বাংলাদেশের ভয়ংকর পাঁচ ঘূর্ণিঝড়
৯১ এর ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ে নিহত কিছু মানুষ, ছবি: জাগোনিউজ
ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশ আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলের অংশ, যার উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের প্রান্তে রয়েছে অনেকটা চোঙ আকৃতির উপকূলভাগ। বাংলাদেশের এ স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান মৌসুমীবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডো এবং বন্যাও বয়ে আনে। বঙ্গোপসাগর গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ক্ষেত্র।
প্রতিবছরই বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় হয়। আর এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সচেতনতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়াতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমানো সম্ভব হয়েছে। আজ আমরা ভয়ংকর পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানবো।
১৯৭০ (১২-১৩ নভেম্বর)
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণ ও সম্পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। হারিকেনের তীব্রতা নিয়ে প্রচন্ড বাতাস দু’দিন ধরে বারবার আঘাত হানে চট্টগ্রামে এবং সে সঙ্গে বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানউদ্দিন-এর উত্তরাঞ্চল, চর তজিমুদ্দিন, মাইজদির দক্ষিণাঞ্চল ও হরিণঘাটায়। স্মরণকালের সর্বাপেক্ষা বেশি জীবন, সম্পদ ও ফসলের ধ্বংস সাধন হয় এ দুর্যোগে। সরকারি হিসাব মোতাবেক ৫,০০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এবং ৩৮,০০০ সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭৭,০০০ অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এক হিসাবে দেখা যায় যে ৪৬,০০০ জন অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী ঘূর্ণিঝড় চলাকালে মাছ ধরার সময় মৃত্যুবরণ করে। মোট ২০,০০০ এর অধিক মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সম্পদ ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণ বিশাল; দশ লক্ষেরও অধিক গবাদিপশুর মৃত্যু হয়; ৪,০০,০০০ ঘরবাড়ি এবং ৩,৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭০ সালের এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২২২ কিমি এবং জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মিটার। সমুদ্রে ভরাজোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি সংঘটিত হওয়ায় এমন প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৮৫ (২৪-২৫ মে)
তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহে (সন্দ্বীপ, হাতিয়া এবং উড়িরচর) আঘাত হানে। বাতাসের গতিবেগ ছিল চট্টগ্রামে ১৫৪ কিমি/ঘণ্টা, সন্দ্বীপে ১৪০ কিমি/ঘণ্টা, কক্সবাজারে ১০০ কিমি/ঘণ্টা এবং সেইসঙ্গে ৩.০-৪.৬ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এতে ১১,০৬৯ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৯৪,৩৭৯টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও মোট ১,৩৫,০৩৩ পশুসম্পদ বিনষ্ট হয়। মোট ৭৪ কিমি সড়ক ও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৮৮ (২৪-৩০ নভেম্বর)
যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং খুলনা-বরিশালের চরাঞ্চলের উপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কিমি বেগে বায়ুপ্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মংলায় ৪.৫ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এতে ৫,৭০৮ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৬৫,০০০ গবাদিপশু মারা যায়। বহুসংখ্যক বন্য পশু মারা যায় - তার মধ্যে হরিণ ১৫,০০০ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯; এবং ফসল বিনষ্ট হয় প্রায় ৯৪১ কোটি টাকার।
১৯৯১ (২৯ এপ্রিল)
এ ঝড়টিকে ‘১৯৯১-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়’ নামে চিহ্নিত করা হয়। এটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাত্রে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে। ঝড়টির উৎপত্তি হয় প্রশান্ত মহাসাগরে, বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে ৬,০০০ কিমি দূরে। বাংলাদেশের উপকূলে পৌঁছাতে ঝড়টির সময় লেগেছিল ২০ দিন। আকারের দিক থেকে ঘূর্ণিঝড়টির বিস্তার ছিল বাংলাদেশের আকৃতির চেয়েও বড়। কেন্দ্রীভূত মেঘপুঞ্জের ব্যাস ছিল ৬০০ কিমি। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল সন্দ্বীপে ঘণ্টায় ২২৫ কিমি। এ ছাড়া অন্যান্য ঝড় কবলিত অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ ছিল নিম্নরূপ: চট্টগ্রামে ঘণ্টায় ১৬০ কিমি, খেপুপাড়া (কলাপাড়া) ১৮০ কিমি, কুতুবদিয়া ১৮০ কিমি, কক্সবাজার ১৮৫ কিমি এবং ভোলা ১৭৮ কিমি।
নোয়া-১১ (NOAA-11) উপগ্রহের ২৯ এপ্রিল ১৩ঃ ৩৮ ঘণ্টায় তোলা দূর অনুধাবন চিত্র অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের প্রাক্কলিত সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ কিমি। স্পারসো (SPARRSO) সর্বপ্রথম ২৩ এপ্রিল তারিখে নোয়া-১১ এবং জিএমএস-৪ (GMS-4) উপগ্রহগুলি থেকে গৃহীত চিত্র বিশ্লেষণ করে ঘূর্ণিঝড়টিকে একটি নিম্নচাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল (যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিমি এর নিচে)। নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় ২৫ এপ্রিল। প্রাথমিক অবস্থায় ঘূর্ণিঝড়টি কিছুটা উত্তরপশ্চিম দিকে পরে উত্তর দিকে সরে যায়। ২৮ এপ্রিল থেকে এটি উত্তরপূর্ব দিকে সরে আসা শুরু করে এবং ২৯ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের উত্তর দিয়ে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে। ঘূর্ণিঝড়টি ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই উপকূলীয় দ্বীপ সমূহে (যেমন নিঝুম দ্বীপ, মনপুরা, ভোলা, সন্দ্বীপ) আঘাত হানতে শুরু করেছিল। ঘূর্ণিঝড়কালীন ঝড়ো জলোচ্ছ্বাসের প্রাক্কলিত উচ্চতা ছিল ৫ থেকে ৮ মিটার। এ দুর্যোগে জীবন ও সম্পদ ক্ষতির পরিমাণ বিশাল। সম্পদের প্রাক্কলিত আর্থিক ক্ষতি ৬,০০০ কোটি টাকা। মোট ১,৫০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, গবাদিপশু মারা যায় ৭০,০০০।
২০০৭ (১৫-১৭ নভেম্বর) ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভূমিধ্বসের মাধ্যমে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। এ যাবৎকালে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। বঙ্গোপসাগরের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভের পরই ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এ সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২৬০ কিমি সাফাইর-সিম্পসন (Saffire-Simpson scale) অনুযায়ী ৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য।
২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে। ঘূর্ণিঝড় এবং তদুপরি জলোচ্ছাসের প্রভাবে প্রায় দশ সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলাদেশের উপকূলীয় ছাড়াও ভারতের চেন্নাই, তামিলনাড়ু এবং আরও কিছু রাজ্য সিডর এর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সর্বাধিক। বরগুনা, পটুয়াখালী এবং ঝালকাঠি এই তিনটি জেলা একেবারে ৫ মি (১৬ ফুট) উচূঁ ঢেউয়ের আঘাতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। মাছ ধরার নৌকাসহ তিন সহস্রাধিক জেলে নিখোঁজ হয়। শত শত ঘড়বাড়ি,স্কুল বাতাসের তোড়ে উড়ে যায় এবং গাছপালার বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.