বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাস
চট্টগ্রাম বন্দর, ছবি- Jagonews24
চট্টগ্রামের বয়স প্রায় ৪ হাজার বছরের চেয়েও বেশী বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন নব্য প্রস্তরযুগেও এ অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। সে সময়কার বেশ কিছু নির্দশন ঐতিহাসিকগণ খুঁজে পেয়েছেন। তার মধ্যে সীতাকুন্ডে পাওয়া একটি প্রস্তরীভূত তলোয়ার, এটি নব্য প্রস্তর যুগের একটি নির্দশন। তবে এই সময়কার তেমন একটা নির্দশন পাওয়া যায় না। তাই ধারণা করা হয় যে, এ অঞ্চলে বসবাস করা অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোষ্ঠী মানুষেরা বসবাস করত। তবে তারা এখানে খুব বেশী টিকতে পারে নি বা বসবাস করতে পারেনি বলেই ধারণা করা হয়।
প্রাচীন মিসরের বিভিন্ন নথিপত্রের মধ্যেও চট্টগ্রামের সম্পর্কে জানা যায়। এমনি গ্রিক ভৌগলিকদের লেখায়ও চট্টগ্রামের কথা জানা যায়। সে থেকে ধারণা করা হয় এ চট্টগ্রামের বয়স আনুমানিক ৪ হাজার বছর। ঐতিহাসিক বৌদ্ধ লামা তারানাথ তার বইয়ে লেখেন যে, চট্টগ্রাম ছিল চদ্রগুপ্ত বংশের রাজধানী। আরবের ভৌগলিকগণ চট্টগ্রাম কে “সমুন্দর” বলে অভিহিত করেছেন। তখন এ অঞ্চলে পাল শাসণামল ছিল।
পাল আমলের নিদর্শন, ছবি- commons.wikimedia.org
রাজা ধর্মপাল ছিলেন তৎকালীন পাল বংশের রাজা। নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ে আরাকানের রাজা, চট্টগ্রাম কে দখল করে নেন। তখন তিনি একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। যাতে চিৎ-ত-গৌং লিখে যার যান,যার বাংলা অর্থ দ্বারায় যুদ্ধ করা উচিৎ নয়। সে থেকে এ অঞ্চলের নাম চট্টগ্রাম হয়েছে বলে মনে করা হয়।
গোড়াপত্তন
আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রামের শহরের গোড়াপত্তন ধরা হয় ১৩৩০ সালে। ১৩৩০ সাল থেকে ই চট্টগ্রাম অঞ্চল গড়ে উঠেছে। ১৩৩৮ সালে বাংলার রাজা ছিলেন ইলিয়াস উদ্দিন মোবারক শাহ্। মূলত তার সময়কালেই এ অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। তার পূর্বে যে সকল ইতিহাস জানা যায়, সে সব ছিল অস্পষ্ট এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল কম। ইলিয়াস উদ্দিন মোবারক শাহ্ এর পর চট্টগ্রাম কে শাসণ করতেন তার পুত্র ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহ্।
তাকে হত্যা করে এ অঞ্চলের ক্ষমতায় বসেন শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। যিনি হচ্ছেন বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। এরপরে চট্টগ্রামকে শাসণ করেছেন বিভিন্ন হিন্দু রাজারা। চট্টগ্রাম অঞ্চলকে অনেক রাজ বংশ, অনেক রাজা, অনেক নবাব শাসণ করেছেন। চট্টগ্রামের ক্ষমতা বার বার পরিবর্তনের কারন ছিল ভৌগলিক ভাবে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
পর্তুগিজদের আগমণ
চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বের কারনে বিশ্বের অনেক দেশের বণিক বাণিজ্য করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে মালামাল নিয়ে আসতেন। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর। এ অঞ্চলের গুরুত্ব অনুধাবণ করে ১৫ শতকের শুরুর দিকে পর্তুগিজরা বাংলায় আসতে শুরু করেন। তখন বাংলার শাসক ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ। পর্তুগিজদের বাংলায় আগমণের উদ্দেশ্য ভালো ছিল না কখনোই। পর্তুগিজরা ছিল দস্যূ জাতি। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাণিজ্যের নাম করে গিয়ে ডাকাতি করত। বাংলাতেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
শিল্পীর তুলিতে পর্তুগিজ জলদস্যুদের জাহাজ, ছবি- Gyaani
তবে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ্ বিষয় টি বুঝতে পারেন এবং পর্তুগিজদের দমন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই একই সময়ে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে, আফগান শাসক শের শাহ্ বাংলা আক্রমণ করবেন। শের শাহ্ ছিলেন বাংলার শাসকের চেয়ে শক্তিশালী, তাই গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ্ এই আক্রমণের ভয়ে পর্তুগিজদের সাহায্য কামনা করেন। তখন পর্তুগিজরা চতুরতার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারা সাহায্যের বিনিময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কতৃত্ব চান। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ কোন কিছু না ভেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে পর্তুগিজদের হাতে তুলে দেন। পর্তুগিজরা সেখানে একটি বাণিজ্য কুটির নির্মাণ করেন এবং শুল্ক আদায়ের অধিকার পান। তবে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর পরাজয় হয় ১৫০৮ সালে শের শাহ এর সেনাপতির হাতে। তিনি চট্টগ্রাম দখল করে নেন এবং চট্টগ্রাম শাসন করেন।
আরাকানি শাসণ
শের শাহ্ এর মুঘলদের হাতে পরাজিত হওয়ার পর চট্টগ্রামে আরাকান রাজাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় মুঘলরা এতদূরে নিয়ন্ত্রণ করার মত অবস্থায় ছিল না। আরাকান রাজারা ১৫৮১ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম এবং এর আশে পাশে শাসণ করেন সম্পূর্ণ কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। তবে এ সময়ও পর্তুগিজদের দস্যূগিরি চরম আকারে বেড়ে গেলে আরাকান রাজা তাদের শক্ত হাতে দমন করেন।
চট্টগ্রামে আরাকানি শাসনের কাল্পনিক চিত্র, ছবি- বণিকবার্তা
চট্টগ্রামে আরাকানি বা মগদের শাসণ খুব ই গুরুত্বপূর্ণ। আরাকানিরা এ অঞ্চলে শাসণ করার সময় অনেক মানুষ চট্টগ্রাম থেকে আরাকানে বসতি স্থাপন করেন। এর ফলে আরাকানে মুসলিম বসতি গড়ে উঠে। আরাকানদের প্রচলিত বিভিন্ন রীতি-নীতি আজও চট্টগ্রামে দেখা যায়। যেমন জমির পরিমাপে আজও মগী কানির ব্যবহার হয়ে থাকে, কিছুকাল পূর্বে আরাকানি বর্ষপুঞ্জিও চট্টগ্রামে ব্যবহৃত হত। চট্টগ্রামের অনেক জ্ঞানী গুনি মানুষের স্থান হয়েছিল আরাকান রাজার দরবারে, তার মধ্যে মহাকবি আলাওল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুঘল শাসণ
দিল্লির মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান কে চট্টগ্রাম দখল করার জন্য নির্দেশ দেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের এর নির্দেশ দেওয়ার পর সুবেদার শায়েস্তা খান এর পুত্র উমেদ আলী খান আরাকানিদের পরাজিত করে, চট্টগ্রাম দখল করেন।
এ সময় পর্তুগিজরা মুঘলদের সহায়তা করেন। তবে মুঘল শাসকেরা যতদিন চট্টগ্রাম শাসণ করেছে , আরাকানিরা ততকাল বার বার চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করেছেন। তবে তারা বার ব্যর্থ হয়েছেন। আরাকানিরা ইংরেজদের সাথে যুক্ত হয়ে বার বার চেষ্টা করেছেন চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার তবে কখনো সফল হতে পারেন নি।
নবাবী শাসন
মুঘলদের শাসনামলের পর চট্টগ্রামকে শাসন করতেন বাংলার কয়েক জন নবাব। বাংলার নবাবদের শাসনামলে মগরা চট্টগ্রামে অভিযান চালায় তবে তারা এবার ব্যর্থ হন। চট্টগ্রাম কে শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে শাসণ করেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের পর প্রায় ২০০ বছর ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মত ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়।
শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, ছবি- bahumatrik.com
ইংরেজ শাসণ
পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর এর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজিত হন। তারা পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা নবাবের আসনে বসান মীর জাফর কে। ব্রিটিশরা মীর জাফর কে চট্টগ্রাম বন্দর কে তাদের হাতে তুলে দিতে বললে মীর জাফর অস্বীকৃতি জানান। ফলে মীর জাফর ইংরেজদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। মীর জাফরকে ক্ষমতা হতে সরিয়ে নবাবের পদে বসানো হয় মীর কাসিম কে। মীর কাসিম ১৭৬১ সালে নবাবের আসনে বসার পর চট্টগ্রাম বন্দরকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেন। ইংরেজরা এর নাম দেন “চিটাগাং”।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মত চট্টগ্রামও ইংরেজদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ফলে ইংরেজরা তাদের ইচ্ছা মত চট্টগ্রামের মানুষের উপর কর ধার্য করেন। তবে ইংরেজদের এসব অন্যায়কে প্রতিরোধ করার মত তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। যার ফলে ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর এ অঞ্চল শাসন করে নির্বিঘ্নেই। ইংরেজরা এ অঞ্চল হতে নিয়েছেন বেশী আর দিয়েছেন খুব ই সামান্য। তবে ইংরেজ শাসণের সময় চট্টগ্রাম অবকাঠামোগত এবং শিক্ষাগত উন্নয়ন সাধিত হয়।
চট্টগ্রাম প্রায় চার হাজার বছরের জনপদ, এই চারা হাজার বছরে অনেক রাজাগণ চট্টগ্রাম শাসণ করেছেন। চট্টগ্রামের শাসণামলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি এবং সবচেয়ে লাভ হয়েছে ইংরেজ শাসণামলে। ইংরেজরা একদিকে চট্টগ্রাস বন্দর কে ব্যবহার করে এ উপমহাদেশ হতে বিশ্বের নানা বন্দরে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছিলেন, তারপরও আবার চট্টগ্রামের মানুষের চাপিয়ে দিয়েছিলেন উচ্চহারে কর। এ উচ্চহারের করের ফলে অনেক জমিদার পরিবার গরীব হয়ে পড়ে।
তারা এ অঞ্চল হতে আরাকানের সাথে সরাসরি ব্যবসা করতেন ফলে ইংরেজ বণিকদের অর্থ সম্পদ ফুলে ফেপে উঠে, অন্য দিকে দরিদ্র হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ।
তবে এত সব খারাপের মাঝে ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে হোক বা দায়বদ্ধতা থেকেই হোক তারা চট্টগ্রাম কে তৎকালীন সময়ে অবকাঠামোগত ভাবে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটান,এ সময় তারা রাস্তা-ঘাট, বিভিন্ন ইমারত, ব্রিজ ইত্যাদি নির্মাণ করেন। এ সময় তারা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে এ অঞ্চলের মানুষদের শিক্ষার আলো দিয়ে যান। ইংরেজরা বাংলা থেকে নিয়ে গেছে সম্পদ, দিয়ে গেছে সভ্যতা।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.