১০ সদস্য নিয়ে গঠিত এই দলটি। ১৮ এপ্রিল তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্গার তৈরি ও অন্যান্য কাজ গুলো সেরে নিচ্ছিলেন। এরই মাঝে সকাল ১১ টায় আকস্মিক হামলা চালালো পাকিস্তানি বাহিনী। তীব্র হামলা। স্থানীয় বাজারে উচু ছাদ দখল করে সেখান থেকে গুলি করতে থাকলো তারা। এরই মাঝে প্রচন্ড বৃষ্টি। বেলা ১২ টার দিকে পশ্চিম দিক থেকে হামলা আরো জোরালো হতে লাগলো। এরই মাঝে মেশিনগান ধারনকারী সদস্যের হাতে এসে গুলি লাগলো। মেশিনগান বন্ধ হতেই সেখানে দৌড়ে গিয়ে মেশিনগানের দ্বায়িত্ব নিলেন মোস্তফা কামাল।
গুলি চালাতে লাগলেন তীব্র বেগে। বৃষ্টির কারনে পাকিস্তানিরা পেছনে সরে যাবে এমন একটি ধারনা ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের মনে। কিন্তু তা না হয়ে পাকিস্তানিরা হামলা বাড়িয়ে দেয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল সামান্য দমে যাচ্ছিলো। কিন্তু দলনেতা মোস্তফা কামালের অদম্য মনোবল ও আক্রমনের ধরন দেখে নতুন উদ্দীপনায় ঝাপিয়ে পড়লেন তারা। সময় গড়াতে লাগলো। এর মাঝে প্রচুর জনবল ও অস্ত্রবলের কারনে পাকিস্তানিরা সামনে এগিয়ে আসতে থাকলো। ধীরে ধীরে পূর্ব্দিক ছাড়া বাকী সকল দিক থেকেই তারা ১০ জনের এই দলটিকে ঘিরে ফেললো। এই মুহুর্তে কৌশল নির্ধারন ছাড়া কোন উপায় নেই। একটি অপশন হল সম্মুখে এগিয়ে যুদ্ধ করতে করতে সকলে শাহাদাত বরন করা আর অন্যটি হল পূর্ব দিক দিয়ে গুলি করতে করতে পেছনে সরে যাওয়া। দ্বিতীয়টি বেছে নেয়া হল। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ব্যাক কাভার।
মোস্তফা কামাল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সঙ্গীদের সরে যেতে বললেন। তিনি ব্যাক কাভার দিয়ে পাকিস্তানিদের অগ্রগতি থামিয়ে রাখবেন। আর এর মাঝে সহযোদ্ধারা সরে পড়বেন নিরাপদে! এ কি করে হয়? দলনেতা থাকবেন ব্যাক কাভারে? কেউ মেনে নিতে রাজি হলনা। মোস্তফাকে সকলেই তাদের সাথে একত্রে সরে আসতে আকুতি জানালেন। কিন্তু মস্তফা সলীয় প্রধান হিসেবে স্বীদ্ধাতে অনড়! এবার মোস্তফা কামাল একাই শত্রুদের দিকে গুলি করতে লাগলেন। শত্রুরা তীব্র গুলির সামনে থমকে দাঁড়ালো। সময় গড়ানোর সাথে সাথে গুলি শেষ হয়ে এলো। হঠাৎ গুলি শেষ হয়ে অস্ত্র গেলো থেমে। শত্রুদের তীব্র গুলির আঘাতে আহত হলেন মোস্তফা কামাল। ফলে প্রতিরোধ বন্ধ হবার সাথে সাথে পাকিস্তানিরা এসে মোস্তফা কামালকে ধরে ফেললো।
বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মনের সকল ঝাল মেটালো পাক বাহিনী! এই একজন মোস্তফা কামাল তাদেরকে আজ ব্যর্থ করে দিলেন। বাচিয়ে রাখলেন মুক্তি বাহিনীর স্বশত্র সদস্যদের! শাহাদাত বরন করলেন নিজে। দরুইন গ্রাম থেকে পশ্চাদপসরণ করে মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চলে যান৷ গঙ্গাসাগর ও দরুইন অধিকার করে একসময় পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে যায়৷ পরবর্তীতে দরুইনের স্থানীয় লোকেরা বুলেটে ঝাঁঝরা, বেয়নেটবিদ্ধ মোস্তফা কামালের লাশ খুঁজে পান৷ সেখানেই তাকে দাফন করা হয়! নিজের জীবন বিলিয়ে কী ভাবে অমর হওয়া যায় তার উৎকৃষ্ট এক উদাহরন সৃষ্টি করে গেলেন সিপাহী মোহাম্মাদ মোস্তফা কামাল।
সূত্রঃ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
বীরশ্রেষ্ঠ,
স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা,
মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধূরী গবেষনা।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.