কয়েকটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যবই
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহতো, মালো, সিং, রাজোয়াড়, মাহালী, তুরি প্রভৃতি। এছাড়া মগ, ত্রিপরা, রাখাইন উপজাতি নৃগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। এসব নৃগোষ্ঠীর মধ্যে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর অঞ্চলে সাঁওতাল; ময়মনসিংহ অঞ্চলে মগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা প্রধান। অবশ্য চাকমাদের মধ্যে পৃথক স্বাজাত্য ও ঐতিহ্য পরিলক্ষিত হয়। কয়েক ঘর রাখাইনের বাস পটুয়াখালীতে। এদের সবারই নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এরা নিজেদের মধ্যে কথা বললে অন্যরা প্রায়ই বোঝেন না। এমনকি একগোষ্ঠীর ভাষা অন্য গোষ্ঠীও প্রায় বোঝে না। কাজেই সব নৃগোষ্ঠীর ভাষা এক হলে সুবিধার চেয়ে সমস্যাই হয়তো হবে বেশি।
অনেকদিন যাবৎ সাঁওতাল শিশুদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়নের দাবি ওঠে। আপাতদৃষ্টিতে তা যৌক্তিক মনে হলেও বাস্তব সমস্যাও রয়েছে। কারণ সাঁওতালদের ভাষা কেবল সাঁওতালরাই বোঝেন। অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কেউ বোঝেন না। তাই সরকারি তরফ থেকে উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বলা যায়। ‘সাদরি’ নামক ভাষার লিপিতে পাঠ্যবই প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে। এভাষারও আসলে সূক্ষ্ম ফারক বিদ্যমান। প্রায় ৫০/৬০ বছর আগে খৃস্টান মিশনারিদের তরফ থেকে বিশেষত সাঁওতালদের মাঝে খৃস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রোমান অক্ষরে সাঁওতালি ভাষায় পুস্তক ছেপে প্রচার করা হয়। সে সূত্রে কেউ কেউ রোমান অক্ষরে এখনও সাঁওতালি ভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়নের পক্ষে। তবে তা সব নৃগোষ্ঠী মানতে নারাজ। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, সাঁওতালদের মধ্যে যাঁরা নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করেন না বরং বিরোধিতা করেন, তাঁরাই রোমান বর্ণমালায় পাঠ্যবই প্রণয়নের দাবি করছেন। তিনি ‘হলচিকি’ নামক অক্ষরে সাঁওতালদের ভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়নের দাবি করেন। বাসদ নেতা খালেকুজ্জামান রতন বলেন, বাংলার সঙ্গে সাঁওতালদের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। তাই বাংলা হরফে তাঁদের জন্য পাঠ্যবই প্রণয়নই হবে ন্যায়সঙ্গত। রতন সাহেবের যুক্তিই সম্ভবত জোরালো। এছাড়া এদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাভাষা শিক্ষা সবার জন্য আবশ্যিক হওয়া জরুরি।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি থাকতে পারে অবশ্যই। তবে বাংলাদেশি সংস্কৃতি উপেক্ষা করে নয়। এ সংস্কৃতিকে ধারণ করেই নৃগোষ্ঠীয় সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। অন্যথায় দেশের সামগ্রিক কালচার থেকে দূরে থাকলে তাঁদের মধ্যে বিরূপ চেতনার উন্মেষ ঘটতে পারে, যা বাংলাদেশী জাতিসত্তার বিরুদ্ধেও যেতে পারে ভবিষ্যতে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এমনিতেই বাংলাদেশি জাতি সত্তাবিরোধী তৎপরতা বিদ্যমান। এর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এমতাবস্থায় সাঁওতালসহ অন্য নৃগোষ্ঠীর জন্য পৃথক পৃথক ভাষা ও কালচার সৃষ্টি হলে তা হতে পারে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো।
বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী বলে দাবি করা হলেও এদের সবাই কিন্তু তা নয়। এ বিষয়ে যথেষ্ট ভিন্নমতও রয়েছে। যেমন: সাঁওতালদের আদি নিবাস কিন্তু বাংলাদেশ নয়। এরা এসেছে নেপাল, ভারতের দুমকা অঞ্চল ও ছোটনাগপুর এলাকা থেকে। বাড়িঘর বানিয়ে বসবাস করলেও এরা শিকারপ্রিয় মানুষ। বনে-জঙ্গলে শেয়াল, খাটাশ, বানর, সাপ, পাখি, কচ্ছপ, গুইসাপ, ভোঁদড়, ইঁদুর, নদী-পুকুর থেকে মাছ প্রভৃতি শিকার করে এবং বন-জঙ্গলের ফলফলারি ও বুনো আলু খেয়ে জীবনধারণ করতেন। পরবর্তীতে বন-জঙ্গল কমে গেলে এরা চাষাবাদে অভ্যস্ত হন। মগ এবং অন্য উপজাতির লোকদেরও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলে আগমন ঘটে। কাজেই তাঁরা সবাই আদিবাসী এমন ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। তবে তাঁরা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। দেশের মূলভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের একাত্ম হয়ে থাকাই সমীচীন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.