নাদের গুণ্ডার মুক্তিযুদ্ধ: এক অজানা উপাখ্যান
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের সেই ভয়ংকরী রাত্রি, যার কথা বাংলাদেশের মানুষেরা কোনো দিনই ভুলতে পারবে না। ওরা ঢাকা শহরকে রক্তবন্যায় ভাসিয়ে দেবার জন্য অতর্কিতে নেমে এলো। ওরা জানতো, এদেশে ওদের পক্ষে কেউ নেই। সরকারী কর্মচারী থেকে রাস্তার পুলিশ পর্যন্ত, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী থেকে শহরের মেহনতী মানুষ আর গ্রামের কৃষক পর্যন্ত জনসাধারণের সমস্ত স্তর থেকে ওরা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই পশ্চিমী শাসক চক্রের জঙ্গী বাহিনী কোন রকম বাছ-বিচার না করে সর্বগ্রাসী আক্রমণ নিয়ে নেমে এসেছিল।
রাত বারোটার পর ঘড়ি দেখে কাঁটায় কাঁটায় একই সঙ্গে ওরা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, লালবাগ, পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে, পুলিশ ব্যারাকে এমনকি থানায় থানায় ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে আক্রমণ করে বসলো। সবাই জানে, একমাত্র রাজারবাগ পুলিশ লাইন ছাড়া আর কোন জায়গা থেকে তারা কোনো প্রতিরোধ পায়নি, যেখানে গেছে সেখানেই অবাধে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে। কিন্তু এর ছোট্ট একটা ব্যতিক্রমও আছে। এই খবরটা কিন্তু খুব কম লোকই জানে।
২৫শে মার্চ রাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার বংশাল পুলিশ ফাঁড়িতে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ৭৫ জনের এক প্লাটুন সৈন্য পাঠায়। ওই প্লাটুনের সবাই একরকম খোশমেজাজেই ভারী অস্ত্র শস্ত্র সহ ফাঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলো। তাদের ধারণা ছিলো বংশাল ফাঁড়িতে সর্বসাকূল্যে পুলিশ আছে ২৬ কি ২৭ জন, আর অস্ত্র বড়জোর রাইফেল আর বন্দুক। এদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা সেনাবাহিনীর এক হাতের কাজ। বংশাল ফাঁড়ির গলিতে পৌঁছানো মাত্রই এক পশলা মেশিনগানের গুলি তাদের কে স্বাগত জানালো! হতাহত হল পাকিস্তান সেনাদের কয়েকজন। এহেন অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়লো পাক আর্মি, কারণ তারা দাঁড়িয়েছিলো খোলা রাস্তায় স্ট্রীট লাইটের নিচে, আর আক্রমণকারী পুলিশরা আশ্রয় নিয়েছিলো ফাঁড়ির অন্ধকারে। মেশিনগানের ফায়ারে চমকে দেয়ার পরই পাক আর্মিদের দিকে ক্রমাগত রাইফেল বন্দুকের গুলি ছুটে আসতে থাকে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আর্মি প্লাটুন।
ফাঁড়ির মধ্যে প্রতিরোধকারীরা উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলল। আক্রমণকারীদের মধ্যে জনকয়েক সম্ভবত হতাহত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যরা তাদের কোনো চিহ্ন রেখে যায় নি। ফাঁড়ির পুলিশেরা এভাবে একদল সশস্ত্র সৈন্যকে হটিয়ে দেবে, এটা সত্য সত্যই অভাবনীয়। আরও আশ্চর্যের কথা, তারা ফাঁড়ির মধ্যে থেকে মেশিনগান চালিয়েছিল। থানা বা ফাঁড়ির পুলিশদের হাতে কখনো মেশিনগান দেওয়া হয় না। একমাত্র বন্দুক ও রাইফেল তাদের সম্বল।
এই সংকট মুহূর্তে এই মেশিনগান কেমন করে তাদের হাতে এলো? বংশাল মহল্লার লোকের মুখে এর উত্তরটা আমি পেয়েছি। এটা শুধু ফাঁড়ির পুলিশের কাজ নয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এই মহল্লারই সুপরিচিত নাদির গুন্ডা ও তার কয়েকজন সাগরেদ। যোগ দিয়েছিল বললে কথাটা সঠিকভাবে বলা হবে না। কার্যত এই নাদিরের নেতৃত্বেই নাকি এই প্রতিরোধকে সংঘটিত করে সৈন্যদের হটিয়ে দেয়ার সম্ভব হয়েছিল।
বংশাল থানায় যেখানে পুলিশদের অস্ত্র কেবল রাইফেল আর বন্দুক, সেখানে মেশিনগান কোত্থেকে এলো এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা ছিলো অনেকদিন। পরে জানা যায় বংশাল এলাকার এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর কথা, যে নাদের গুন্ডা নামে পরিচিত ছিলো! নাদের গুন্ডা ছিলো ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ! পুরো ঢাকায় বেসামরিকভাবে একমাত্র তার কাছেই একটি মেশিনগান ছিলো, সেটা সে কোত্থেকে জোগাড় করেছিলো কে জানে! সেদিন রাতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, নাদির গুন্ডা তখন সেটা দেখে প্রতিহিংসায় উন্মুত্ত হয়ে ওঠে। যখন সে খবর পায় পাক আর্মি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বংশাল এলাকার দিকে এগিয়ে আসছে, নিজের মেশিনগানটি কাধে নিয়ে সে চলে যায় বংশাল ফাঁড়িতে। পুলিশদের নেতৃত্ব দিয়ে বীরত্বে সাথে সে প্রতিরোধ করেছিলো পাক আর্মিদের!
কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও সে বিভিন্ন মহল্লায় রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত। একটা বিষয়ে সে নিঃসন্দেহে ছিল যে, সত্য সত্যই ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে এই মেশিনগান আর অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়েছিল। আর এই নাদির গুন্ডার প্রভাবে একই পথের পথিক আরও কয়েকটি ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকা নাদিরের মনকে বিন্দুমাত্র দমিয়ে দিতে পারেনি।
ওদের সেই পৈশাচিক হত্যা আর ধ্বংসলীলা তাকে প্রতিহিংসায় উম্মত্ত করে তুলেছিল। সারা শহরে হতাশা আর আতঙ্কের আবহাওয়া। তার মধ্যে দুর্জয় সাহস বুকে নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সে প্রতিরোধের কৌশল ও সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তার এই সাহস আর নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মহল্লার লোকেরা তাকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল। তারা বলাবলি করত, এই শহরে নাদিরের মতো আরও গোটা কয়েক মানুষ যদি থাকত, তবে আমরা ওদের নাভিশ্বাস তুলে দিতে পারতাম। নাদিরের নামটা মিলিটারি গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। তারা তন্নতন্ন করে তার সন্ধান করে ফিরেছিল।
বংশাল এরিয়ায় পাক আর্মি যখন রেশনের গুদামে লুটপাট শুরু করে, তখন এই নাদের গুন্ডা দুঃসাহস দেখিয়ে কয়েকটি গুদাম লুটপাট করে সেই রেশন এলাকাবাসীর মধ্যে ভাগ করে বিলিয়ে দেয়, যাতে এলাকাবাসীকে না খেতে পেয়ে মরতে না হয়। পরবর্তীতে গ্যাদা নামের অন্য এক প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী নাদের গুন্ডাকে মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দেয়। মিলিটারি নাদের গুন্ডাকে ধরে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে, সেই নাদের গুন্ডা আর কোনদিন ফিরে আসে নি।
না, নাদেরের কোন রাষ্ট্রীয় পদক নেই, নাদের ছিল নাদের গুন্ডা। মালিটোলার বিখ্যাত নাদের গুন্ডা। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের গুন্ডা-মাস্তান’দের আভিজাত্য ছিল বৈকি। ছিল পরমত সহিষ্ণুতা। ছিল মুরুব্বিদের প্রতি অন্তর থেকে সম্মান। বর্তমানের ছ্যাঁচড়া, লুম্পেনদের সাথে নাদের গুন্ডাকে মেলাবেন না কেউ। নাদের হল ঢাকা কেন্দ্রিক গেরিলা যোদ্বাদের মাঝে সবচেয়ে কম পরিচিত নাম। আমাদের বানানো ইতিহাসে নাদের গুণ্ডার ঠাই হয়নি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.