বাংলায় মগের মুল্লুক ও ঢাকার মগবাজার
শিল্পীর কল্পনায় মগদের নৌকা
স্বেচ্ছাচারিতা বা অরাজক অবস্থা বোঝাতে আমরা আজো বলি ‘মগের মুল্লুক!’ ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই পর্তুগিজ আর মগ জলদস্যুরা মিলে বাংলাদেশে যে অবস্থা সৃষ্টি করেছিল—তা বর্ণনার অতীত। তাদের অত্যাচারে চট্টগ্রাম থেকে বর্তমানের সাতক্ষীরা পর্যন্ত গোটা উপকূল সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। এমনকি উপকূলীয় এলাকা থেকে ঢাকা পর্যন্ত নদ-নদীর দুইধারের গ্রামগুলোও মনুষ্য বসবাসের যোগ্য ছিল না।
এরা নদীপথে চলাচল করত এবং গ্রামের পর গ্রামে লুটপাট চালাত। হেন অপকর্ম নেই, যা তারা করতে পারত না। লুটপাটের পর বাকি সবই তারা আগুন দিয়ে ছাই বানিয়ে রেখে যেত। যুবা, নারী-পুরুষদের তারা ধরে নিয়ে যেত দাস বানিয়ে রাখতে বা অন্য কোথাও বিক্রি করে দিতে। নারীরাই তাদের শিকার হত সবচেয়ে বেশি। এভাবে বাংলার কত হতভাগিনীর যে কপাল পুড়েছে, সে ইতিহাস আর জানা যাবে না কোন দিন। পিতা-মাতা, স্বামী-সন্তান ছেড়ে তাদের চলে যেতে হত দূর দেশে।
আর কখনো আপনজনদের কাছে ফেরা হত না তাদের। লুণ্ঠনের পর যুবক-যুবতীদের হাতের তালু ও পায়ের পাতা ফুটো করে বেত দিয়ে বেঁধে নৌকা বা জাহাজের পাটাতনের নিচে গাদাগাদি করে ফেলে রাখত হাঁস-মুরগির মত। এ বন্দর থেকে আরেক বন্দরে নিয়ে যেত তাদের বিক্রি করার জন্য। তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হত, জীব-যন্তুর সঙ্গেও তেমন আচরণ করতে যে কোন মানুষেরই বিবেকে বাধে। মগদের অবশ্য বিবেক বলে, হূদয় বলে কিছু ছিল না। এমন জঘন্য ও পিশাচ প্রকৃতির মানুষ পৃথিবীতে সচরাচর দেখা যায় না। পর্যটক সোবাস্তিয়ান মানরিকের বিবরণে আছে, ১৬২৯ থেকে ১৬৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১৮ হাজার মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে দিয়াঙ্গা ও আরাকানে বিক্রি করা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশে এসব অপকর্মে পায়োনিয়ার ছিল পর্তুগিজ জলদস্যুরা। তারাই আগে বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
কথায় বলে রতনে রতন চেনে। কথাটা পর্তুগিজ জলদস্যু আর মগদের বেলায় ষোল আনা খাটে। পর্তুগিজ জলদস্যুরা যখন চট্টগ্রাম পেরিয়ে আরাকানে পৌঁছাল, মগদের সঙ্গে দ্রুতই গলায় গলায় ভাব হয়ে গেল তাদের। এই উভয় জাতিই পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকা বা জাহাজে যাযাবর জীবন যাপন করত এবং লুটপাট, ডাকাতি, অপহরণ—ইত্যাদিই ছিল তাদের মূল পেশা।
ফলে এই দুই ত্রাস একত্র হতে পেরে বাংলার বুকে অপকর্মের বন্যা বইয়ে দিল। যামিনীমোহন ঘোষের ‘মগ রেইডার্স ইন বেঙ্গল’ এবং বার্নিয়েরের ভ্রমণকাহিনীতে মগদের অত্যাচারের কাহিনী পড়লে আজো গা শিউরে ওঠে। শিহাবউদ্দিন মোহম্মদ তালিশ নামে মীর জুমলার এক রাজকর্মচারীর লেখাতেও বাঙ্গালিদের ওপর মগদের নির্মম অত্যাচারের বিবরণ আছে। বারোভূঁইয়ারা এসব মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যু দমনে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন বটে তবে তাদের পক্ষে পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হয়নি।
বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠালগ্নে বারোভূঁইয়ারা দুর্বল হয়ে পড়লে মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। মোগল আমলেই মগরা তিন তিনবার ঢাকা লুণ্ঠন করে। যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাসে লেখা হয়েছে, ‘নবাব খানজাদ খাঁ এরূপ ভীরু স্বভারের লোক ছিলেন যে, তিনি মগের ভয়ে ঢাকা নগরীতে অবস্থান করিতেন না। মোল্লা মুরশিদ ও হাকিম হায়দারকে ঢাকায় প্রতিনিধি নিযুক্ত করিয়া তিনি রাজমহলে অবস্থান করিতেন।’ মগরা ঢাকা আক্রমণ করলে এই দুই প্রতিনিধি নগরী রক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। যতীন্দ্রমোহন লিখেছেন, ‘মগী সৈন্যের তাণ্ডব নৃত্যে ঢাকা শহর টলটলায়মান হইয়াছিল। উহারা নগর ভস্মসাত্ করিয়া প্রচুর ধনরাশি লুণ্ঠন ও আবালবৃদ্ধনির্বিশেষে বহুলোক বন্দী করিয়া চট্টগ্রাম প্রদেশে লইয়া যায়।’ ইতিহাসে তিনবার ঢাকা লুণ্ঠনের উল্লেখ থাকলেও কেবল ১৬২০ সালে হামলার বিবরণ পাওয়া যায়।
বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ’র অন্যতম মহত্ কীর্তি হল এই মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের কবল থেকে এদেশের বাসিন্দাদের রক্ষা করা। ১৬৬৪ সালে বাংলার শাসনভার হাতে নিয়েই তিনি প্রথম নজর দেন এসব ইতর জলদস্যু দমনে। ১৬৬৫ সালে তিনি এদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন এবং ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম জয়ের মাধ্যমে তিনি এদের সমূলে বিনাশ করেন। বাংলায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে চলে আসা ‘মগের মুল্লুকের’ অবসান ঘটে তার এই অভিযানেই। এজন্য শায়েস্তা খাঁ এদেশের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ঢাকা নগরীতে মগবাজার নামের সঙ্গে মিশে আছে এই মগদেরই স্মৃতি। তবে তারা এই জায়গাটি দখল করে বসেছিল, তা নয়। এই নামের উত্পত্তি কিভাবে, তা নিয়ে একাধিক মত থাকলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হল, ইংরেজ আমলে আরাকান থেকে কিছু মগ ব্রিটিশ রাজের আশ্রয় কামনা করেছিল। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তত্কালীন ঢাকা শহর থেকে তিন মাইল উত্তরে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করেন। সেই মগরা যেখানে বসবাস করত, সেই এলাকাটিই এখন সবার কাছে মগবাজার নামে পরিচিত।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.