বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হলেও টাকা মেরে দেওয়াতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন এনামুল হক। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচনের সময় কমিশনে তার জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানে তার ঋণ ছিল ৩৭ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তবে তিনি ঋণ খেলাপি ছিলেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ওই আসন থেকে নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এ সময় জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি দাবি করেন, তার ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ঋণই নেই।
এর মাত্র পাঁচ বছর পর প্রকাশিত দেশের শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকায় পাওয়া গেল সেই এমপি এনামুলের নাম। ১২ সেপ্টেম্বর, বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে উঠে আসে এনামুল হকের প্রতিষ্ঠান নর্দান পাওয়ার সল্যুশন লিমিটেডের নাম!
শুধু এই সংসদ সদস্যই নন, ঢাকা-১৪ আসন (মিরপুর) থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত মো. আসলামুল হকের প্রতিষ্ঠানও এই শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে। যদিও নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দাবি করেছিলেন, তিনি ঋণ খেলাপি নন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, আসলামুল হক মায়িশা প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, আসওয়াত কনজ্যুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড এবং ডেকিং করপোরেশন লিমিটেডের মালিক ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পর্যন্ত তিনি আরও ১৪টি প্রতিষ্ঠানের মালিক হন। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তার নাম উঠে এলো শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের মধ্যে রাজশাহীর ৪ নম্বর (বাগমারা) আসন থেকে এনামুল হক এবং ঢাকা ১৪ নম্বর আসন থেকে মো. আসলামুল হকও ছিলেন। তারা দুজনেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তারা এই দুই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
এনামুল হক সমাচার
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, এনা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এনা বিল্ডিং প্রোডাক্ট লিমিটেড, এনা এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড, সালেহা ইমারত এগ্রিকালচার লিমিটেড, সালেহা ইমারত কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড, এনা এনার্জি লিমিটেড এবং নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেডের পরিচালক রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হক।
অবশ্য নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার এসব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেননি এনামুল হক। ওই সময় তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে কোন ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান থেকে কত টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করলেও তার কোন প্রতিষ্ঠানের নামে কত টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, সেসব বিস্তারিত তুলে ধরেননি এনামুল হক।
নবম জাতীয় সংসদের হলফনামা অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ, সোসাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড থেকে ৭০ লাখ, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড থেকে ১৬ কোটি, পিপলস লিজিং থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ, ব্যাংক আল-ফালাহ লিমিটেড থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ, ডিবিএইচ থেকে ২ কোটি, ফিনিক্স ফাইন্যান্স থেকে ১ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৭ কোটি ৬০ লাখ এবং কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ঋণ নেন এনামুল হক।
সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডে ব্যক্তিগত ঋণ ছিল ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং আইডিএলসিতে যৌথ ঋণ ছিল তার ৫০ লাখ টাকা।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় এনামুল হকের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির অভিযোগে উঠে। অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৪ সালে ২২ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কর ফাঁকির বিষয়টি দেখার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর), সেখানে কিছু করার নেই দাবি করে দুদক অব্যাহতি দেয় এনামুল হককে।
২০০৮ সালে এনামুল হক ও তার ওপর নির্ভরশীলদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৬৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। প্রায় পাঁচ বছরে ৬ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার ৯৫৫ টাকা বেড়ে ২০১৪ সালে এনামুল হক ও তার ওপর নির্ভরশীলদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫ টাকা।
এ বিষয়ে কথা বলতে এনামুল হককে ফোন করা হলে তিনি পরে ফোন করার জন্য বলেন। কিন্তু পরে ফোন করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আসলামুল হকের যত প্রতিষ্ঠান
২০০৮ সালের ২০ নভেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা জমা দেন মো. আসলামুল হক। এই হলফনামা অনুযায়ী, মায়িশা প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও ব্যক্তিগত ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ ছিল তার। ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, আসলামুল হক ও তার স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠান থেকে জামানতবিহীন ঋণের পরিমাণ ৪ কোটি ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। নবম ও দশম হলফনামা অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হওয়ার সুবাদে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেননি বলে উল্লেখ করেন আসলামুল হক।
দশম জাতীয় সংসদে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, চারটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলামুল হক। তার পরিচালিত চারটি প্রতিষ্ঠান হলো ডাইকিং করপোরেশন লিমিটেড, এশিয়া শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, ক্রিস্টাল রেডি মিকস লিমিটেড এবং মাহিম ট্রেড লিংক লিমিটেড।
মায়িশা প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, আসওয়াত কনজ্যুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড, হাই-টেক অ্যাগ্রো অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার লিমিটেড, ঢাকা নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটি কোম্পানি লিমিটেড, মাহিম লেজার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, মাহিম রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, আরিশা টেলি-কমিউনিকেশন লিমিটেড, মাহিম শিপিং লাইনস লিমিটেড, মায়িশা গ্রুপ লিমিটেড, ইন্টারলিংক রি-সাইকল লিমিটেড এবং মাহিম ড্রেজিং অ্যান্ড মেরিন টেকনোলজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলামুল হক।
হলফনামা অনুযায়ী, ২০০৮ সালে মো. আসলামুল হক ও তার ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রায় পাঁচ বছরে ৮ কোটি ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ৯৭ টাকা বেড়ে ২০১৪ সালে আসলামুল হক ও তার ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ কোটি ২৯ লাখ ৯ হাজার ৯৭ টাকায়।
ঋণ খেলাপির তালিকায় নাম আসা প্রসঙ্গে মো. আসলামুল হক প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ঋণ খেলাপির যে অভিযোগ উঠেছে, ওই হিসাব সঠিক না। যা আসছে, ওটা জুন মাসের হিসাব। অ্যাকাউন্ট এখন রেগুলার (নিয়মিত) আছে। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’
হলফনামায় এই দুই এমপিই বলেছিলেন, ‘আমি শপথপূর্বক বলিতেছি যে, এই হলফনামায় প্রদত্ত যাবতীয় তথ্য এবং এতদসঙ্গে দাখিলকৃত সকল দলিল, দস্তাবেজ আমার জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে সম্পূর্ণ সত্য ও নির্ভুল।’
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.