একটি বানোয়াট গল্প
রাত একটা। রফিক ঘড়ি না দেখেই বলে দিতে পারে। গত অনেক দিন ঠিক মত ঘুমায় না। পাহারা দেয়। ঘরে একটা বিবাহিত বোন। দুলাভাই কোথায় আছে কেউ জানেনা।
সামান্য শব্দেও চমকে উঠছে রফিক। আকাশে কি আজ চাঁদ দেখা যাচ্ছে? বসার ঘরে বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করে যাচ্ছে। রফিক যেদিন পুরো রাত যেগে থাকে সেদিন দুই প্যাকেট 'সিগ্রেট' শেষ হয়ে যায়। গন্ডগোলের সময় সিগারেটের দাম বেড়ে হয়ে গ্যাছে আকাশচুম্বি। আজ মনে হয় সারা রাতই জাগতে হবে। ঘুম আসছে না। অথচ সিগারেট আছে আর বারো কাঠি। তিথি বলতো 'সিগ্রেট।'
হঠাৎই তিথির কথা মনে পড়ল। খুব কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য। মিলিটারি গুলো খুবলে খুবলে খেয়েছে। এখন কোন ক্যাম্পে আছে কে জানে! কি নিষ্পাপ চেহারা ছিল মেয়েটার। কিশোরী মেয়ের মত বৃষ্টির শব্দের মত হাসি ছিল তিথির। শুধু ঐ হাসির শব্দ আর কোব দিন শুনতে পাবে না, এই ক্রোধে যে কেউ পাকিস্তানী মিলিটারিদের বিপক্ষে যুদ্ধে চলে যেতে পারে। কিন্তু রফিক যায়নি। দেশের জন্য যতটুকু ভালোবাসা লাগে তার সবটা হয়তো ওর মাঝে নেই। আর একটা জিনিস ওর মাঝে একেবারেই নেই সেটা হলো 'সাহস।' হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে গ্যাছে। নতুন একটা বের করে নিল প্যাকেট থেকে।
২.
চমকে উঠলো রফিক। চট করে ঘড়ির দিকে তাঁকায়। পৌনে দুইটা বাজে। এই সময়ে মিলিটারি ছড়া কেউ দরজা ধাক্কায় না। ওরা ধাক্কাও দেয় না। লাথি মারে। কিন্তু এখন দরজায় ধাক্কা দেয়ার শব্দ হচ্ছে। খুব জোরালো না। একটু পরেই ডাক শোনা গেল,
-"রফিক! এ্যাই রফিক!"
ভরাট পুরুষ কন্ঠ। রফিক প্রায় কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে দিলো। দরজার পাল্লা দুটো পুরোপুরি খুলে দেয়ার পর আগুন্তুকের দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইলো কয়েকটা সেকেন্ড। তারপর ঘুরে প্রায় দৌড় দিল সুমনার ঘরের দিকে। ঘুমিয়ে ছিল সুমনা।
-"আপা! আপারে!"
সুমনার ঘুম এমনিতেই খুব পাতলা। তাই একবার ডাকতেই উঠে গেল। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
-"কি হইছে?"
-"আনিস ভাই আসছে!"
সুমনা প্রায় ছুটে বেরিতে গেল বসার ঘরের দিকে।
মুখ ভর্তি লম্বা লম্বা দাড়ি। চুল গুলো অনেকটা নজরুলের বাবরি চুলের মত হয়ে গ্যাছে। ময়লা ফুল প্যান্টটা হাটু পর্যন্ত গুটানো। ময়লা শার্টটার বাহুর কাছে ছেড়া। হাতা কুনুই পর্যন্ত গুটানো। আর দাড়ি গোফের জঙ্গল ভেদ করে সেই ভূবন ভোলানো হাসি। কাঁধে একটা স্টেনগান ঝুলছে। সুমনা জড়িয়ে ধরলো আনিসকে। কেঁদে ফেলল হুঁ-হুঁ করে। একটু পরেই সুমনার মা এসে দাড়ালেন বসার ঘরে। আনিস তাঁকে দেখে সুমনার কানে কানে বলল,
-"আম্মা আসছে!"
সুমনা তবুও কিছুক্ষন জড়িয়ে রাখলো আনিসকে। তারপর ছেড়ে দিলো এক সময়। আনিস এগিয়ে গিয়ে শ্বাশুরীর পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল,
-"আম্মা খুব খিদা লাগছে। ভাত খাবো।"
-"তুমি হাত মুখ ধোঁও। আমি খাবার দিচ্ছি। "
-"না আম্মা। গোসল করতে হবে ঠান্ডা পানি দিয়ে। লাস্ট কবে গোসল করছি মনে নাই। ছাদের কলটা ঠিক আছে না?"
-"হ্যা।"
মা সুমনাকে বললেন,
-"সুমি তুই ওকে ছাদে নিয়ে যা।"
সুমনা আনিস কে আগে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। আনিস স্টেনগানটা খাটের নিচে রাখতে রাখতে বলল,
-"ফজরের আজান হলেই চলে যাবো!"
৩.
সুমনা আনিসকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার পর রফিক বাসা থেকে বের হলো। আজ বেশ কিছু টাকা আসবে হাতে। দ্রুত হাটতে হচ্ছে। আনিস কতক্ষন থাকবে ঠিক নাই। শুধু শুধু অপেক্ষা না করে আগে আগেই খবরটা দিয়ে দেয়া ভালো। দেশ প্রেমিকের কাছে পরিবার বড় না। দেশ বড়। মালাউন ইন্ডিয়ার কুত্তা গুলা পবিত্র পাকিস্তানকে ভাগ করতে চায়। চাড়াল গুলা শীঘ্রই টের পাবে রুটির কি দম।
আনিস ছাদ থেকে লক্ষ্য করলো রফিক বাইরে যাচ্ছে। ছাদের রেলিং ধরে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলো সে তারপর পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে নিল। গ্যাস লাইটারটা বের করে সিগারেটে আগুন ধরাল। লাইটারটা সুমনা গিফট করেছিল অনেক দিন আগে। বিশেষ বিশেষ দিনে এটা রফিক ব্যবহার করে। আজ বিশেষ দিন।
৪.
সুমনাদের বাসা থেকে অল্প দূরে একটা দুই তলা বিল্ডিং এর ছাদে রমিজ একটা বায়নোকুলার চোখে বসে আছে। গত সপ্তাহে রূপগঞ্জ অপারেশনে বায়নোকুলারটা পেয়েছে। অনেকক্ষন ধরে বসে আছে বায়নোকুলার চোখে নিয়ে। ওর পিছনে কমান্ডার ছাদেক আলী বসে আছেন সিগারেট হাতে। বেশ চিন্তিত তিনি। দলের বাকি সবাই পাশের ঘরে। ক্যুইক একশানের জন্য তৈরী সবাই। তবে সেই একশানটা কখন হবে সেটা কেউই জানে না।
হঠাৎই রমিজ প্রায় চাপা স্বরে চেচিয়ে উঠল,
-"ছাদেক ভাই আগুন জ্বলছে! আগুন জ্বলছে!"
ছাদেক আলী মহা বিরক্ত হয়ে বললেন,
-"আহ, আস্তে! সবাইকে তৈরী হতে বলো। এখনই বের হয়ে হবে।"
৫.
আনিস গোসল শেষে ভাত খেতে বসেছে। ওর পাশে সুমনা। এখনও কান্না থামেনি। আনিসও কিছু বলছে না। কিছুক্ষন পর রফিক বাসায় ঢুকলো। মা জিজ্ঞেস করলেন,
-"কোথায় গিয়েছিলি?"
-"বাইরেটা একবার দেখে আসতে।"
রফিক নির্বিকার ভাবে জবাব দেয়। আনিস এক মনে খাচ্ছে।
৬.
রার সাড়ে পৌনে চারটা। রমিজ, সাদেক আলী, তৌকির, তুহিন, নবী বক্স, সুজন, মিসির, রবি, রিসাদ নামের কয়েকজন যুবক সতর্ক অবস্থায় গলির নানা ফাঁক ফোকরে বসে কিংবা দাড়িয়ে আছে। শুধু মিসির চুপচাপ নেই। তার হাতে একটা হ্যান্ড গ্রেনেড। গ্রেনেড ছোড়ায় সে বিশেষ পারদর্শী। তার সামনে একটা রুমালে আরো দুইটা গ্রেনেড সাজানো আছে। মিসির হাতের গ্রেনেডটা একবার শূন্যে ছুড়ে আবারর লুফে নিলো। এমন সময় হুস করে দুটো মিলিটারি জিপ ওদের সামবে দিয়ে ছুটে গেল। কিন্তু দলের সবাই চুপ। শুধু সাদেক আলীর পাশে দাড়িয়ে নবী বক্স একবার বলল,
-"সাদেক ভাই গাড়ি তো দুইডা। একটা মানুষরে ধরতে দুই গাড়ি মিলিটারি!"
নবী বক্স বেশ ভয় পেয়েছে। তাদের হিসাব ছিল একটা গাড়ি।
৭.
দ্রিম দ্রিম করে দরজায় লাথি পড়ছে। আনিস আর সুমনা সুমনার ঘরে। রফিক দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে সে একবার মাথাটা ডান দিকে কাত করলো। তারপর ভীত স্বরে বলল,
-"আসসালামু আলাইকুম!"
মিলিটারিরা ওয়াজিবের ধারে কাছেও গেল না। তারা ঘরে ঢুকে ভাংচুর সুরু করলো। আনিস শব্দ শুনে বেরিয়ে এসেছিল।
তার দিকে চার জন মিলিটারি এগিয়ে গেল। একজন ওর কাছে গিয়ে পেটে একটা কষিয়ে ঘুসি মারলো। আনিস পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লো। ওই অবস্থায় ওকে টানতে টানতে বাসা থেকে বের করে প্রথম গাড়িটায় তোলা হলো। বাড়ি সার্চ করে সুমনার খাটের নিচ থেকে স্টেনগানটা খুঁজে পেল। মাত্র দশ মিনিট পর মিলিটারিরা আবার রওনা হলো।
ক্যাপ্টেন আকবর বেশ সন্তুষ্ট চিত্তে প্রথম গাড়িটায় ড্রাইভারের পাশে বসলেন। তিনি ড্রাইভারকে এগোতে বললেন। প্রত্যেক মিলিটারিই বেশ গম্ভির ভাবে বসে আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে চাপা উচ্ছাস রয়েছে।
৮.
গাড়ি দুটো গলির একটা নির্দিষ্ট যায়গায় আসতেই প্রথম গাড়িটার বেশ সামনে একটা গ্রেনেড ফাটলো। তবুও গ্রেনেডের স্প্রিন্টার আর শক ওয়েভের ধাক্কায় গাড়িটার সামনের গ্লাস ভেঙে চুরমার হলো। দক্ষ ট্রেইনারের কাছে ট্রেইনিং পাওয়া পাকিস্তানি আর্মির সদস্যদের বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না যে, তারা নিঁখুত ভাবে পাতা একটা অ্যামবুশে পড়েছে। দ্বিতীয় গ্রেনেডটা পড়লো পরের গাড়িটার একদম ভিতরে। সাথে সাথে গাড়িতা বিস্ফোরিত হলো। গাড়ির প্রত্যেকটা মিলিটারি সাথে সাথে মারা পড়লো।
ক্যাপ্টেন আকবর খুব দ্রুত হোলস্টারে রাখা পিস্তলটা বের করে গাড়ির পেছনে বসা আনিসের দিকে পরপর চারটা গুলি চালালো। প্রথম দুটো গুলি ওর ডান পাশের পাজর ভেদ করে বেরিয়ে গেল। পরের গুলিটা বাম পাশের পাজর ও হৃদপিন্ড ভেদ করলো। চতুর্থ গুলিটা আনিসের কপালে তৃতীয় নয়ন সৃষ্টি করলো।
প্রথম গাড়ির মিলিটারিরা কোন প্রতিরোধই করতে পারলো না। গুলি খেয়ে মরলো সবাই। গোলাগুলি শেষে মুক্তিবাহিনীর সবাই প্রথন গাড়িটার দিকে এগোল। এটাতেই আনিস ছিল। মিসির স্পষ্ট দেখেছে। ওরা আবিষ্কার করলো অনেক গুলো মিলিটারি শুয়োরের মাঝে তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে আনিস। তার মুখটা রক্তে ভেজা। তার মাঝেই আনিসের ঠোটে লেগে আছে সেই হাসি। সুমনার মতে ভূবন ভোলানো হাসি!
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই হাত লাগিয়ে আনিসকে বের করলো। তারপর মিলিটারিদের অস্ত্র গুলো সংগ্রহ করতে শুরু করলো দ্রুত হাতে।
সাদেক আলী কাজ করতে খেয়াল করলেন তিনি চোখে ঝাপসা দেখছেন। চোখ গুলো জললে ভরে গ্যাছে। তিনি দ্রুত হাতে চোখ দুটো মুছে নিলেন। এমন অনেক আনিস মরেছে। আরো মরবে। কাঁদলেতো চলবে না। দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে।
নামকরণের শানেনজুল: প্রিয় পাঠক, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। যুদ্ধের প্রায় ২০-২৫ বছর পর স্বাধীন দেশে আমার জন্ম। যুদ্ধের সময় আমার দেশের মানুষ কি অবর্ণনীয় কষ্ট করেছে তা আমি চোখে দেখিনি। তাই এই স্পর্শকারত বিষয়ে কোন কিছু লিখতে হলে আমাকে সম্পূর্ন বানিয়ে লিখতে হবে।
এই কারনে আমি এই গল্পের নাম "একটি বানোয়াট গল্প" ছাড়া অন্য কোন নাম দিতে পারি নাই।
২জুলাই, ২০১১।
পাদটীকা: প্রায় চার বছর আগে লেখা এই গল্পটা। হঠাৎই প্রকাশ করতে মনে চাইলো। নিতান্তই কাচা হাতের লেখা। তবে আমি এখন যে খুব ভাল লেখক নই সেটা বলাই বাহুল্য।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
২৩ ফেব্রুয়ারি ’১৬ রাত ১০:০৭
এটি বানোয়াট গল্প নয় ব্রো। এটিই আমাদের রক্তের ইতিহাস। হয় তো এর চেয়েও করুণ! এভাবেই সুমনাদের চোখের সামনে থেকে তুলে নেয়া হয়েছে আনিসদের। আনিসদের শুধুই স্যালুট! দারুণ লিখেছেন। জাস্ট গো ফরোয়ারার্ড!!
২৩ ফেব্রুয়ারি ’১৬ রাত ১০:০৯
সাধক:
আমরা আনিসদের রক্তের দামে কেনা প্রিয় জন্মভূমিকে আসলেই গড়তে পারি নি। আনিস ভাইদের ত্যাগের বাংলাদেশে এখনো অনেক কিছুই ভালভাবে চলছে না। স্বাধীনতার জয় হোক।