হাসপাতালের জানালা
ইরানের ইস্পাহান শহরের বিখ্যাত আল জাহরা ইস্পাহান হাসপাতাল। রুম নংঃ ২১৯। পাশাপাশি দুটি বেড। ডাবল বেডের কেবিন বলা যেতে পারে। কেবিনে একমাত্র জানালা। দুই বেডে অপরিচিত দুই রোগী। দু'জনেই রোগী- এটাই তাদের প্রথম পরিচয় এবং মিল। প্রথম দিনেই দুই রোগী নিজেদের পরিচয় পর্ব মিটিয়ে নিয়েছিল। একজনের নাম হাসান তুরাবী, অপরজন ফাইয়াজ রাহমী। পরিচয় পর্ব শেষে দু'জন নিজেদের মধ্যে আরেকটি মিল খুঁজে পেল। উভয়েরই বয়স ৬৫ বছর।
ডাক্তার সাহেব হাসান তুরাবীকে বিকালবেলা বেডের উপর এক ঘন্টা বসে থাকার নির্দেশ দিয়েছিল। উদ্দ্যেশ্য শরীরের স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ঠিক রাখা। তুরাবীর বেড কেবিনের একমাত্র জানালার পাশেই। অপরদিকে ফাইয়াজ রাহমীকে সারাবেলা বেডের উপর শুয়ে থাকতে হতো। কোনভাবেই সে উঠে বসতে পারতো না। তুরাবী আর রাহমীর সারাদিন বেডে থাকাই একমাত্র কাজ ছিল। আর কোন কাজ নেই। তো, কি আর করার? দু'জনে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটিয়ে দিতো। এছাড়া তাদের আর কি ই বা করার ছিলো? তারা একে অপরকে তাদের স্ত্রীদের সম্পর্কে বলতো। পরিবারে সদস্যদের সম্পর্কে বলতো। তাদের চাকুরী জীবনের গল্প বলতো। সাবেক মিলিটারী জীবনের রোমাঞ্চের কথা হতো। কৈশোরের চঞ্চলতার স্মৃতিচারণ করতো।
হাসান তুরাবী বিকালবেলা জানালার পাশে বসতো। ফাইয়াজ রাহমীকে জানালার বাহিরে ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনার বর্ণনা দিতো।বেডে উঠে বসতে অক্ষম রাহমী তার কেবিনমেট তুরাবীর ধারা বিবরণী শুনে বেশ সময় কাটিয়ে দিতো। একদিন তুরাবী বাহিরের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বললো- রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছে। বাসের ভিতর অনেক যাত্রী। নারী-পূরুষ বাচ্চারা। সুন্দর চেহারার এক শিশু তার পিতার কোলে বসে চিপস খাচ্ছে। কি দারুণ ! আবার আরেকদিন বলতো জানালার পাশে রাস্তা দিয়ে এক সাধু বাবা হেঁটে যাচ্ছেন। হলুদ রঙয়ের জামা পড়ে আছেন। মাথায় হলুদ পাগড়ী। হাতে বাঁকানো লাঠি। কখনো বলতো-আকাশে কি সুন্দর মেঘ ! বিকালের রংধনুটা আজ একটু বেশীই ভাল লাগছে। ইস! যদি হাসপাতালের বেড ছেড়ে বাহিরে যেতে পারতাম! একদিন সে বললো-রাস্তার পাশেই একটা দারুন লেক। রাজহাঁস লেকে জলকেলি করছে। শিশুরা সাঁতার কাটছে। লেকের ধারে বসে বিভিন্ন পরিবারের সদস্যরা প্রকৃতিকে উপভোগ করছে। কি দারুন দৃশ্য !
এসব বর্ণনা শুনে ফাইয়াজ রাহমী কল্পনার রাজ্যে ভেসে হাসান তুরাবীর দেয়া বর্ণনাকে জীবন দেয়ার চেষ্টা করতো। কল্পনায় বাহিরের অপরুপ দৃশ্যকে চোখের সামনে নিয়ে আসতো। তুরাবীর বর্ণনার সময় রাহমী চোখ বন্ধ করে থাকতো এবং বর্ণনার সাথে নিজের কল্পনাকে মিলিয়ে নিতো। আহা ! তাতেই কি তৃপ্তি! রাহমী তার রোগী বন্ধু তুরাবীর চোখ দিয়ে যেন সব দেখতে পাচ্ছিলো।
একদিন সকালে নার্স তাদের দুইজনকে গোসল করানোর জন্য পানি নিয়ে এসে দেখলেন হাসান তুরাবী আর নেই। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় শান্তিতে এ পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। নার্স তাৎক্ষণিক হাসপাতালের অন্যদের ডেকে মৃতদেহকে বাহিরে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলো। মাত্র ক’দিনের পরিচয়ে বন্ধু হওয়া জানালার পাশের রোগী সঙ্গী হাসান তুরাবীর মৃত্যুতে ফাইয়াজ রাহমী অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। অঝোড়ে কিছুক্ষন কাঁদলেন। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- " বন্ধু ! আজ থেকে কে আমাকে গল্প শোনাবে? কে আমাকে জানালার পাশের উপভোগ্য দৃশ্যের ধারা বিবরণী শোনাবে ? আল বিদা বন্ধু ! ওপাড়ের সুন্দর ভূবনে ভাল থেকো। সহসাই আমিও আসছি।"
মৃতদেহ কেবিনের বাহিরে নেয়ার পর ফাইয়াজ রাহমী নার্সকে অনুরোধ করলেন-তার বেড পরিবর্তন করে জানালার পাশে দেয়া হোক। রাহমী দুটি কারনে জানালার পাশের বেডে যেতে চাইছিলেন। প্রথম কারণ হলো- বন্ধু হাসান তুরাবীর বেডে গেলে তার ছোঁয়া লাগা বেডের পরশ পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় কারণ হলো- এখন যেহেতু একটু শরীর ভাল, তাই বেডে উঠে বসতে পারলে জানালার বাহিরের অপরুপ প্রকৃতি দেখে সময় কাটিয়ে দেয়া যাবে। যদিও এই দুটি কারনের কথা নার্সকে বলা হয় নি। রাহমীর এই প্রস্তাবে নার্স সম্মতি দিলেন এবং একটু পরেই তাকে শিফট করে জানালার পাশে দিলেন। শিফট হয়েই রাহমী জানালার বাহিরের দৃশ্য দেখার উদ্দ্যেশ্যে উঠে বসতে চাইলেন। কিন্তু কোনভাবেই পারছিলেন না। কিন্তু কল্পনায় গাঁথা তুরাবীর বর্ণনায় পাওয়া বাহিরের দৃশ্য নিজ চোখে দেখার ব্যাকুলতা তার শরীরে ধীরে ধীরে সাহসের শক্তি সঞ্চারণ করছিল। অনেকবারের চেষ্টায় একবার তিনি অনেক কষ্টে উঠে বসলেন এবং জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেন।
কিন্তু এ কি? কোথায় রাস্তা ? কোথায় লেক ? জানালার পাশে তো বিরাট একটা দেয়াল ! এটা কি করে সম্ভব? তুরাবী কিভাবে জানালার বাহিরের ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতো? তাহলে কি তুরাবী আমাকে মিথ্যা গল্প বলতো?
এবার রাহমী নার্সকে তার মৃত রোগী বন্ধু হাসান তুরাবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন-আসলে তার কি হয়েছিল? নার্স বললেন সেই লোকটি অন্ধ ছিলেন এবং পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
তাহলে ওনি নিজে অন্ধ হয়ে আমাকে বাহিরের অপরুপ দৃশ্যের কথা কেন বানিয়ে বানিয়ে বলতেন?
নার্স উত্তর দিলো- “ওনি খুব সম্ভবত আপনাকে শুধু সাহস যোগাতে চেয়েছিলেন এবং আপনার মানসিক প্রশান্তির উপলক্ষ্য এনে দিতে চেয়েছিলেন। মৃত্য পথযাত্রী মি. তুরাবী তার কেবিনের আরেক রোগী হিসেবে আপনাকে স্রেফ ভাল রাখতে চেয়েছিলেন।”।
এবার জানালার বাহিরের ওয়ালের দিকে তাকিয়ে ফাইয়াজ রাহমী ডুকরে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
ডাক্তার সাহেব হাসান তুরাবীকে বিকালবেলা বেডের উপর এক ঘন্টা বসে থাকার নির্দেশ দিয়েছিল। উদ্দ্যেশ্য শরীরের স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ঠিক রাখা। তুরাবীর বেড কেবিনের একমাত্র জানালার পাশেই। অপরদিকে ফাইয়াজ রাহমীকে সারাবেলা বেডের উপর শুয়ে থাকতে হতো। কোনভাবেই সে উঠে বসতে পারতো না। তুরাবী আর রাহমীর সারাদিন বেডে থাকাই একমাত্র কাজ ছিল। আর কোন কাজ নেই। তো, কি আর করার? দু'জনে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটিয়ে দিতো। এছাড়া তাদের আর কি ই বা করার ছিলো? তারা একে অপরকে তাদের স্ত্রীদের সম্পর্কে বলতো। পরিবারে সদস্যদের সম্পর্কে বলতো। তাদের চাকুরী জীবনের গল্প বলতো। সাবেক মিলিটারী জীবনের রোমাঞ্চের কথা হতো। কৈশোরের চঞ্চলতার স্মৃতিচারণ করতো।
হাসান তুরাবী বিকালবেলা জানালার পাশে বসতো। ফাইয়াজ রাহমীকে জানালার বাহিরে ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনার বর্ণনা দিতো।বেডে উঠে বসতে অক্ষম রাহমী তার কেবিনমেট তুরাবীর ধারা বিবরণী শুনে বেশ সময় কাটিয়ে দিতো। একদিন তুরাবী বাহিরের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বললো- রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছে। বাসের ভিতর অনেক যাত্রী। নারী-পূরুষ বাচ্চারা। সুন্দর চেহারার এক শিশু তার পিতার কোলে বসে চিপস খাচ্ছে। কি দারুণ ! আবার আরেকদিন বলতো জানালার পাশে রাস্তা দিয়ে এক সাধু বাবা হেঁটে যাচ্ছেন। হলুদ রঙয়ের জামা পড়ে আছেন। মাথায় হলুদ পাগড়ী। হাতে বাঁকানো লাঠি। কখনো বলতো-আকাশে কি সুন্দর মেঘ ! বিকালের রংধনুটা আজ একটু বেশীই ভাল লাগছে। ইস! যদি হাসপাতালের বেড ছেড়ে বাহিরে যেতে পারতাম! একদিন সে বললো-রাস্তার পাশেই একটা দারুন লেক। রাজহাঁস লেকে জলকেলি করছে। শিশুরা সাঁতার কাটছে। লেকের ধারে বসে বিভিন্ন পরিবারের সদস্যরা প্রকৃতিকে উপভোগ করছে। কি দারুন দৃশ্য !
এসব বর্ণনা শুনে ফাইয়াজ রাহমী কল্পনার রাজ্যে ভেসে হাসান তুরাবীর দেয়া বর্ণনাকে জীবন দেয়ার চেষ্টা করতো। কল্পনায় বাহিরের অপরুপ দৃশ্যকে চোখের সামনে নিয়ে আসতো। তুরাবীর বর্ণনার সময় রাহমী চোখ বন্ধ করে থাকতো এবং বর্ণনার সাথে নিজের কল্পনাকে মিলিয়ে নিতো। আহা ! তাতেই কি তৃপ্তি! রাহমী তার রোগী বন্ধু তুরাবীর চোখ দিয়ে যেন সব দেখতে পাচ্ছিলো।
একদিন সকালে নার্স তাদের দুইজনকে গোসল করানোর জন্য পানি নিয়ে এসে দেখলেন হাসান তুরাবী আর নেই। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় শান্তিতে এ পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। নার্স তাৎক্ষণিক হাসপাতালের অন্যদের ডেকে মৃতদেহকে বাহিরে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলো। মাত্র ক’দিনের পরিচয়ে বন্ধু হওয়া জানালার পাশের রোগী সঙ্গী হাসান তুরাবীর মৃত্যুতে ফাইয়াজ রাহমী অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। অঝোড়ে কিছুক্ষন কাঁদলেন। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- " বন্ধু ! আজ থেকে কে আমাকে গল্প শোনাবে? কে আমাকে জানালার পাশের উপভোগ্য দৃশ্যের ধারা বিবরণী শোনাবে ? আল বিদা বন্ধু ! ওপাড়ের সুন্দর ভূবনে ভাল থেকো। সহসাই আমিও আসছি।"
মৃতদেহ কেবিনের বাহিরে নেয়ার পর ফাইয়াজ রাহমী নার্সকে অনুরোধ করলেন-তার বেড পরিবর্তন করে জানালার পাশে দেয়া হোক। রাহমী দুটি কারনে জানালার পাশের বেডে যেতে চাইছিলেন। প্রথম কারণ হলো- বন্ধু হাসান তুরাবীর বেডে গেলে তার ছোঁয়া লাগা বেডের পরশ পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় কারণ হলো- এখন যেহেতু একটু শরীর ভাল, তাই বেডে উঠে বসতে পারলে জানালার বাহিরের অপরুপ প্রকৃতি দেখে সময় কাটিয়ে দেয়া যাবে। যদিও এই দুটি কারনের কথা নার্সকে বলা হয় নি। রাহমীর এই প্রস্তাবে নার্স সম্মতি দিলেন এবং একটু পরেই তাকে শিফট করে জানালার পাশে দিলেন। শিফট হয়েই রাহমী জানালার বাহিরের দৃশ্য দেখার উদ্দ্যেশ্যে উঠে বসতে চাইলেন। কিন্তু কোনভাবেই পারছিলেন না। কিন্তু কল্পনায় গাঁথা তুরাবীর বর্ণনায় পাওয়া বাহিরের দৃশ্য নিজ চোখে দেখার ব্যাকুলতা তার শরীরে ধীরে ধীরে সাহসের শক্তি সঞ্চারণ করছিল। অনেকবারের চেষ্টায় একবার তিনি অনেক কষ্টে উঠে বসলেন এবং জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেন।
কিন্তু এ কি? কোথায় রাস্তা ? কোথায় লেক ? জানালার পাশে তো বিরাট একটা দেয়াল ! এটা কি করে সম্ভব? তুরাবী কিভাবে জানালার বাহিরের ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতো? তাহলে কি তুরাবী আমাকে মিথ্যা গল্প বলতো?
এবার রাহমী নার্সকে তার মৃত রোগী বন্ধু হাসান তুরাবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন-আসলে তার কি হয়েছিল? নার্স বললেন সেই লোকটি অন্ধ ছিলেন এবং পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
তাহলে ওনি নিজে অন্ধ হয়ে আমাকে বাহিরের অপরুপ দৃশ্যের কথা কেন বানিয়ে বানিয়ে বলতেন?
নার্স উত্তর দিলো- “ওনি খুব সম্ভবত আপনাকে শুধু সাহস যোগাতে চেয়েছিলেন এবং আপনার মানসিক প্রশান্তির উপলক্ষ্য এনে দিতে চেয়েছিলেন। মৃত্য পথযাত্রী মি. তুরাবী তার কেবিনের আরেক রোগী হিসেবে আপনাকে স্রেফ ভাল রাখতে চেয়েছিলেন।”।
এবার জানালার বাহিরের ওয়ালের দিকে তাকিয়ে ফাইয়াজ রাহমী ডুকরে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৩ টি