গল্পঃ মানবী।
তাকে বলা আমার কথাগুলোয় কল্পনা কবিত্যের বাষ্পটুকুও কখনো ছিলো না। আমি তাকে কখনো আমার স্বামর্থের বাইরে স্বপ্ন দেখাইনি। কল্পলোকের রঙিন ডানায় ভর করে কখনো তাকে বিলাসী জীবনের অলিক স্বপ্নে বিভোর করিনি। বরং শিখিয়েছি সোনার থালার কথা ভুলে কিভাবে আটপৌঢ়ে সিরামিকের বাসনে খাওয়ার অভ্যেস রপ্ত করা যায়। নামি রেষ্টুরেন্টের আলো আঁধারির খুপড়ি ঘরে আমাদের বসা হয়েছে কদাচিৎ। বরং আমি তাকে শিখিয়েছি রাস্তার পাশে ঝুপড়ি দোকানে এঁটো বাসনে ফুছকা খেয়ে তৃপ্ত থাকা থাকা যায়। নির্জন পার্কের বেঞ্চিতে বসে প্রেমিক যখন তার প্রেয়সির হাতখানি পরম মমতায় ধরে রেখে রঙিন স্বপ্নের জাল বুনে, আমি তখন নির্বিকার চিত্তে বাস্তবতার কথা ভাবি। আমার বাস্তবমুখী চিন্তায় তার মানসপটে কখনোই যে বিরুপ চিন্তার উদয় হতো না তা নয়, কিন্তু কি জানি কেন সে কখনোই আমাকে এসব নিয়ে অভিযোগ করতো না। জগতের বহু ভালো গুনের মতোই প্রেয়সীর মন জয় করার দুরুহ গুনটি থেকেও বিধাতা আমাকে বঞ্চিত করেছে, তার জন্য আমি কখনো বিধাতাকে দোষারোপ করিনি। সেও আমাকে করেনি। কি জানি হয়তো আমার মতো একজন নিরস মানুষকে সে তার অলঙ্ঘনিয় নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছিলো।
গল্প বলার আগে তার একখানি যুতসই নাম ঠিক করা দরকার। এ যাবত আমি তাকে উপস্থাপন করেছি সর্বনামে। কিন্তু সর্বনামে ভাবটাকে ঠিকঠাক প্রকাশ করা যায় না। অথচ তার নামটাও পারিপার্শ্বিক কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা নাম তো অন্তত তার পাওয়ার অধিকার আছে। আমি তার নাম দিলাম 'মানবী'। কেবল মাত্র মানবের বিপরীত লিঙ্গের কারনেই তার নাম মানবী নয়, 'মানবী' শব্দটি নারীর পূর্নতার প্রকাশ। আমি বিশ্বাস করি সব রমনির মধ্যে নারী বাস করে না। সব নারী রমনি হলেও, সব রমনি নারী হতে হলে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট অর্জন করতে হয়। তার মাঝে একজন পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠার সব রকম গুনাবলীই বিদ্যমান ছিলো। সুতরাং 'মানবী' নামে তাকে অনায়াসেই সম্বোধন করা যায়।
মানবীর সাথে আমার মানসিক বৈপরিত্ব ছিলো যোজন যোজন। আমি যখন মার্কসবাদ নিয়ে চিন্তা করি, সে তখন পত্রিকার বিনোদন পাতায় খোঁজে হলিউডের কোন অভিনয় শিল্পি এবার অস্কারের জন্য মনোনিত হলো। আমি যেখানে ভাওয়াইয়া-ভাটি আর লালনের গানে নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শেকরের সন্ধান করি, মানবি সেখানে গুনগুন করে আওড়ায় মাইকেল জ্যাকসনের কোন পপ। আমি যখন শিল্প-সাহিত্যে জীবনের অর্থ খুঁজি, সে তখন পশ্চিমা ঢংয়ে পরিপূর্ণ আনন্দ পায়। বৃষ্টিস্নাত কোন হঠাৎ পাওয়া মধ্যাহ্ন অবসর দিনে আমি যদি বারান্দার জানালার গ্রীল ধরে উদাস আকাশ পানে তাকিয়ে সুনিলের কবিতায় ভালোলাগা খুজি, মানবীর ভালোলাগা তখন লং ড্রাইভে যেতে যেতে ফুল ভলিওমে হানি সিং এর গান। ভাবছেন এত বিপরীতধর্মী মানসিকতার দু'জন মানুষ এক মোহনায় মিলীত হবে না এতো স্বাভাবিক কথা! কিন্তু এখানেই গল্পের টুইস্ট। একজন মানুষের সাথে যদি আপনার মানসিকতার শতভাগ মিলে যায় তাহলে আপনি জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকে নিয়ে খুব বেশি সুখি হবেন, এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং এরকম ক্ষেত্রে সুখি না হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। যদি তার সাথে আপনার মানসিকতার অমিল থাকে, আপনি নিশ্চই চাইবেন সেই অমিলের জায়গাটি পরম মমতায় ভরাট করতে। অমিল কে মেলানোর চেষ্টার মাঝখানের এই জার্নিটাই রোমাঞ্চ। এর নামই ভালবাসা। যদি মানসিক বৈপরীত্ব থাকা সত্তেও জীবন ধর্মের মাঝপথে আপনার সাথে তার কোন মনোমালিন্য হচ্ছে না, তবে ভাববেন না আপনাদের বোঝাপরা ভালো, বরং ভাবুন যাকে আপনি জীবনসঙ্গী ভাবছেন সে আপনার অর্ধাঙ্গীনি নয়, বরং সে আপনার দাসত্ব করছে। আপনি তার ভালোবাসার মানুষ নয়, বরং অভিবাভকের দায়িত্ব পালন করছেন। এই সম্পর্কে আপনার নির্ভরতা থাকতে পারে, কিন্তু তৃপ্তি পাবেন না। কিন্তু জীবন ধর্মের এই জটিল তত্ত্ব হয়তো আপনি বোঝছেন না। আর বোঝছেন না বলেই আপনি তৃপ্ত থাকছেন।
এই মানসিক দুরত্তগুলো আমরা ঘোচাতে পেরেছিলাম। এই সমস্ত চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমরা কষ্টলব্ধ মোহনায় মিলীত হয়েছিলাম। আমার দীর্ঘ নিঃস্বঙ্গ জীবনে স্নেহের খরা কেটেছিলো। এক স্বপ্নময় সময়ের ডানায় ভর করে উড়ে চলে ছিলাম। জগতের চোখে পা আমার মাটিতেই ছিলো বৈ কি, কিন্তু আমি জানতাম সময়গুলো আমাদের কাটছে জাগতিক সমস্ত প্রপ্তিরও বহু ঊর্ধে। বিত্তের অঢেল আভিজাত্য হয়তো আমার কখনোই ছিলো না, কিন্তু রোজ প্রত্যুশে ঘুম ভাঙার পর আমি উপলব্ধি করতাম চিত্তের যে ঐশ্বর্য্য আমার আছে, তা জগতের বহু মানুষের নেই। আমার মতো আজন্ম বাউন্ডুলে একজন মানুষকে মমতার শৃঙ্খলে সে বাঁধতে পেরেছিলো। এই বন্দিত্ব মুক্ত বিহঙ্গের জন্য কিঞ্চিত অসহ্য হলেও জগতে এর মুল্য আছে। নিজেকে অন্যের ঘাড়ে সঁপে দিয়ে, নিজের জীবনের সমস্ত দেখভালের ভার অন্যের কাধে তুলে দিয়ে নির্ভার হওয়ার মতো সুখ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। সেটা নিজের জন্যও আনন্দের, ভার বাহকের জন্যও পরম প্রাপ্তির। আমাদের দুই পক্ষের ভাবনাটা ঠিক এমনই ছিলো। আপনার ক্ষুধার উদ্রেক হলে আপনি খাবেন। জগতে এই মৌলিক চাহিদার জন্য দেশে দেশে মানুষের এত সংগ্রাম। অভুক্ত মানুষকে খাওয়ার কথা কেউ মনে করিয়ে দিতে হয় না, কিন্তু তবুও "সময় হয়েছে, খেয়ে নাও" এই ছোট্ট কথাটির অন্য একটি মাত্রা আছে। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সিন্ধু সমান মমতা আর অন্ত্যরিক্ষ সমান স্নেহ। "বিকেল হতে চললো, খাওনি কেন? কেন এত অনিয়ম কর?" প্রতি বেলায় শুধু এই একটি অনুযোগ শোনার জন্য কতদিন সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখেও না খেয়ে ছিলাম। কিন্তু সম্পর্কের বেলায় আমি যে খুব বেশি যত্নবান ছিলাম এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারি না। তার মধ্যে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠার প্রচেষ্টা ছিলো, আমার এই বৈরাগ্য জীবনের সমস্ত নিরাসক্তি মেনে নিয়েও সে আমার ভার ঠিকঠাক বয়ে নিচ্ছিলো। অন্যদিকে আমার মধ্য বাস করতো প্রগৈতিহাসিক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। ভাবতাম আমার এই সকল অযাচিত উপদ্রব সহ্য করার জন্য তার পৃথিবীতে আসা। ভাবতাম পুরুষের এই সমস্ত বাউন্ডুলেপনায় মানিয়ে নেয়ায় নারী জীবনের সার্থকতা। মনে হতো আমার এই নিরাসক্ত মানসিকতাই তার নারী জীবনের নিয়ম। ভাবতাম আমাকে ভালোবাসা তার মহত্ত্ব নয়, দায়িত্ব। কিন্তু কখনোই ভাবিনি; দায়িত্ব কেবল একদিক থেকেই হয় না!
হাজারো অভিযোগ-অনুযোগ, বিরহ-ব্যাথার সাথে আমাদের সেই সময়গুলো এক অনিন্দ্য সুন্দর ভালোবাসায় কাটছিলো বেশ, কিন্তু প্রত্যূষের আলো ঝলমলে সুচনায় এ কথা বলা যায় না যে, দিনটি রৌদ্রস্নাত অবস্থায় সাঁঝে মিলাবে। মধ্যাহ্নে দিগন্ত কাঁপিয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝর উঠতে পারে। ভোরের ছবির মতো গোছানো পৃথিবীটা মুহুর্তে লন্ডভন্ড হতে পারে রুদ্র ঝরের বিনাশী ঘূর্ণিপাকে। এরকম একটি ঝর আমাদের জীবনেও এসেছিলো। পার্থক্য শুধু প্রকৃতিতে উঠা ঝর এক সময় থেমে যায়। ঘর হারা মানুষ, নীড় হারা পাখি আবার গুছিয়ে নেয় নিজেদের জীবন, কিন্তু আমরা সেই ঝরের কবল থেকে উঠে আর পুরানো পথে এক সাথে চলতে পারিনি। চেনা পাথে এরপর আর কেউ কখনোই আমাদের দেখেনি এক সাথে।
মানুষ বৈপরিত্বের সাথে যতটা মানিয়ে নিতে পারে, প্রকৃতি হয়তো ততটা পারে না। দুই মেরুর দুটি মানুষকে ভালোবাসা নামক পরশ পাথর একটি বিন্দুতে দাঁড় করিয়েছিলো, কিন্তু এতটা বৈপরিত্বে মানুষ মানিয়ে নিতে পারলেও প্রকৃতি সেটা পারেনি। তাই প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে আমাদের দুজনের জন্য আলাদা দুটি রাস্তা বাতলে দিলো। এ বেলায়ও আমি মানবীর কাছে হেরে বসলাম। সম্পর্কের মাঝে যখন পরিবার এবং সমাজ চলে আসলে, যখন সম্পর্কটি হতে পারে কি পারে না সেই ফয়সালা হলো বিত্তের বাটখারাই, তখন মানবীর এক অবিশ্বাস্য যুদ্ধেংদেহি রুপ দেখলাম। হয়তো জীবনের অন্তিম প্রহরব্যাপি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না এই জন্যই যে, ভালোবেসে তাকে পাওয়ার জন্য পুরুষ হয়ে আমি যতটা করতে পারিনি, একজন নারী হয়ে সে একাই সেটা করে দেখিয়েছে। আমার চির নিরসক্ত মনোভাবই হয়তো তাকে এ পথে চালিত করেছে। এমনই হয়। এরকমই নিয়ম। একের দায়িত্ব যখন সে পালনে ব্যার্থ হয়, প্রকৃতি সেটা অন্যের দ্বারা সম্পন্ন করে নেয় সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তে। ভালো আমিও তাকে বেসেছিলাম। সেও আমাকে বেসেছিলো, কিন্তু দায়টা তার একার ছিলো। তাই যুদ্ধটাও সে একাই করেছে। মাঝে মাঝে ভাবি আমার মতো এমন নিরাসক্ত, অযোগ্য একজন মানুষকে ভালোবাসার দুর্মতি তার কেন হয়েছিলো! পরক্ষনে উত্তর পাই, ভালোবেসে দুঃখ সহ্য করার মধ্যে এক ধরনের মোহ আছে। তৃপ্তি আছে। তবে সেটা আমার মতো নির্জিব মানুষের জন্য নয়, ওর মতো নির্মোহ হৃদয় মানবীর জন্য। হয়তো সে সেই তৃপ্তির সন্ধান পেয়েছিলো। তাই শত সহস্র ব্যাথা-বঞ্চনা সে সহ্য করেছিলো হাসিমুখে। সম্পর্কটাকে পরনতি দিতে যুদ্ধ তো সে করেছিলো, কিন্তু পরনামে জুটেছিলো কেবল মানসিক নির্যাতন। কি সমাজ, কি সংসার এমনকি আমাকেও এই যুদ্ধে সে সহযোদ্ধা হিসেবে পায়নি।
মাঝে মাঝে ওর জন্য ভিষন দুঃখবোধ হতো। আমি তাকে বলতাম, "আমাকে ভালোবেসে দুঃখ ছাড়া তুমি কিছুই পাওনি" সে আমার কথায় কোন প্রতি উত্তর করতো না, শুধু আমার একটি হাত তার জোরা হাতে নিবন্ধ করে বুকের কাছে নিয়ে অবুঝ শিশুর মতো চোখ বন্ধ করে কিছু অনুভব করতো। বুঝতাম না সেই অনুভবে কি ছিলো! শুধু তার প্রগাঢ় নিঃশ্বাসের উঠা নামা টের পেতাম। কোন অভিযোগ, অনুযোগ ছিলো না। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা চাওয়ার স্বার্থটুকুও তার ছিলো না। বুঝতাম পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা বোধহয় একেই বলে। শেষের সময়গুলো তাকে ভিষন ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাতো। বুঝতাম কতটা ঝর-ঝঞ্চা যাচ্ছে এই মেয়েটির উপর। খুব অপরাধবোধ হতো। ভৎসনা করতাম সৃষ্টিকর্তাকে, এতটা অযোগ্য, অথর্ব করে আমার মতো একজন মানুষ সৃষ্টির তার কি এমন আবশ্যকতা ছিলো!
তারপর এলো সেই বিয়োগান্তক দিন। মানবী আমাকে অনুরোধ করেছিলো শেষ কিছু কথা সে বলতে চাই! শেষ দেখাটি যেন আমি তাকে দিই। সেটা শ্রাবণের কোন একটি অঝর বারিপাতের দিন ছিলো। সময়ের বহু আগেই আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আকাশ ষোড়শির দীঘল কালো চুলের মতো ঘন মেঘে অন্ধকার। বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই। আজিকে শ্রাবণ ধারা বন্ধ হবার কোন লক্ষন নাই। বহুদূর হতে একটা হিমেল হাওয়ার ঝাপটা ক্ষনে ক্ষনে হিম শিতল পরশ দিয়ে যাচ্ছে। সন্মুখের অশ্বথ গাছের শাখায় একটা আধ ভেজা শালিক আশ্রয় নিয়েছে। বোধহয় ঝরের কবলে সদ্য নীড় হারিয়েছে। তার অবিরাম চিৎকার শুনাচ্ছিলো প্রিয়হারা কান্নার মত। সুদূর পাহাড়ের কোন গহীন পাদদেশ হতে অরন্যচারী শিয়ালের ডাকে গোটা পরিবেশটা আরো ভারি হয়ে গিয়েছে। বোকা পাহাড় গুলো অনন্যপায় হয়ে বৈরী প্রকৃতির সেচ্ছাচারিতার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানতাম এমন শ্রাবণের আহ্বান সে উপেক্ষা করতে পারবে না। কারণ বৃষ্টি ওর ভিষন প্রিয় ছিলো। আরো কয়কটি প্রহর কাটলো। তারপর সে এলো, কিন্তু এ এক অন্য মানুষ। রণক্লান্ত! এবং বিধ্বস্ত! মনে হলো ঝরের কবলে পড়া কোন আহত পাখি। সেদিন পুরো বিকেলটা সে আমার কাছে ছিলো, কিন্তু এতটা সময়ে সে কেবল এই একটি কথাই বলেছিলো "তোমাকে পাওয়ার জন্য যা করেছি, তার অর্ধেক করলে খোদাকে পেতাম, কিন্তু তোমাকে পাওয়া হলো না"! এমন কথার উত্তর দেয়ার মতো শক্ত হৃদয় জগতে আর থাকতে পারে, তবে আমার ছিলো না। আমি যেমন নিরাসক্ত ছিলাম, তেমনি নির্বিকার রইলাম।
গৌধুলী আলোর শেষ রেসটুকু মিলিয়ে যেতেই সে উঠলো। বিদায় নিয়ে একটু একটু করে সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। আমি পুর্বের মতই নিশ্চল দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখছি। এই প্রথম মনে হচ্ছে তাকে কে আর কখনোই দেখবো না। এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা। বুকের ভিতরটা ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। হৃৎপিন্ডটা মনে হচ্ছে কেউ খামছে ধরেছে। নিজের অজান্তেই দু'ফোটা তপ্তজল নেত্রকোনে অনুভব করলাম। কিন্তু অন্যদিনের মত সে আজ একটি বারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালো না। ওর অভিযোগ ছিলো, ওর জন্য আমি কখনোই চোখের জল ফেলতে পারবো না। তাই আমার এই ব্যথার বস্তুর মুল্য ছিলো। কিন্তু আজ যখন এই চোখ জোড়া বাঁধ ভাঙলো তখন সে আর পিছু ফিরলো না। তাকে দেখানো হলো না আমার মরু দৃষ্টিতেও প্লাবন হতে পারে। ভালো আমিও ওকে বাসি। আমার গোপন ব্যথা গোপনই থেকে গেলো। কিছু মানুষ এমনই ভাগ্যাহত যে, এরা কখনো নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। ভালোবাসা প্রকাশের সবথেকে বড় হাতিয়ার নাকি চোখের জল। কিন্তু বিধাতা এদের সেটাও পর্যাপ্ত দেইনি। প্রচন্ড বিরহে যদিবা কখনো এক-আধ ফোটা নির্গত হয়, তবে যার জন্য এই অশ্রু তার কাছে সেটা চিরকালই অপ্রকাশ্য থেকে যায়।
সেই যাওয়াটাই মানবীর শেষ যাওয়া ছিলো। কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে পূর্নতা দেয়ার চেষ্টা তার এরপরও অব্যাহত ছিলো। সেটা কেবল তার অন্দরের লোকেই জানতো। বিদ্রোহ সে করেছিলো তার পরিবারের সাথে। সেই বিদ্রোহের উত্তাপ আমি বাহির থেকেও পেতাম। ওর কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই ভাবতাম কি দরকার এই যুদ্ধের! দুজন মানুষের ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে এত অনর্থ, এত ঝর-ঝঞ্চায় আমি অসহ্য হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতাম শেষ হয়ে যাক সব। যে সম্পর্কে এত জনের এত আপত্তি, নাই বা হলো সেই সম্পর্কের মিলন। তখন আমার মাথায় আবার পুরানো বাস্তবতার ভুত ভর করেছিলো। তাই মানবীর চোখের জলের উপর আমি সম্পর্কের সামাধি রচনা করতে পেরেছিলাম।
সেই সময় যেখানে ভেবেছি, এই জঞ্জাল দুর হলেই আমি গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ হবো। সেখানে সেই নিরুপায়, অসহায় মেয়েটির জন্য আজ এতদিন পর বাম পাঁজরে তীব্র ব্যাথা অনুভুত হওয়া, নির্ঘুম রাত পার করার কথা শুনলে সমালোচক মহল হয়তো বিরক্ত হবেন। কিন্তু আমি মানুষ বলেই হয়তো নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রন নেই। আর এই জন্যই আমার এই দৈতাচার। মাঝের এতটা সময় তাকে জীবন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে চেয়েছি। জীবন নামক গ্রন্থের প্রত্যেকটি পাতা থেকে তার নামফলক নিজ হাতে মুচে দিতে চেয়েছি। তার একটা সৃতি নষ্ট করার জন্য হাজারটা উপায় খুজেছি। সেদিন নিরুপায়া, নিরাশ্রয়া মেয়েটি হিমালয় সমান অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে স্বেচ্চায় সরে গিয়েছিলো। আমার জীবন থেকে তো বটেই বলা যায় নির্বাসিত একটা জীবন সে বেছে নিয়েছে নিজের জন্যও। আজ ভাবছি এতো অপমানের পরও যে শুধু আমাকেই আকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলো, বিলাস জীবনের চৌকাঠ পেরিয়ে যে আমার মত বৈরাগীর চৌহাদ্দিতে আসতে চেয়েছিলো, হাজার প্রকারের অপমান যে নিরবে সহ্য করেছে সমাজের, নিজের পরিবারের, ক্ষেত্রবিশেষে আমার কাছ থেকেও তার দোষটা ঠিক কোথায়?
বাহ্যিক দৃষ্টিতে সে চলে গেছে। হাসি মুখেই গেছে। আনন্দের সাথেই গেছে। কিন্তু এ লোক দেখানো হাসির পেছনে যে কত বড় ব্যথার উপত্যকা চাপা পরেছিলো সেটা কেবল মর্ত্য লোকের আমি আর অন্ত্যরীক্ষের একজনই বলতে পারে। এ যে কত বড় অভিনয়! নিজের সাথে কত বড় হঠকারীতা সেটা কেবল সেই অকুল পাথারের নি:শ্বঙ্গ যাত্রীই জানে।
রচনাঃ রহমান বর্ণিল।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
গল্প বলার আগে তার একখানি যুতসই নাম ঠিক করা দরকার। এ যাবত আমি তাকে উপস্থাপন করেছি সর্বনামে। কিন্তু সর্বনামে ভাবটাকে ঠিকঠাক প্রকাশ করা যায় না। অথচ তার নামটাও পারিপার্শ্বিক কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা নাম তো অন্তত তার পাওয়ার অধিকার আছে। আমি তার নাম দিলাম 'মানবী'। কেবল মাত্র মানবের বিপরীত লিঙ্গের কারনেই তার নাম মানবী নয়, 'মানবী' শব্দটি নারীর পূর্নতার প্রকাশ। আমি বিশ্বাস করি সব রমনির মধ্যে নারী বাস করে না। সব নারী রমনি হলেও, সব রমনি নারী হতে হলে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট অর্জন করতে হয়। তার মাঝে একজন পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠার সব রকম গুনাবলীই বিদ্যমান ছিলো। সুতরাং 'মানবী' নামে তাকে অনায়াসেই সম্বোধন করা যায়।
মানবীর সাথে আমার মানসিক বৈপরিত্ব ছিলো যোজন যোজন। আমি যখন মার্কসবাদ নিয়ে চিন্তা করি, সে তখন পত্রিকার বিনোদন পাতায় খোঁজে হলিউডের কোন অভিনয় শিল্পি এবার অস্কারের জন্য মনোনিত হলো। আমি যেখানে ভাওয়াইয়া-ভাটি আর লালনের গানে নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শেকরের সন্ধান করি, মানবি সেখানে গুনগুন করে আওড়ায় মাইকেল জ্যাকসনের কোন পপ। আমি যখন শিল্প-সাহিত্যে জীবনের অর্থ খুঁজি, সে তখন পশ্চিমা ঢংয়ে পরিপূর্ণ আনন্দ পায়। বৃষ্টিস্নাত কোন হঠাৎ পাওয়া মধ্যাহ্ন অবসর দিনে আমি যদি বারান্দার জানালার গ্রীল ধরে উদাস আকাশ পানে তাকিয়ে সুনিলের কবিতায় ভালোলাগা খুজি, মানবীর ভালোলাগা তখন লং ড্রাইভে যেতে যেতে ফুল ভলিওমে হানি সিং এর গান। ভাবছেন এত বিপরীতধর্মী মানসিকতার দু'জন মানুষ এক মোহনায় মিলীত হবে না এতো স্বাভাবিক কথা! কিন্তু এখানেই গল্পের টুইস্ট। একজন মানুষের সাথে যদি আপনার মানসিকতার শতভাগ মিলে যায় তাহলে আপনি জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকে নিয়ে খুব বেশি সুখি হবেন, এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং এরকম ক্ষেত্রে সুখি না হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। যদি তার সাথে আপনার মানসিকতার অমিল থাকে, আপনি নিশ্চই চাইবেন সেই অমিলের জায়গাটি পরম মমতায় ভরাট করতে। অমিল কে মেলানোর চেষ্টার মাঝখানের এই জার্নিটাই রোমাঞ্চ। এর নামই ভালবাসা। যদি মানসিক বৈপরীত্ব থাকা সত্তেও জীবন ধর্মের মাঝপথে আপনার সাথে তার কোন মনোমালিন্য হচ্ছে না, তবে ভাববেন না আপনাদের বোঝাপরা ভালো, বরং ভাবুন যাকে আপনি জীবনসঙ্গী ভাবছেন সে আপনার অর্ধাঙ্গীনি নয়, বরং সে আপনার দাসত্ব করছে। আপনি তার ভালোবাসার মানুষ নয়, বরং অভিবাভকের দায়িত্ব পালন করছেন। এই সম্পর্কে আপনার নির্ভরতা থাকতে পারে, কিন্তু তৃপ্তি পাবেন না। কিন্তু জীবন ধর্মের এই জটিল তত্ত্ব হয়তো আপনি বোঝছেন না। আর বোঝছেন না বলেই আপনি তৃপ্ত থাকছেন।
এই মানসিক দুরত্তগুলো আমরা ঘোচাতে পেরেছিলাম। এই সমস্ত চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমরা কষ্টলব্ধ মোহনায় মিলীত হয়েছিলাম। আমার দীর্ঘ নিঃস্বঙ্গ জীবনে স্নেহের খরা কেটেছিলো। এক স্বপ্নময় সময়ের ডানায় ভর করে উড়ে চলে ছিলাম। জগতের চোখে পা আমার মাটিতেই ছিলো বৈ কি, কিন্তু আমি জানতাম সময়গুলো আমাদের কাটছে জাগতিক সমস্ত প্রপ্তিরও বহু ঊর্ধে। বিত্তের অঢেল আভিজাত্য হয়তো আমার কখনোই ছিলো না, কিন্তু রোজ প্রত্যুশে ঘুম ভাঙার পর আমি উপলব্ধি করতাম চিত্তের যে ঐশ্বর্য্য আমার আছে, তা জগতের বহু মানুষের নেই। আমার মতো আজন্ম বাউন্ডুলে একজন মানুষকে মমতার শৃঙ্খলে সে বাঁধতে পেরেছিলো। এই বন্দিত্ব মুক্ত বিহঙ্গের জন্য কিঞ্চিত অসহ্য হলেও জগতে এর মুল্য আছে। নিজেকে অন্যের ঘাড়ে সঁপে দিয়ে, নিজের জীবনের সমস্ত দেখভালের ভার অন্যের কাধে তুলে দিয়ে নির্ভার হওয়ার মতো সুখ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। সেটা নিজের জন্যও আনন্দের, ভার বাহকের জন্যও পরম প্রাপ্তির। আমাদের দুই পক্ষের ভাবনাটা ঠিক এমনই ছিলো। আপনার ক্ষুধার উদ্রেক হলে আপনি খাবেন। জগতে এই মৌলিক চাহিদার জন্য দেশে দেশে মানুষের এত সংগ্রাম। অভুক্ত মানুষকে খাওয়ার কথা কেউ মনে করিয়ে দিতে হয় না, কিন্তু তবুও "সময় হয়েছে, খেয়ে নাও" এই ছোট্ট কথাটির অন্য একটি মাত্রা আছে। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সিন্ধু সমান মমতা আর অন্ত্যরিক্ষ সমান স্নেহ। "বিকেল হতে চললো, খাওনি কেন? কেন এত অনিয়ম কর?" প্রতি বেলায় শুধু এই একটি অনুযোগ শোনার জন্য কতদিন সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখেও না খেয়ে ছিলাম। কিন্তু সম্পর্কের বেলায় আমি যে খুব বেশি যত্নবান ছিলাম এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারি না। তার মধ্যে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠার প্রচেষ্টা ছিলো, আমার এই বৈরাগ্য জীবনের সমস্ত নিরাসক্তি মেনে নিয়েও সে আমার ভার ঠিকঠাক বয়ে নিচ্ছিলো। অন্যদিকে আমার মধ্য বাস করতো প্রগৈতিহাসিক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। ভাবতাম আমার এই সকল অযাচিত উপদ্রব সহ্য করার জন্য তার পৃথিবীতে আসা। ভাবতাম পুরুষের এই সমস্ত বাউন্ডুলেপনায় মানিয়ে নেয়ায় নারী জীবনের সার্থকতা। মনে হতো আমার এই নিরাসক্ত মানসিকতাই তার নারী জীবনের নিয়ম। ভাবতাম আমাকে ভালোবাসা তার মহত্ত্ব নয়, দায়িত্ব। কিন্তু কখনোই ভাবিনি; দায়িত্ব কেবল একদিক থেকেই হয় না!
হাজারো অভিযোগ-অনুযোগ, বিরহ-ব্যাথার সাথে আমাদের সেই সময়গুলো এক অনিন্দ্য সুন্দর ভালোবাসায় কাটছিলো বেশ, কিন্তু প্রত্যূষের আলো ঝলমলে সুচনায় এ কথা বলা যায় না যে, দিনটি রৌদ্রস্নাত অবস্থায় সাঁঝে মিলাবে। মধ্যাহ্নে দিগন্ত কাঁপিয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝর উঠতে পারে। ভোরের ছবির মতো গোছানো পৃথিবীটা মুহুর্তে লন্ডভন্ড হতে পারে রুদ্র ঝরের বিনাশী ঘূর্ণিপাকে। এরকম একটি ঝর আমাদের জীবনেও এসেছিলো। পার্থক্য শুধু প্রকৃতিতে উঠা ঝর এক সময় থেমে যায়। ঘর হারা মানুষ, নীড় হারা পাখি আবার গুছিয়ে নেয় নিজেদের জীবন, কিন্তু আমরা সেই ঝরের কবল থেকে উঠে আর পুরানো পথে এক সাথে চলতে পারিনি। চেনা পাথে এরপর আর কেউ কখনোই আমাদের দেখেনি এক সাথে।
মানুষ বৈপরিত্বের সাথে যতটা মানিয়ে নিতে পারে, প্রকৃতি হয়তো ততটা পারে না। দুই মেরুর দুটি মানুষকে ভালোবাসা নামক পরশ পাথর একটি বিন্দুতে দাঁড় করিয়েছিলো, কিন্তু এতটা বৈপরিত্বে মানুষ মানিয়ে নিতে পারলেও প্রকৃতি সেটা পারেনি। তাই প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে আমাদের দুজনের জন্য আলাদা দুটি রাস্তা বাতলে দিলো। এ বেলায়ও আমি মানবীর কাছে হেরে বসলাম। সম্পর্কের মাঝে যখন পরিবার এবং সমাজ চলে আসলে, যখন সম্পর্কটি হতে পারে কি পারে না সেই ফয়সালা হলো বিত্তের বাটখারাই, তখন মানবীর এক অবিশ্বাস্য যুদ্ধেংদেহি রুপ দেখলাম। হয়তো জীবনের অন্তিম প্রহরব্যাপি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না এই জন্যই যে, ভালোবেসে তাকে পাওয়ার জন্য পুরুষ হয়ে আমি যতটা করতে পারিনি, একজন নারী হয়ে সে একাই সেটা করে দেখিয়েছে। আমার চির নিরসক্ত মনোভাবই হয়তো তাকে এ পথে চালিত করেছে। এমনই হয়। এরকমই নিয়ম। একের দায়িত্ব যখন সে পালনে ব্যার্থ হয়, প্রকৃতি সেটা অন্যের দ্বারা সম্পন্ন করে নেয় সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তে। ভালো আমিও তাকে বেসেছিলাম। সেও আমাকে বেসেছিলো, কিন্তু দায়টা তার একার ছিলো। তাই যুদ্ধটাও সে একাই করেছে। মাঝে মাঝে ভাবি আমার মতো এমন নিরাসক্ত, অযোগ্য একজন মানুষকে ভালোবাসার দুর্মতি তার কেন হয়েছিলো! পরক্ষনে উত্তর পাই, ভালোবেসে দুঃখ সহ্য করার মধ্যে এক ধরনের মোহ আছে। তৃপ্তি আছে। তবে সেটা আমার মতো নির্জিব মানুষের জন্য নয়, ওর মতো নির্মোহ হৃদয় মানবীর জন্য। হয়তো সে সেই তৃপ্তির সন্ধান পেয়েছিলো। তাই শত সহস্র ব্যাথা-বঞ্চনা সে সহ্য করেছিলো হাসিমুখে। সম্পর্কটাকে পরনতি দিতে যুদ্ধ তো সে করেছিলো, কিন্তু পরনামে জুটেছিলো কেবল মানসিক নির্যাতন। কি সমাজ, কি সংসার এমনকি আমাকেও এই যুদ্ধে সে সহযোদ্ধা হিসেবে পায়নি।
মাঝে মাঝে ওর জন্য ভিষন দুঃখবোধ হতো। আমি তাকে বলতাম, "আমাকে ভালোবেসে দুঃখ ছাড়া তুমি কিছুই পাওনি" সে আমার কথায় কোন প্রতি উত্তর করতো না, শুধু আমার একটি হাত তার জোরা হাতে নিবন্ধ করে বুকের কাছে নিয়ে অবুঝ শিশুর মতো চোখ বন্ধ করে কিছু অনুভব করতো। বুঝতাম না সেই অনুভবে কি ছিলো! শুধু তার প্রগাঢ় নিঃশ্বাসের উঠা নামা টের পেতাম। কোন অভিযোগ, অনুযোগ ছিলো না। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা চাওয়ার স্বার্থটুকুও তার ছিলো না। বুঝতাম পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা বোধহয় একেই বলে। শেষের সময়গুলো তাকে ভিষন ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাতো। বুঝতাম কতটা ঝর-ঝঞ্চা যাচ্ছে এই মেয়েটির উপর। খুব অপরাধবোধ হতো। ভৎসনা করতাম সৃষ্টিকর্তাকে, এতটা অযোগ্য, অথর্ব করে আমার মতো একজন মানুষ সৃষ্টির তার কি এমন আবশ্যকতা ছিলো!
তারপর এলো সেই বিয়োগান্তক দিন। মানবী আমাকে অনুরোধ করেছিলো শেষ কিছু কথা সে বলতে চাই! শেষ দেখাটি যেন আমি তাকে দিই। সেটা শ্রাবণের কোন একটি অঝর বারিপাতের দিন ছিলো। সময়ের বহু আগেই আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আকাশ ষোড়শির দীঘল কালো চুলের মতো ঘন মেঘে অন্ধকার। বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই। আজিকে শ্রাবণ ধারা বন্ধ হবার কোন লক্ষন নাই। বহুদূর হতে একটা হিমেল হাওয়ার ঝাপটা ক্ষনে ক্ষনে হিম শিতল পরশ দিয়ে যাচ্ছে। সন্মুখের অশ্বথ গাছের শাখায় একটা আধ ভেজা শালিক আশ্রয় নিয়েছে। বোধহয় ঝরের কবলে সদ্য নীড় হারিয়েছে। তার অবিরাম চিৎকার শুনাচ্ছিলো প্রিয়হারা কান্নার মত। সুদূর পাহাড়ের কোন গহীন পাদদেশ হতে অরন্যচারী শিয়ালের ডাকে গোটা পরিবেশটা আরো ভারি হয়ে গিয়েছে। বোকা পাহাড় গুলো অনন্যপায় হয়ে বৈরী প্রকৃতির সেচ্ছাচারিতার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানতাম এমন শ্রাবণের আহ্বান সে উপেক্ষা করতে পারবে না। কারণ বৃষ্টি ওর ভিষন প্রিয় ছিলো। আরো কয়কটি প্রহর কাটলো। তারপর সে এলো, কিন্তু এ এক অন্য মানুষ। রণক্লান্ত! এবং বিধ্বস্ত! মনে হলো ঝরের কবলে পড়া কোন আহত পাখি। সেদিন পুরো বিকেলটা সে আমার কাছে ছিলো, কিন্তু এতটা সময়ে সে কেবল এই একটি কথাই বলেছিলো "তোমাকে পাওয়ার জন্য যা করেছি, তার অর্ধেক করলে খোদাকে পেতাম, কিন্তু তোমাকে পাওয়া হলো না"! এমন কথার উত্তর দেয়ার মতো শক্ত হৃদয় জগতে আর থাকতে পারে, তবে আমার ছিলো না। আমি যেমন নিরাসক্ত ছিলাম, তেমনি নির্বিকার রইলাম।
গৌধুলী আলোর শেষ রেসটুকু মিলিয়ে যেতেই সে উঠলো। বিদায় নিয়ে একটু একটু করে সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। আমি পুর্বের মতই নিশ্চল দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখছি। এই প্রথম মনে হচ্ছে তাকে কে আর কখনোই দেখবো না। এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা। বুকের ভিতরটা ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। হৃৎপিন্ডটা মনে হচ্ছে কেউ খামছে ধরেছে। নিজের অজান্তেই দু'ফোটা তপ্তজল নেত্রকোনে অনুভব করলাম। কিন্তু অন্যদিনের মত সে আজ একটি বারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালো না। ওর অভিযোগ ছিলো, ওর জন্য আমি কখনোই চোখের জল ফেলতে পারবো না। তাই আমার এই ব্যথার বস্তুর মুল্য ছিলো। কিন্তু আজ যখন এই চোখ জোড়া বাঁধ ভাঙলো তখন সে আর পিছু ফিরলো না। তাকে দেখানো হলো না আমার মরু দৃষ্টিতেও প্লাবন হতে পারে। ভালো আমিও ওকে বাসি। আমার গোপন ব্যথা গোপনই থেকে গেলো। কিছু মানুষ এমনই ভাগ্যাহত যে, এরা কখনো নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। ভালোবাসা প্রকাশের সবথেকে বড় হাতিয়ার নাকি চোখের জল। কিন্তু বিধাতা এদের সেটাও পর্যাপ্ত দেইনি। প্রচন্ড বিরহে যদিবা কখনো এক-আধ ফোটা নির্গত হয়, তবে যার জন্য এই অশ্রু তার কাছে সেটা চিরকালই অপ্রকাশ্য থেকে যায়।
সেই যাওয়াটাই মানবীর শেষ যাওয়া ছিলো। কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে পূর্নতা দেয়ার চেষ্টা তার এরপরও অব্যাহত ছিলো। সেটা কেবল তার অন্দরের লোকেই জানতো। বিদ্রোহ সে করেছিলো তার পরিবারের সাথে। সেই বিদ্রোহের উত্তাপ আমি বাহির থেকেও পেতাম। ওর কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই ভাবতাম কি দরকার এই যুদ্ধের! দুজন মানুষের ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে এত অনর্থ, এত ঝর-ঝঞ্চায় আমি অসহ্য হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতাম শেষ হয়ে যাক সব। যে সম্পর্কে এত জনের এত আপত্তি, নাই বা হলো সেই সম্পর্কের মিলন। তখন আমার মাথায় আবার পুরানো বাস্তবতার ভুত ভর করেছিলো। তাই মানবীর চোখের জলের উপর আমি সম্পর্কের সামাধি রচনা করতে পেরেছিলাম।
সেই সময় যেখানে ভেবেছি, এই জঞ্জাল দুর হলেই আমি গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ হবো। সেখানে সেই নিরুপায়, অসহায় মেয়েটির জন্য আজ এতদিন পর বাম পাঁজরে তীব্র ব্যাথা অনুভুত হওয়া, নির্ঘুম রাত পার করার কথা শুনলে সমালোচক মহল হয়তো বিরক্ত হবেন। কিন্তু আমি মানুষ বলেই হয়তো নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রন নেই। আর এই জন্যই আমার এই দৈতাচার। মাঝের এতটা সময় তাকে জীবন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে চেয়েছি। জীবন নামক গ্রন্থের প্রত্যেকটি পাতা থেকে তার নামফলক নিজ হাতে মুচে দিতে চেয়েছি। তার একটা সৃতি নষ্ট করার জন্য হাজারটা উপায় খুজেছি। সেদিন নিরুপায়া, নিরাশ্রয়া মেয়েটি হিমালয় সমান অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে স্বেচ্চায় সরে গিয়েছিলো। আমার জীবন থেকে তো বটেই বলা যায় নির্বাসিত একটা জীবন সে বেছে নিয়েছে নিজের জন্যও। আজ ভাবছি এতো অপমানের পরও যে শুধু আমাকেই আকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলো, বিলাস জীবনের চৌকাঠ পেরিয়ে যে আমার মত বৈরাগীর চৌহাদ্দিতে আসতে চেয়েছিলো, হাজার প্রকারের অপমান যে নিরবে সহ্য করেছে সমাজের, নিজের পরিবারের, ক্ষেত্রবিশেষে আমার কাছ থেকেও তার দোষটা ঠিক কোথায়?
বাহ্যিক দৃষ্টিতে সে চলে গেছে। হাসি মুখেই গেছে। আনন্দের সাথেই গেছে। কিন্তু এ লোক দেখানো হাসির পেছনে যে কত বড় ব্যথার উপত্যকা চাপা পরেছিলো সেটা কেবল মর্ত্য লোকের আমি আর অন্ত্যরীক্ষের একজনই বলতে পারে। এ যে কত বড় অভিনয়! নিজের সাথে কত বড় হঠকারীতা সেটা কেবল সেই অকুল পাথারের নি:শ্বঙ্গ যাত্রীই জানে।
রচনাঃ রহমান বর্ণিল।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ১ টি