পাকিস্তানে দিন দিন আলো ছড়াচ্ছে ইমরান খান
ক্রমশই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিশ্বনন্দিত ক্রিকেট তারকা ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আরো জনপ্রিয় হতে শুরু করেছেন। তবে ক্রিকেটের ময়দানে নয়, সরাসরি রাজনীতির ময়দানে তিনি এখন বিরদর্পে এগিয়ে চলেছেন। পাকিস্তানের ৭০ দশকের রাজনীতিতে যেভাবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অভ্যুদয় হয়েছিল অনেকটা সেই কায়দায় ক্রিকেটের সাবেক এই তারকার অভ্যুদয়। ক্লিন ইমেজের অধিকারী স্পষ্টবাদি নির্ভীক ও সাহসী ইমরান খান এখন পাকিস্তানের সরকার ও বিরোধী দলসহ সব প্রতিপক্ষের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
ইমরান গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভূমিকা নিয়ে জনমত গঠনে তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে, পাকিস্তানিরা এখন তার দিকে ফিরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকার সাথে ইমরানের যোগাযোগ সরাসরি ক্রিকেট ত্যাগ করার পর থেকে। তিনি তাদের নিয়ে কয়েকখানা বই লিখে পশ্চিমাদের কাছে উপজাতিদের জীবনযাত্রার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও সীমান্ত প্রদেশের পাঠান সন্তান, তাই তার সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক উপজাতিদের। তারাও তাকে ভাবেন তাদের আপনজন হিসেবে।
ইমরান খান প্রচলিত ধারার রাজনীতির কঠোর সমালোচক। বিগত বছরগুলোতে তিনি সরকার ও বিরোধী দল উভয়কে তার সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন। তিনি সামাজিক বিপ্লবের ধ্যান-ধারণা রাখেন, পরিবর্তনে বিশ্বাসী। সরাসরি ইসলামের কথা না বললেও ইনসাফভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। তার রাজনৈতিক দর্শন বাম ঘেঁষা নয় তবে নিজেকে কট্টর ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত না করে মধ্যপন্থী সংস্কারবাদি হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি সামাজিক বিপ্লবের কথাও বলেন। মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তনে তিনি অনুপ্রাণিত তাই তাকে কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামীর নতুন সংস্কারক হিসেবেও তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। এর আরো কারণ সুস্পষ্ট- তা হলো তিনি নওয়াজ ও জারদারির রাজনীতির কঠোর ভাষায় সমালোচনা করলেও কখনো জামায়াতের রাজনীতির সমালোচনা করেননি বা করেন না।
পাকিস্তানের ঐতিহাসিক শহর লাহোর পাঞ্জাবের প্রাণকেন্দ্র। এই লাহোর সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে যে, লাহোরিরা একবার জেগে উঠলে পাকিস্তানে রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। পাঞ্জাব বিশেষ করে লাহোরের মানুষগুলো অদ্ভুত খেয়ালি প্রকৃতির। তারা সহজেই কোনো কিছু গায়ে মাখে না, গুরুত্ব দেয় না, ওভারলুক করে। কিন্তু যখন কোনো বিষয় তারা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয় তখন তাদের ভাবমূর্তি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। নির্বাচনের আগে লাহোরে ইমরান খানের জনসভাকে পাকিস্তানের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তানের সহিংস ও অস্থিতিশীল রাজনীতিতে যখন কেউ জনসভা করার সাহস রাখে না তখন ইমরান সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাবে জনসভা করে তার সাহসী ও বলিষ্ঠ রাজনীতির ছাপ রেখেছেন। মূলত তখন থেকেই তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে আলো ছড়াচ্ছে।
ইমরানের বর্তমান উত্থানকে পাকিস্তানের সঙ্ঘাতময় অস্থিতিশীল রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থান হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তার পেছনে কোনো শক্তি কাজ করছে বলে এখনো পর্যন্ত কোনো মন্তব্য পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে আসেনি, ইমরান নিজেই পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ঘোরতর সমর্থক। কোন কোন পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তানে সেনাবাহিনী রাজনীতিবিদদের তুলনায় অধিক জনপ্রিয়।
কাশ্মির নিয়ে ইমরান খানের অবস্থানের কারণে তিনি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। কেননা পাক সেনাবাহিনী ও জনগণ মনে করে থাকে, পিপিপি ও মুসলিম লীগ কাশ্মির সমস্যা সমাধানে আন্তরিক নয়। ফলে পাঞ্জাবের জনসমর্থন লাভ করবেন, পাশাপাশি সেনাবাহিনীর আস্থা কুড়াবেন সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যের কারণে তিনি উপজাতীয় এলাকা ও পাখতুন খাওয়া প্রদেশ এবং পাঞ্জাবে জনসমর্থন লাভ করবেন। এমনিতে এ অঞ্চলের আপামর জনগণ প্রবলভাবে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী।
ইমরান খান ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে ক্লিন ইমেজের মধ্যপন্থী পরিচ্ছন্ন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। সরাসরি তালেবানবিরোধী নন, তবে জঙ্গিবাদবিরোধী কঠোর মনোভাবের পাশাপাশি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান সুস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভূমিকা ও সরকার এবং বিরোধী দলের দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানের কারণে বর্তমানে তাকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে আদর্শ হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর সাহায্য তিনি নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। সরকারে ব্যয় সংকোচন নীতিও তিনি চালু করেছেন। কর্মসংস্থানের নানান পদক্ষেপ তার ইতিবাচক দিক।
পিপিপি ও মুসলিম লীগ উভয়ের জন্য তাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাস্তবে এই দুই প্রধান দলই জায়গিরদার, জমিনদার ও শিল্পপতিদের প্রতিনিধি। এখন দেখার বিষয় হলো সুবিধাবাদি এই এলিটশ্রেণীর শক্তিশালী ব্যূহ ভেদ করে তিনি কিভাবে এবং কত দূর পর্যন্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। ইমরানের রাজনীতির ইতিবাচক দিক হলো তিনি হতাশাগ্রস্ত তরুণদের উদ্বেলিত করেছেন, তাদের সাহস জুগিয়েছেন, তাদের সক্রিয় রাজনীতিতে টেনে এনেছেন যারা ঘরে বসে সমালোচনায় মুখর থাকত সেই তরুণেরা আজ ইমরানের মূল শক্তি। পাকিস্তানের হতাশাগ্রস্ত তরুণ প্রজন্মের কাছে ইমরান খান একমাত্র আশার আলো।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.