ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এক অনন্য উদাহরণ 'লেবানন'
লেবাননের রাজধানী বৈরুত
মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ লেবানন। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত দেশটিতে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। লেবানানকে বহু সভ্যতা-সংস্কৃতির মিলনমোহনাও বলা হয়ে থাকে।
২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী লেবাননের মোট জনসংখ্যা ৬,০০৬,৬৬৮ জন। স্থায়ী নাগরিক ছাড়াও ৪ লাখের মতো উদ্বাস্তু রয়েছে। ফিলিস্তিন থেকে আসা উদ্বাস্তুর সংখ্যা সর্বাধিক ২,৭০,০০০ জন।
পরিসংখ্যান মোতাবেক লেবাননে সুন্নি মুসলমান ২৮ শতাংশ। শিয়া মুসলমানও প্রায় ২৮ শতাংশ। ম্যারোনেইট খ্রিস্টান ২২ শতাংশ। গ্রিক অর্থোডক্স ৮ শতাংশ। দ্রুজ ৫ শতাংশ ও গ্রিক ক্যাথলিক রয়েছে ৪ শতাংশ। খ্রিস্টানদের সংখ্যা মুসলমানদের চেয়েও বেশি ছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ায় মুসলমানদের চেয়ে তাদের সংখ্যা কমে এসেছে।
শিয়া গেরিলা সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ
১৮টি ধর্মীয় গোষ্ঠী লেবাননে বিরাজমান। প্রত্যেকে স্বকীয়তার সঙ্গে নিজ ধর্মের রীতিনীতি ও উৎসব পালন করে। এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ায় না। সবার মধ্যে রয়েছে বিস্ময়জাগানিয়া ধর্মীয় সমঝোতা। কারণ, সেখানে পারস্পরিক সম্প্রীতি বেশ জোরদার। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন নজির নেই।
লেবানন সরকারের সর্বোচ্চ পদগুলো ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতাদের জন্য আনুপাতিক হারে নির্ধারিত। ধর্ম ও গোষ্ঠীগতভাবে বিভক্ত হয়েও ধর্মীয় সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখতে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। লেবাননে খ্রিস্টান, সুন্নি ও শিয়া মুসলমানরা একত্রে বাস করে। লেবাননে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপারে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক চুক্তি করে নিয়েছে।
রাজনীতি
লেবাননে রয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র। লেবাননে একটি নতুন পদ্ধতি প্রচলিত। লেবাননের বিদ্যমান খ্রিষ্টান, সুন্নি মুসলমান এবং শিয়া মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এ পদ্ধতি চালু করা হয়। এ অঞ্চলে মোট ১৮টি ধর্মীয় গ্রুপ বিদ্যমান। দেশটির আইনানুসারে প্রেসিডেন্ট হবে একজন ম্যারোনেইট খ্রিষ্টান, প্রধানমন্ত্রী হবেন সুন্নি মুসলমান, স্পিকার হবেন শিয়া মুসলমান।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সা'দ হারিরি
এখানকার সংসদীয় আসনগুলো মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে সমভাবে বণ্টিত। আরো খুলে বলতে গেলে দেশে বিদ্যমান ১৮টি দলের মধ্যে আরো বিস্তারিত বলতে গেলে ২৬টি দলের মধ্যে তা ভাগ করা হয়। দেশের সংসদ চার বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। প্রেসিডেন্ট আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন এবং প্রধানমন্ত্রী সা'দ হারিরি।
লেবানন প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন
বিচার ব্যবস্থা
লেবাননের বিচারিক ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে উসমানী আইন, নেপোলিয়ান কোড, গির্জার আইন এবং বেসামরিক আইনের সমন্বয়ে। লেবাননের আদালত তিন স্তরের। প্রথমত, প্রারম্ভিক পর্যায়, দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো আপিলের, তৃতীয় পর্যায়টি হলো চূড়ান্ত ফায়সালা বা মীমাংসার। সাংবিধানিক আদালত আইন এবং নির্বাচনী প্রতারণার বিষয়গুলো দেখে। এ ছাড়াও সেখানে ধর্মীয় আদালত রয়েছে। সেখানে প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন অনুযায়ী বিয়ে, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিচার পেতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
লেবানন ২০০১ সালের শেষ দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে আলোচনা শুরু করে। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। লেবানন কয়েকটি আরব দেশের সাথেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লিবিয়া, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও ইরাকের সাথে আগে দ্বন্দ্ব থাকলেও এখন সব আরব দেশের সাথেই লেবাননের ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। ৩৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০০২ সালে লেবানন আরব লিগ সম্মেলনের আয়োজন করে।
লেবাননের সেনাপ্রধান জোসেফ আউন
সেনাবাহিনী
লেবাননের সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৭২ হাজার ১০০। এর মধ্যে এক হাজার ১০০ জন বিমান বাহিনীর এবং এক হাজার নৌবাহিনীর সদস্য। এই বাহিনী মূলত দেশ ও দেশের জনগণকে বাইরের আগ্রাসন থেকে রা করা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রা, দেশের স্বার্থের প্রতি হুমকি মোকাবেলা করা, সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, ত্রাণ বিতরণ এবং অন্যান্য সামাজিক ও সরকারি কর্মকাণ্ডে সাহায্য করে থাকে।
প্রশাসনিক এলাকা
লেবাননকে ছয়টি প্রশাসনিক এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো বৈরুত, নেবাতিহ, বেকা, উত্তর প্রশাসনিক এলাকা, মাউন্ট লেবানন এবং দক্ষিণ প্রশাসনিক এলাকা। প্রত্যেকটি প্রশাসনিক এলাকা কয়েকটি শহর বা গ্রাম নিয়ে গঠিত। তবে বৈরুত প্রশাসনিক এলাকাতে বৈরুত ছাড়া অন্য কোনো শহর বা গ্রাম নেই।
অর্থনীতি
লেবাননের সুন্দর আবহাওয়া, অগণিত ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান প্রতি বছরই পর্যটককে টানে লেবানন ভ্রমণে। প্রাকৃতিক সুবিধার পাশাপাশি লেবাননের ব্যাংকিং খাতের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন এ খাতকে করেছে আরো বেশি সমৃদ্ধিশালী। ফলে প্রতি বছর এখানে লাখ লাখ লোক বেড়াতে আসে। আর তা থেকেই লেবাননের অর্থনীতি তার জিডিপি’র বেশির ভাগ আদায় করে নেয়। জনগণ খুঁজে নেয় তাদের আয়ের রাস্তা। লেবাননের পর্যটন খাতে দেশটির জনশক্তির মোট ৬৫ শতাংশ জড়িয়ে আছে। ফলও একেবারে হাতে হাতেই পায় লেবানন। মোট আয়ের ৬৭ শতাংশ আসে এই পর্যটন খাত থেকেই।
বিবলসের সমুদ্র সৈকত
লেবাননের এই পর্যটন খাত আরো সমৃদ্ধিশালী এবং আরো এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কয়েকবারের গৃহযুদ্ধে এ খাতটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর এ খাতটি আবারো সমৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে। কিন্তু ২০০৬ সালে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে এ খাতটি আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন পর্যটন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। অথচ সে সময়ে লেবাননের অর্থনীতিতে এসেছিল নতুন জোয়ার। ব্যাংকগুলোর সম্পদ দাঁড়িয়েছিল ৭৫ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০০৫ সালের তুলনায় পর্যটন বেড়েছিল ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু যুদ্ধ সবকিছুকে থামিয়ে দেয়। যুদ্ধের পর লেবানন সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যদের সাহায্যে আবারো সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালায়।
লেবাননের আয়ের ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স এখন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশটির মোট আয়ের এক-পঞ্চমাংশ। লেবানন ইউরোপ এবং আরব দেশগুলোতে প্রচুর দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে থাকে।
লেবাননে কৃষিকাজের জন্য জমি খুব বেশি না থাকলেও যতটুকু আছে তা পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং উর্বরতার কারণে ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। দেশটির মাত্র ১২ শতাংশ জনশক্তি এখানে কাজ করে থাকে। আর দেশের আয়ে কৃষি খাত অবদান রাখে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। লেবাননে উৎপন্ন ফসলের মধ্যে আপেল, পিচ, কমলা ও লেবু উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্যিক খলিল জিবরান
সাহিত্য
লেবাননের সাহিত্য এক সময় এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, হাজার বছরের বিখ্যাত সাহিত্যকেন্দ্র মিশরের সাথে তারা পাল্লা দিত। সাহিত্যচর্চা, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ছিল এগুলোর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। সাহিত্যের আকাশে লেবাননের বড় তারকা ছিলেন খলিল জিবরান। তার লিখিত দ্য প্রপেট বিশ্বের বিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বখ্যাত অন্য লেখকদের মধ্যে রয়েছেন ইলিয়াস মৌরি, আমিন মালোফ, হান্নান আল শেখ। আর লেবাননের যে প্রতিভা আঁকাআঁকি করে পুরো বিশ্ব মাত করেছিলেন, তিনি হলেন মোস্তফা ফারুক। লেবাননের পরিবেশ, লেবাননি জনগণের ভেতরকার তেজ, উদ্যম তুলে আনা ছবিগুলো প্রশংসা লাভ করেছিল সর্বত্রই। তার অঙ্কনবিষয়ক বেশ কয়েকটি বই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত।
যা হোক এসব নিয়েই লেবানন। অনেকের কাছে অনেক আরাধ্য এক ভূমি লেবানন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.