নাঙ্গেলী: মান রক্ষায় এক লড়াকু নারী

নারীদের আজীবন সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের মান রক্ষার জন্য। তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। কোন সময়েই তাদের সঠিক মর্যাদা দেয়া হতো না। আজও হয় না। আজকাল কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে দেখা যায় নারীর স্বাধীনতা(!)। সেই স্বাধীনতার আড়ালে যে কত চাপা কান্না আছে, কত অপমান আছে, কত হেনস্তা আছে তা বলা বাহুল্য। আবার ঝলমলে বিনোদন জগতের কথা তো এখন সবাই বলছে। হলিউড, বলিউড এবং বাংলাদেশেও পরিচালক, প্রযোজক ও নায়কদের অজাচারের কথা কারো অজানা নেই। নারী মানেই ভোগ্যপণ্য। আরো আট দশটা পণ্যের মতই টাকা দিয়ে তাদের কেনা যায়। কিছু পুরুষদের চোখে নারী এমনই।
এবার আসি নাঙ্গেলীর গল্পে। যাকে নিয়ে আজকের আয়োজন। আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগের কথা। ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যে হিন্দুদের মধ্যে এক প্রকার ট্যাক্স বা কর প্রচলিত ছিলো। করটির নাম- ‘স্তনকর বা breast tax’। এর আরেকটি নাম মুলাককারাম (mulakkaram)।
তখন নিয়ম ছিলো ব্রাহ্মণ ব্যতিত অন্য কোন হিন্দু নারী তার স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হিন্দু নারীরা তাদের স্তনকে একটুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো, বাকি হিন্দু শ্রেণীর নারীদেরকে প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো। তবে যদি কোন নারী তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইতো, তবে তাকে স্তনের সাইজের উপর নির্ভর করে ট্যাক্স বা কর দিতে হতো। এই নির্মম করকেই বলা হয় স্তনকর বা ব্রেস্টট্যাক্স।
কেরালায় মহীশুরে রাজত্ব ছিল টিপু সুলতানের। তিনি হিন্দুদের এই জঘন্য প্রথা থেকে নারীদের উদ্ধার করার জন্য ঘোষণা দেন যারা মহীশুরে আসবে তাদের নিরাপত্তা তিনি দেবেন। তারা তাদের ইচ্ছেমত কাপড় পড়তে পারবেন। তার এই ঘোষণায় বহু মানুষ মহীশুরে গমন করেন। এর মধ্যে অনেকেই আবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সেসময় কোন ইসলামে কোন নারী দীক্ষিত হলে বলা হতো সে কাপড় পরেছে।
১৮০৩ সালে নাঙ্গেলী (Nangeli) নামক এক নারী তার স্তনকে আবৃত করে রাখেন। যখন গ্রামের ট্যাক্স কালেকটর তার থেকে স্তনকর চাইতে আসে, তখন নালেঙ্গী তা দিতে অস্বীকার করেন। এসব জঘন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী করের প্রতিবাদ করেন। কিন্তু ট্যাক্স কালেক্টর ও তার পাইক পেয়াদা নাঙ্গেলীর প্রতিবাদকে আমলে নেয়নি। তারা চাপ দিতে থাকে ট্যাক্সের জন্য। নির্যাতন করতে উদ্যত হয়।

তখন নাঙ্গেলী এক অভিনব কাজ করেন। তিনি তার নিজের দুটি স্তনকে ধারালো দা দিয়ে কেটে পাতা দিয়ে মুড়ে ট্যাক্স কালেকটরকে দিয়ে দেন। তখন কাটা স্তন দেখে ট্যাক্স কালেকটর অবাক হয়ে যায়। স্তন কেটে ফেলার কিছুক্ষন পরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য নাঙ্গেলীর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যু শোকে নাঙ্গেলীর স্বামীও সাথে সাথে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় হতচকিত হয় পুরো হিন্দু সমাজ। থমকে দাঁড়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই ঘটনার পর থেকেই স্তনকর রহিত হয়।
তবে স্তনকর রহিত হলেও স্তন ঢাকা নিষিদ্ধই ছিল। দক্ষিণভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত করতে হয়েছে তাদের। ১৯ শতাব্দীর মাঝে এসে যখন কিছু হিন্দু নারী তাদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার দাবি করে, তখন হিন্দু পুরোহিতরা স্পষ্ট করে বলে দেয়, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম বিরোধী।
বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিলো হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। এই দাঙ্গা ‘কাপড়ের’ দাঙ্গা হিসেবে পরিচিত।
ভারতের কেরালা রাজ্যে প্রতি বছর নারী দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় নাঙ্গেলিকে। নিম্নবর্ণের নারীর আত্মমর্যাদা আদায়ের সংগ্রামে আজও নাঙ্গেলি সে রাজ্যে এক এবং অনন্য সৈনিক। নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিম্নবর্ণের নারীর সম্মান।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.