সিলেট যেভাবে আমাদের হলো
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সিলেট আসামের সাথে যুক্ত থেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেও আসামের কট্টরপন্থী কংগ্রেস সরকার সিলেটের সাধারণ নিরীহ মুসলমানদের উপর নানামূখী নির্যাতন চালাতো। বিভিন্ন নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হয়ে সিলেটের আলেম সমাজ তথা সাধারণ মুসলমানগণ কংগ্রেস সরকারের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে তারই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের লক্ষ্যে সিলেটের মুসলিম সমাজ তৎপর হয়ে উঠেন। কিন্তু ভারত বিভক্তির ক্রান্তিলগ্নে আসাম প্রদেশভুক্ত সিলেটে জমিয়তে উলামার একটি দল পাকিস্তানভূক্তির বিরোধী ছিলো। এ কারণে সিলেটবাসীর মতামত যাচাই করার জন্য গণভোটের আয়োজন করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হলে প্রশ্ন ওঠে আসামের অংশ সিলেটের ভাগ্যে কী হবে। এই সমস্যা সমাধান করছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। মুসলমান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করার দায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর।
১৯৪৭ এর ৩রা জুন এক ঘোষণায় তিনি সিলেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের দায়িত্ব দেন স্থানীয় জনসাধারণের কাঁধে। সিদ্ধান্ত হলো গণভোট অনুষ্ঠানের। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ই জুলাই সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে মোট ভোটার ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন। ভোট দিয়েছিল ৭৭ শতাংশ মানুষ।
২৩৯ টি ভোটকেন্দ্রে বড় কোনো ঝামেলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছিল বলেই জানা যায়। নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুরা ছিল কংগ্রেসের পক্ষে। আর মুসলিমরা ছিল মুসলিম লীগের পক্ষে। মুসলিম লীগ সিলেটকে পাকিস্তান তথা আমাদের অংশ করতে চাইছে। কংগ্রেস চাইছে সিলেটকে ভারতের অংশ করতে। "কংগ্রেসের মার্কা ছিল ঘর আর মুসলীম লীগের ছিল কুড়াল। কিছু ব্যাতিক্রমও ছিল। ।হিন্দুদের মধ্যে নমোশূদ্ররা ছিল মুসলীম লীগের পক্ষে আর মুসলিম আলেমদের একদল ছিল কংগ্রেসি। হুসেইন আহমেদ মাদানী আর ওনার একটা গ্রুপ ছিল কংগ্রেসি।
দেশভাগের ইতিহাসে সিলেটের গণভোট এক বিরল ঘটনা। এই ভোটে জয়ী হতে মুসলীম লীগের ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালায়। সিলেটের জনগণকে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল মুসলীম লীগ।
পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়া ফরজ ঘোষণা করে ফতোয়াও জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে উল্লেখ রয়েছে গণভোটের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচশো কর্মী নিয়ে কলকাতা থেকে সিলেট এসেছিলেন।
শেখ মুজিব লিখেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে হিন্দু রায়বাহাদুর আরপি সাহা একাধিক লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়েছিলেন মুসলীম লীগের পক্ষে। লিখেছেন সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করে তারা আবার কলকাতা ফিরে যান।
মুসলমানদের জন্য গণভোট পরিচালনার জন্য একটা রেফারেন্ডাম বোর্ড হয়। সেই বোর্ডের সভাপতি হলেন আব্দুল মতিন চৌধুরী নামে একজন প্রবীণ নেতা। যিনি এককালে জিন্নাহ সাহেবের খুব ঘনিষ্টজন ছিলেন। আর সেক্রেটারি হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুল হাফিজ যিনি বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের বাবা।"
সিলেটে ৬০ ভাগ মুসলিম থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের একটি অংশ (দেওবন্দি) কংগ্রেসপন্থী হওয়ায় ভোটের প্রচার প্রচারণার প্রয়োজন হয়। পাকিস্তানের পক্ষে পড়লো ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯ ভোট আর ভারতে যোগদানের পক্ষে পড়লো ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ ভোট। মুসলীম লীগ ৫৫ হাজার ৫শ ৭৮ ভোট বেশি। এজন্য সিলেটিরা গর্ব অনুভব করে যে আমরা বাই চয়েস পাকিস্তানে আসছি।"
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.