দেবী দূর্গা
কলকাতার দুর্গাপূজার একটা আলাদা ঐতিহ্য আছে। দুর্গাপূজা মানে কলকাতা। আর কলকাতা মানে দুর্গাপূজা। সেই ঐতিহ্যের ধারা এখনো বহন করে চলেছে শহরটি। প্রতিবছর দুর্গাপূজা আসে। কলকাতা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসে। খুশির বন্যা বয়। কাশফুল ফোটে। শরতের আগমনী বার্তা দেয়। লড়াই হয় পূজায় পূজায়। লড়াই চলে সাবেকি আর আধুনিক থিম পূজার। কলকাতার এ চিত্র দীর্ঘদিনের। কে কত নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে গড়তে পারে পূজামণ্ডপ আর দেবীর প্রতিমা? কে কত চমক দিতে পারে? কে কাকে হারাতে পারে, এই নিয়ে প্রতিযোগিতার লড়াই এখনো চলছে। এবারও সেই প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে ৭ অক্টোবর দেবী দুর্গার মহাষষ্ঠীর দিন থেকে। চলবে পাঁচ দিন।
এই তো গত বছর দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুর্গা প্রতিমা গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই প্রতিমা ঝড় তুলেছিল গোটা পশ্চিমবঙ্গে, তাক লাগিয়ে দিয়েছিল দেশবাসীকে। এত বড় দুর্গা কেউ কোনো দিন দেখেনি। বিশাল মাপের দুর্গা। মা দুর্গার মুখমণ্ডলই ছিল ১২ ফুট লম্বা। ভাবা যায়! পূজা কমিটির সম্পাদক সুদীপ্ত কুমার জানিয়েছিলেন, ৭০ থেকে ৮০ ফুট উঁচু এই দুর্গা প্রতিমা। মণ্ডপ করা হয়েছে ১৬২ ফুট লম্বা ও ৯০ ফুট চওড়ার। দেবীকে দর্শন করার ব্যবস্থা হয়েছিল ৫০ ফুট দূর থেকে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য কলকাতাবাসীর। পূজা শুরুর আগেই কলকাতা পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছিল এই দুর্গা প্রতিমার দর্শন। কারণ, জনপ্লাবন। পূজা শুরুর আগেই জনজোয়ারে ভেসে গিয়েছিল দেশপ্রিয় পার্ক এলাকা। বিশাল যানজটে জেরবার হয়ে গিয়েছিল গোটা দক্ষিণ কলকাতা। আর তার পরেই মানুষের জীবনের নিরাপত্তার দিকটি ভেবে কলকাতা পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছিল ওই পূজা। ফলে পূজার দিনে আর সেই বিশাল দুর্গাকে দেখতে পাননি ভক্তরা। পরে অবশ্য মণ্ডপ থেকে সেই বিশাল মাপের দুর্গা প্রতিমাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। রাখা হয়েছে সংরক্ষিত করে।
এবার সেই দেশপ্রিয় পার্ক পূজা কমিটি আবার তাক লাগানো আর চমক দেওয়ার জন্য তৈরি করেছে এক হাজার হাতের দুর্গা। এই এক হাজার হাতে এক হাজার অস্ত্র। এবার আর দশভুজা নয়; তৈরি হয়েছে সহস্র ভুজা।
আর এই এক হাজার হাতের দুর্গা দেখার জন্য এবারও জনমনে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। শুধু কী তাই, এবারও সেই থিমের যুদ্ধে এগিয়ে গেছে কলকাতা। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব এই শারদীয় দুর্গোৎসব। প্রতিবছরই এই দুর্গোৎসবকে ঘিরে মেতে ওঠে বাঙালিরা। ভারতের যেখানে বাঙালির বাস, সেখানেই দেবী দুর্গার আরাধনা। ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, আসাম, মেঘালয়, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বেঙ্গালুরু—সর্বত্রই যেন চলে এই দেবীর আরাধনা। থিমের লড়াই। কারণ, এসব রাজ্যে রয়েছে প্রচুর বাঙালির বাস।
তাই এবার শুধু দেশপ্রিয় পার্কই নয়; এবার নানান ভাবনা আর নানান সৃষ্টিধর্মী মণ্ডপ এবং প্রতিমা তৈরি হয়েছে কলকাতাজুড়ে। এবারের তেলেঙ্গানা বাগান পূজা কমিটি থিম করেছে বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ নববর্ষ পালনের দিনটিকে। পূজামণ্ডপে দেখা যাবে বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পালনের এক টুকরো ছবি। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটক এবং সৃষ্টিকে এবার থিম করেছে কলকাতার দুটি পূজা কমিটি। একটি হচ্ছে আহিরিটোলা সর্বজনীন পূজা কমিটি। আরেকটি বালিগঞ্জ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন পূজা কমিটি। শ্রীভূমি পূজা কমিটি থিম করেছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে। বালিয়া বৈশাখী সংঘের থিম আশ্বিনে শ্রাবণ।
মাদাম তুসোর মোমের মিউজিয়ামকে থিম করেছে বাঘাযতীন রবীন্দ্র পল্লি দুর্গোৎসব কমিটি। মিসরের আদি গয়নাকে থিম করেছে দমদম পার্ক ভারতচক্র। কলকাতার মুচিপাড়ার পল্লিশ্রীর মণ্ডপ হয়েছে মেক্সিকোর ভাবধারায়। মাদার তেরেসার সন্ত হওয়াকে থিম করে মণ্ডপ তৈরি
করেছে নাকতলা উদয়ন সংঘ। হাতিবাগান নবীন পল্লির এবারের পূজার থিম রাজস্থানের কাবার্ড শিল্প। যোধপুর পার্কের থিম এবার এক টুকরো শান্তির গ্রাম। নাকতলা আষাঢ় সংঘ মণ্ডপ বানিয়েছে ইটের টুকরো দিয়ে। আরশিনগরের ধাঁচে ভবানীপুর ৭৫ পল্লির পূজামণ্ডপ তৈরি হয়েছে। সন্তোষপুরের লেক পল্লির ১২ ফুটের দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয়েছে সোনার পাতে মুড়িয়ে। হরিদেবপুর বিবেকানন্দ অ্যাথলেটিক ক্লাবের থিম এবার ‘গল্পসল্প বাকিটা গল্প’। থাকছে ঠাকুরমার ঝুলির নানা গল্প। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন বিষয়কে থিম করেছে বিভিন্ন পূজা কমিটি।
এবার যেমন মণ্ডপ নির্মাণে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে, ঠিক তেমনি প্রতিমা নির্মাণ ও সাজসজ্জায়ও এসেছে ভিন্নতা। ভাসছে প্রতিটি মণ্ডপ আলোর বন্যায়। এসব মণ্ডপ আর দেবী দুর্গা দেখার জন্য এখন প্রহর গুনছেন কলকাতাবাসী। কখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে, কখন ভক্তদের চমকে দেবে পূজামণ্ডপ আর দেবী দুর্গা?
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ১ টি