চলে গেলেন বাংলার শক্তিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান
একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান আর নেই। আজ শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে তিনি মারা যান। ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন এটিএম শামসুজ্জামান। প্রথম কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেন ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য। এ পর্যন্ত শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনি লিখেছেন। প্রথম দিকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র পর্দায় তার আগমন ১৯৬৫ সালে।
১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন তিনি। এটিএম শামসুজ্জামান পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন এই শিল্পী।
এটিএম শামসুজ্জামানের জন্ম ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে; বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায় দেবেন্দ্রনাথ দাস লেইনে। ঢাকার পগোজ স্কুলে তার বন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুল ঘুরে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক শেষে এটিএম শামসুজ্জামান ভর্তি হয়েছিলেন তখনকার জগন্নাথ কলেজে।
বাবা নুরুজ্জামান ছিলেন নামকরা আইনজীবী। তিনি চাইতেন ছেলেও তার মত আইন পেশায় আসুক। কিন্তু শেষে এটিএম শামসুজ্জামান চেয়েছিলেন লেখক হতে। সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তকে লেখালেখিতে গুরু মানতেন, দৈনিক সংবাদে নিয়মিত তার লেখাও বের হত।
সেই শামসুজ্জামান অভিনেতা হয়ে উঠলেন কীভাবে?
দুই বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সেই শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতে দেখতে হয়ে উঠেছিলেন সিনেমার পোকা। তখন থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি দুর্বলতা তৈরি হচ্ছিল। সেই তাড়না থেকেই হয়ত অভিনয়ে আসা।
অভিনয় শুরুর পর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন বাবা। শুরুর দিকে ছিলেন নাটকের প্রমোটার। ২০ টাকা করে পেতেন। সূত্রাপুরের একটি হোটেলে তিন বেলা খেতেন। পরে সিনেমায় যখন নাম করলেন, সেই হোটেলওয়ালা তাকে বলেছিলেন, “আপনাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগে। অনেক কষ্ট করেছেন জীবনে।”
১৯৬১ সালে উদয়ন চৌধুরীর বিষকন্যা সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজের সুযোগ মিলে যায়। পরে নারায়ণ ঘোষ মিতার জলছবি সিনেমার জন্য লেখেন চিত্রনাট্য। সেই সিনেমাতেই অভিষেক ঘটে নায়ক ফারুকের। সিনেমার পর্দায় এটিএম শামসুজ্জামানের অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৫ সালের দিকে। শুরুর দিকে মূলত কমেডি চরিত্রেই তাকে দেখা যেত। ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেনের নয়নমণিতে খল চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বোদ্ধাদের নজর কাড়েন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
লাঠিয়াল, অশিক্ষিত, গোলাপী এখন ট্রেনে, পদ্মা মেঘনা যমুনা, স্বপ্নের নায়ক সিনেমার শামসুজ্জামান যেমন খল চরিত্রে ফ্রেমবন্দি হয়ে হয়েছেন, রামের সুমতি, ম্যাডাম ফুলি, যাদুর বাঁশি, চুড়িওয়ালায় তার কমেডি চরিত্রের কথাও মনে রেখেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের দর্শকরা। ওরা ১১ জন, স্লোগান, সংগ্রাম, সূর্য দীঘল বাড়ি, ছুটির ঘণ্টা, রামের সুমতি, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, পদ্মা মেঘনা যমুনা এবং গেরিলার মত সিনেমাতেও এটিএম শামসুজ্জামান অভিনয় করেছেন বিভিন্ন ভূমিকায়।
অভিনয়ের জন্য এটিএম শামসুজ্জামানের প্রথম পুরস্কার ছিল বাচসাস পুরস্কার। পরে ১৯৮৭ সালে কাজী হায়াতের দায়ী কে সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। এরপর ১৯৯৯ সালের ম্যাডাম ফুলি, ২০০১ সালের চুড়িওয়ালা, ২০০৯ সালের মন বসে না পড়ার টেবিলে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
২০১২ সালের চোরাবালি সিনেমার জন্য পান পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। আর ২০১৭ সালে ৪২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে ও পরে টেলিভিশনেও বেশ কিছু নাটকে দেখা গেছে তাকে। ভবের হাট, রঙের মানুষ, ঘর কুটুম, বউ চুরি ও শতবর্ষে দাদাজান তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ২০১৭ সালের আজীবন সম্মাননা পান এটিএম শামসুজ্জামান। ২০১৫ সালে যখন একুশে পদক দেওয়া হল, প্রথমে নিতে চাননি এই অভিনেতা। পরে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তিনি সেই সম্মাননা নেন। এর একটি ব্যাখ্যাও তিনি পরে দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে আকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আপনি নিজেও জানেন, একুশে পদক কারা কারা পেয়েছেন। …যাই হোক, একবার হাসানুল হক ইনু ভাই আমাকে বললেন, ‘আমি দিচ্ছি, পদকটা আপনি নেন’। আমি বললাম, আপনি দেন আর যাই দেন আমি নেব না।
“পরে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘এটিএমকে একুশে পদক দেওয়া হচ্ছে না কেন? উনারা বললেন, ‘আমরা তো দিয়েছি নেবেন না উনি’। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘উনাকে বলেন যে, আমি দিয়েছি।’ পরে পদকটা নিলাম।” পুরস্কার নিতে আপত্তির পেছনে এটিএম শামসুজ্জামানের কষ্ট ছিল, ক্ষোভ ছিল। তার বিশ্বাস ছিল, চলচ্চিত্রের অঙ্গনে তার সঠিক মূল্যায়ন কখনো হয়নি।
সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “ভাষা আন্দোলনে তো আমার কোনো অবদান নাই। আমি কেন একুশে পদক নেব? টুকটাক লেখালেখি করি, ফিল্মে অভিনয় করি- এই তো। ফিল্মে আমি কী অভিনয় করি? আমাকে তো সিনেমায় দেশের শ্রেষ্ঠ হনুমান বানিয়ে রাখা হয়েছে।”
তার ভাষায়, সিনেমা ছবি চলে প্রথমত গল্পের জোরে। দ্বিতীয়ত হিরোকে অবশ্যই সুদর্শন হতে হয়। সিনেমা চরিত্রাভিনেতাদের জন্য চলে না। তারা হচ্ছে ‘তরকারিতে জিরার মত’।
“মানুষ আয়না দেখে; আমি কম দেখেছি। যে দুই-চারবার দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, এই লোকটা জীবনেও নায়ক হতে পারবে না। ওই বাসনা আমি ত্যাগ করেছি। পরে মনে হয়েছে ‘হ্যাঞ্চব্যাক অব নটরডেমের’র মতো ছবি হলে হয়ত নায়ক হতে পারব।”
অভিনয় জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী- সেই প্রশ্নে এটিএম শামসুজ্জামান ২০১৯ সালে সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “চিড়িয়াখানায় গেলে সবার আগে কোন প্রাণী দেখতে যান আপনি?... হ্যাঁ। আমি দেশের শ্রেষ্ঠ হনুমান। হনুমান বলে আমাকে চিহ্নিত করতে পারেন, নট অ্যাজ আন অ্যাক্টর। কারণ আমাকে কোনো চরিত্রই দেওয়া হয়নি। আমি মনে করি না আমার কোনো প্রাপ্তি আছে। আমার অনেক অপ্রাপ্তি আছে।”
তাহলে চারশ বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে গেলেন কেন? এটিএম শামসুজ্জামানের উত্তর ছিল- “ভাত খাওয়ার জন্য অভিনয় করেছি; শুধু টিকে থাকার জন্য।”
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.