মোসাদ: গুপ্তহত্যায় যাদের সেরা কুখ্যাতি
বর্তমান পৃথিবীতে গুপ্তহত্যায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে মোসাদ। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় ফিলিস্তিনি জ্বালানি বিজ্ঞানী ফাদি আল বাতশ নিহত হওয়ার ঘটনায় আবারো সামনে এসেছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। গত শনিবার মসজিদে ফজরের নামাজে যাওয়ার পথে ৩৫ বছর বয়সী ফাদিকে হত্যা করে দুই মোটরসাইকেল আরোহী।
ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানী ও হামাস নেতা ফাদি আল বাতশ, ছবি BBC
ফাদির পরিবার মনে করে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে মোসাদ। গাজা থেকে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর মালয়েশিয়ায় পিএইডি করছিলেন ফাদি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে জ্বালানি বিষয়ে তার একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সাথেও যুক্ত ছিলেন এই বিজ্ঞানী। ইসরাইলি অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোনেন বার্গম্যানের মতে ফাদির হত্যাকাণ্ড মোসাদের হত্যাকাণ্ডের ধরনের সাথে মিল রয়েছে। মোসাদের এমন হত্যাকাণ্ড নতুন নয়। সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে ইসরাইল রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করলে তাকে হত্যা করে মোসাদ। এজন্য তাদের কৌশল ও দক্ষতা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। রয়েছে পেশাদার খুনিদের একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী।
ফাদি আল বাতশের জন্য গাজায় শোকসভা ছবি, dw
ইহুদীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইহুদী, খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র ভূমি বলে পরিচিত বৃহত্তর ফিলিস্তিনকেই বেছে নিয়েছিল নতুন বাসভূমি হিসেবে।কিন্তু আরব ভূখণ্ডে ঘেরা এই শিশুরাষ্ট্রকে রক্ষা করা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না।আর সেই ঐতিহাসিক চাহিদা মেটাতেই রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় ১৯৪৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন গোয়েন্দাসংস্হা মোসাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,কালে কালে যা পরিণত হয় এক দুর্দান্ত গোয়েন্দাসংস্হায়।হিব্রূ ভাষায় মোসাদ শব্দের অর্থ ‘প্রতিষ্ঠান’। আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের এই বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার নাম হয় ‘দ্য ইনস্টিটিউট অব ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস’।
হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে লাখ লাখ ইহুদীর মৃত্যুর পর গোটা দুনিয়ার ইহুদীদের একটি প্রভাবশালী অংশ নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের “স্বপ্নের কর্মসূচি”তে শামিল হয়।১৯৪৮ সালে জাহাজে করে ইহুদীদের পবিত্রভূমি প্যালেস্টাইনে আগমন। এই জায়নিস্ট আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি ইসরায়েল৷ প্রথমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি, তারপর সম্মিলিত আরব শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তিকে ক্রমশঃ আরও শক্তিশালী করে তুলেছে ইসরায়েল৷
ইউরোপে ইহুদী গণহত্যা, ছবি: Quora
ইউরোপে ইহুদী নিধনযজ্ঞ দুঃস্বপ্ন ভুলতে পারে নি সেদেশের মানুষ৷ ফলে আরও একবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে যে কোন পদক্ষেপ নিতে শুরু থেকেই প্রস্তুত ছোট্ট এই ইহুদী রাষ্ট্র৷ কিন্তু নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে ইসরায়েল যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসেছে তাকে ঘিরে বিতর্কের কোন শেষ নেই৷ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ১৯৪৯ সালে মোসাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷তবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই যেসব ইহুদী নিষিদ্ধ সংগঠন সংগ্রাম চালাচ্ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল,তাকে মোসাদের পূর্বসূরি মানা হয়৷
১৯৪৯ সালে মোসাদের জন্ম হলেও ১৯৯৬ পর্যন্ত কেউই জানতোনা এই সংস্হাটার প্রধান কে। ১৯৯৬ সালে যখন সাবতাই কে অপসারন করে ডেনি ইয়াতমকে নিয়োগ দেওয়া হয় এক ঘোষনার মাধ্যমে, তখন প্রথমবারের মত বিশ্ববাসী জানতে পারে এই সংস্হাটার প্রধান কে। ডেভিড বেনগুরিয়ান মুলত এই সংস্হার প্রতিষ্ঠাতা।
ইসরাঈলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান, ছবি:palestinalibre.org
১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ২৮তম কম্যুনিস্ট সম্মেলনে যখন নিকিটা ক্রুশ্চেভ এক গোপন মিটিংয়ে স্টালিনকে অভিযুক্ত ও অস্বীকার করে নিজেই প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষনা করে, ঐ বক্তব্যের এক কপি মোসাদ সিআইএর হাতে দিয়ে দেয়। এই প্রথম সিআইএ মোসাদের কার্যক্রম উপলব্ধি করে যাতে সিআইএ অবিভূত হয়। কারন সিআইএর মত সংস্হাটিও এই রকম একটা সেন্সেটিভ সংবাদ সংগ্রহে ব্যর্থ। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মোসাদকে সাহায্য করার জন্য অগনিত ভলান্টিয়ার। এরা সবাই জন্মগত ইহুদী এবং জায়োনিস্টের সমর্থক। এরা সবসময় তৈরী থাকে শত্রুর তথ্য জানানো বা সন্দেহবাজনদের উপর গোয়েন্দাগিরী করা।
মোসাদের লোগো, ছবি: মোসাদ অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
চরম গোপনীয়তার ঘেরাটোপে থাকা মোসাদের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচারিত থাকলেও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। ইসরায়েলের আইন অনুযায়ী শুধু সংস্থাপ্রধানের নাম প্রকাশ করা যায়। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই পরিচালিত হয় মোসাদের কার্যকলাপ। মোসাদের ওয়েবসাইটে সংগঠনের ‘লক্ষ্য’ এবং ‘কার্যকলাপ’ সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য রয়েছে। তবে মোসাদের হয়ে কাজ করতে ইচ্ছুকদের জন্য একটি ‘ফরম’ রয়েছে ওয়েবসাইটটিতে।
https://www.mossad.gov.il/eng/Pages/default.aspx
এটিই হল মোসাদের ওয়েবসাইট। তবে এ ওয়েবসাইটে নিজ দায়িত্বে ঢুকবেন। কথিত আছে মোসাদের ওয়েবসাইটে ক্লিক করলেই সংস্হায় সংরক্ষিত সার্ভারে মুহুর্তেই আইপি ট্রেস করে লোকেশন ডিটেক্ট করা হয়।
মোসাদ হামলার জায়গায় থাকেনা। বেশীরভাগ সময়েই চেষ্টা করে স্হানীয় মাফিয়া বা সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিজেদের কাজ করে নিতে। যদি মাফিয়াদের দ্বারা সম্ভব না হয় তাহলেই শুধুমাত্র মোসাদের ডেথ স্কোয়াড কাজ করে। ইসরায়েলি সরকারের জন্য কৌশলগত, রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার মতো কাজের বাইরেও মোসাদের কাজের পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত। সংগঠনটির ঘোষিত উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের সীমানার বাইরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো যাতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা এবং দেশে-বিদেশে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
অন্যান্য বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার তুলনায় মোসাদের দায়িত্ব বা কাজের পরিধির বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়৷ যেসব দেশে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনত সক্রিয় হতে পারে না সেই সব দেশ থেকে ইহুদীদের ইসরায়েলে নিয়ে আসার দায়িত্বও পালন করে মোসাদ৷ বিশ্বের যে কোন ইহুদী ব্যক্তির জন্য ইসরায়েলের দ্বার খোলা রয়েছে যেন তারা সেখানেই পাকাপাকি বসবাস করতে পারে৷ ইসরায়েলের সীমানার বাইরে বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনা ও কার্যকর করার বিশেষ দায়িত্বও পালন করে মোসাদ৷
হত্যাকাণ্ডের জন্য টার্গেট নির্ধারণে ইসরাইলি গোয়েন্দারা মোসাদের অভ্যন্তরীণ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়। কখনো কখনো দেশটির অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতারাও যুক্ত থাকে এর সাথে। কখনো টার্গেট চিহ্নিত করে ইসরাইলের অন্য অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা সামরিক বাহিনী। যেমন বিজ্ঞানী ফাদিকে শত্রু হিসেবে তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি হামাসের ওপর নজরদারি করে ইসরাইলের এমন গোয়েন্দা সংস্থা বা সামরিক বাহিনী করতে পারে।
আবার দেশের বাইরে কাজ করা ইসরাইলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও তার বিষয়ে কাজ করতে পারে। বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গাজা, ইস্তাম্বুল ও বৈরুতের মধ্যে হামাসের যে যোগাযোগ চ্যানেল তার ওপর কঠোর নজরদারি করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এই চ্যানেলের মাধ্যমেই ইসরাইল বিজ্ঞানী ফাদিকে টার্গেট হিসেবে শনাক্ত করেছিল বলে মনে করা হয়। ফাদির বন্ধুরা জানিয়েছেন, হামাসের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি গোপন করতেন না।
যেভাবে ঘটে হত্যাকাণ্ড
কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করার পর মোসাদ তাকে হত্যা করা হবে কি না সে ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করে। ওই ব্যক্তির বেঁচে থাকা ইসরাইলের জন্য সমস্যা হবে সেটি মনে করলে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর মোসাদের বিশেষজ্ঞ দল ওই ব্যক্তির ফাইলটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিভাবক সংস্থা ‘ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটি’র প্রধানের কাছে পাঠানো হয়। হিব্রু ভাষায় ভারাশ নামে পরিচিত এই সংস্থাটি।
এ বিষয়ে আলোচনা করে নিজেদের মতামত ও পরামর্শ দেয় ভারাশ। তবে এই অপারেশন অনুমোদনের ক্ষমতা নেই তাদের। এই ক্ষমতা রয়েছে শুধু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ দুই-একজনের সাথে পরামর্শ করেন। অনুমোদনের পর বিষয়টি আবার মোসাদের কাছে যায় পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির জন্য। কখনো কখনো এতে এক সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগে। বিষয়টি নির্ভর করে টার্গেটের অবস্থান ও তার নিরাপত্তার ওপর।
মোসদের অত্যন্ত গোপন একটি বাহিনী কায়সারিয়া ইউনিট। আরব বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে গুপ্তচর মোতায়েন করা তাদের কাজ। ১৯৭০-এর দশকে এই ইউনিটটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাইক হারারি। আরব বিশ্বসহ মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ টার্গেটের ওপর নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ করে কায়সারিয়া। এই ইউনিটের মধ্যে আবার রয়েছে কিডন নামে একটি বাহিনী। যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞে পারদর্শী পেশাদার খুনিদের একটি দল কিডন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের মধ্য থেকে সাধারণত এই লোকদের নেয়া হয়। ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানী ফাদির হত্যাকারীরা সম্ভাব্য কিডন সদস্য বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। কায়সারিয়া ইউনিটের কাজ অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর স্পেশাল এক্টিভিটিস সেন্টারের (এসএসি) মতো। এসএসির মধ্যে আবার স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি) নামে একটি ইউনিট রয়েছে যারা হত্যাকাণ্ড চালায়। সিআইএর এসওজি আর মোসাদের কিডন একই ধরনের ইউনিট।
রোনেন বার্গম্যান লিখেছেন, দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আগ পর্যন্ত ইসরাইল অন্তত ৫০০ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে যাতে নিহত হয়েছে অন্তত এক হাজার টার্গেট ও অন্যরা। আর দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় তারা এক হাজারের বেশি অপারেশন চালিয়েছে যার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়েছে। সব মিলে সেই থেকে হামাসের নেতাদের বিরুদ্ধে সংস্থাটি ৮০০টির বেশি হামলা চালিয়েছে। তবে মোসাদের টার্গেট যে শুধু ফিলিস্তিনিরা তা নয়, সিরিয়া, লেবানন, ইরান এমনকি ইউরোপের কোনো নাগরিককেও হত্যা করতে পারে সংস্থাটি। মোট কথা ইসরাইল বা ইহুদিবাদীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে রয়েছে এমন যে কাউকে হত্যা করতে পারে এই সংস্থাটি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানী ও হামাস নেতা ফাদি আল বাতশ, ছবি BBC
ফাদির পরিবার মনে করে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে মোসাদ। গাজা থেকে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর মালয়েশিয়ায় পিএইডি করছিলেন ফাদি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে জ্বালানি বিষয়ে তার একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সাথেও যুক্ত ছিলেন এই বিজ্ঞানী। ইসরাইলি অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোনেন বার্গম্যানের মতে ফাদির হত্যাকাণ্ড মোসাদের হত্যাকাণ্ডের ধরনের সাথে মিল রয়েছে। মোসাদের এমন হত্যাকাণ্ড নতুন নয়। সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে ইসরাইল রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করলে তাকে হত্যা করে মোসাদ। এজন্য তাদের কৌশল ও দক্ষতা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। রয়েছে পেশাদার খুনিদের একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী।
ফাদি আল বাতশের জন্য গাজায় শোকসভা ছবি, dw
ইহুদীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইহুদী, খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র ভূমি বলে পরিচিত বৃহত্তর ফিলিস্তিনকেই বেছে নিয়েছিল নতুন বাসভূমি হিসেবে।কিন্তু আরব ভূখণ্ডে ঘেরা এই শিশুরাষ্ট্রকে রক্ষা করা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না।আর সেই ঐতিহাসিক চাহিদা মেটাতেই রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় ১৯৪৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন গোয়েন্দাসংস্হা মোসাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,কালে কালে যা পরিণত হয় এক দুর্দান্ত গোয়েন্দাসংস্হায়।হিব্রূ ভাষায় মোসাদ শব্দের অর্থ ‘প্রতিষ্ঠান’। আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের এই বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার নাম হয় ‘দ্য ইনস্টিটিউট অব ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস’।
হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে লাখ লাখ ইহুদীর মৃত্যুর পর গোটা দুনিয়ার ইহুদীদের একটি প্রভাবশালী অংশ নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের “স্বপ্নের কর্মসূচি”তে শামিল হয়।১৯৪৮ সালে জাহাজে করে ইহুদীদের পবিত্রভূমি প্যালেস্টাইনে আগমন। এই জায়নিস্ট আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি ইসরায়েল৷ প্রথমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি, তারপর সম্মিলিত আরব শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তিকে ক্রমশঃ আরও শক্তিশালী করে তুলেছে ইসরায়েল৷
ইউরোপে ইহুদী গণহত্যা, ছবি: Quora
ইউরোপে ইহুদী নিধনযজ্ঞ দুঃস্বপ্ন ভুলতে পারে নি সেদেশের মানুষ৷ ফলে আরও একবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে যে কোন পদক্ষেপ নিতে শুরু থেকেই প্রস্তুত ছোট্ট এই ইহুদী রাষ্ট্র৷ কিন্তু নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে ইসরায়েল যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসেছে তাকে ঘিরে বিতর্কের কোন শেষ নেই৷ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ১৯৪৯ সালে মোসাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷তবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই যেসব ইহুদী নিষিদ্ধ সংগঠন সংগ্রাম চালাচ্ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল,তাকে মোসাদের পূর্বসূরি মানা হয়৷
১৯৪৯ সালে মোসাদের জন্ম হলেও ১৯৯৬ পর্যন্ত কেউই জানতোনা এই সংস্হাটার প্রধান কে। ১৯৯৬ সালে যখন সাবতাই কে অপসারন করে ডেনি ইয়াতমকে নিয়োগ দেওয়া হয় এক ঘোষনার মাধ্যমে, তখন প্রথমবারের মত বিশ্ববাসী জানতে পারে এই সংস্হাটার প্রধান কে। ডেভিড বেনগুরিয়ান মুলত এই সংস্হার প্রতিষ্ঠাতা।
ইসরাঈলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান, ছবি:palestinalibre.org
১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ২৮তম কম্যুনিস্ট সম্মেলনে যখন নিকিটা ক্রুশ্চেভ এক গোপন মিটিংয়ে স্টালিনকে অভিযুক্ত ও অস্বীকার করে নিজেই প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষনা করে, ঐ বক্তব্যের এক কপি মোসাদ সিআইএর হাতে দিয়ে দেয়। এই প্রথম সিআইএ মোসাদের কার্যক্রম উপলব্ধি করে যাতে সিআইএ অবিভূত হয়। কারন সিআইএর মত সংস্হাটিও এই রকম একটা সেন্সেটিভ সংবাদ সংগ্রহে ব্যর্থ। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মোসাদকে সাহায্য করার জন্য অগনিত ভলান্টিয়ার। এরা সবাই জন্মগত ইহুদী এবং জায়োনিস্টের সমর্থক। এরা সবসময় তৈরী থাকে শত্রুর তথ্য জানানো বা সন্দেহবাজনদের উপর গোয়েন্দাগিরী করা।
মোসাদের লোগো, ছবি: মোসাদ অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
চরম গোপনীয়তার ঘেরাটোপে থাকা মোসাদের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচারিত থাকলেও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। ইসরায়েলের আইন অনুযায়ী শুধু সংস্থাপ্রধানের নাম প্রকাশ করা যায়। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই পরিচালিত হয় মোসাদের কার্যকলাপ। মোসাদের ওয়েবসাইটে সংগঠনের ‘লক্ষ্য’ এবং ‘কার্যকলাপ’ সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য রয়েছে। তবে মোসাদের হয়ে কাজ করতে ইচ্ছুকদের জন্য একটি ‘ফরম’ রয়েছে ওয়েবসাইটটিতে।
https://www.mossad.gov.il/eng/Pages/default.aspx
এটিই হল মোসাদের ওয়েবসাইট। তবে এ ওয়েবসাইটে নিজ দায়িত্বে ঢুকবেন। কথিত আছে মোসাদের ওয়েবসাইটে ক্লিক করলেই সংস্হায় সংরক্ষিত সার্ভারে মুহুর্তেই আইপি ট্রেস করে লোকেশন ডিটেক্ট করা হয়।
মোসাদ হামলার জায়গায় থাকেনা। বেশীরভাগ সময়েই চেষ্টা করে স্হানীয় মাফিয়া বা সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিজেদের কাজ করে নিতে। যদি মাফিয়াদের দ্বারা সম্ভব না হয় তাহলেই শুধুমাত্র মোসাদের ডেথ স্কোয়াড কাজ করে। ইসরায়েলি সরকারের জন্য কৌশলগত, রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার মতো কাজের বাইরেও মোসাদের কাজের পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত। সংগঠনটির ঘোষিত উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের সীমানার বাইরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো যাতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা এবং দেশে-বিদেশে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
অন্যান্য বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার তুলনায় মোসাদের দায়িত্ব বা কাজের পরিধির বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়৷ যেসব দেশে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনত সক্রিয় হতে পারে না সেই সব দেশ থেকে ইহুদীদের ইসরায়েলে নিয়ে আসার দায়িত্বও পালন করে মোসাদ৷ বিশ্বের যে কোন ইহুদী ব্যক্তির জন্য ইসরায়েলের দ্বার খোলা রয়েছে যেন তারা সেখানেই পাকাপাকি বসবাস করতে পারে৷ ইসরায়েলের সীমানার বাইরে বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনা ও কার্যকর করার বিশেষ দায়িত্বও পালন করে মোসাদ৷
হত্যাকাণ্ডের জন্য টার্গেট নির্ধারণে ইসরাইলি গোয়েন্দারা মোসাদের অভ্যন্তরীণ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়। কখনো কখনো দেশটির অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতারাও যুক্ত থাকে এর সাথে। কখনো টার্গেট চিহ্নিত করে ইসরাইলের অন্য অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা সামরিক বাহিনী। যেমন বিজ্ঞানী ফাদিকে শত্রু হিসেবে তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি হামাসের ওপর নজরদারি করে ইসরাইলের এমন গোয়েন্দা সংস্থা বা সামরিক বাহিনী করতে পারে।
আবার দেশের বাইরে কাজ করা ইসরাইলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও তার বিষয়ে কাজ করতে পারে। বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গাজা, ইস্তাম্বুল ও বৈরুতের মধ্যে হামাসের যে যোগাযোগ চ্যানেল তার ওপর কঠোর নজরদারি করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এই চ্যানেলের মাধ্যমেই ইসরাইল বিজ্ঞানী ফাদিকে টার্গেট হিসেবে শনাক্ত করেছিল বলে মনে করা হয়। ফাদির বন্ধুরা জানিয়েছেন, হামাসের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি গোপন করতেন না।
যেভাবে ঘটে হত্যাকাণ্ড
কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করার পর মোসাদ তাকে হত্যা করা হবে কি না সে ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করে। ওই ব্যক্তির বেঁচে থাকা ইসরাইলের জন্য সমস্যা হবে সেটি মনে করলে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর মোসাদের বিশেষজ্ঞ দল ওই ব্যক্তির ফাইলটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিভাবক সংস্থা ‘ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটি’র প্রধানের কাছে পাঠানো হয়। হিব্রু ভাষায় ভারাশ নামে পরিচিত এই সংস্থাটি।
এ বিষয়ে আলোচনা করে নিজেদের মতামত ও পরামর্শ দেয় ভারাশ। তবে এই অপারেশন অনুমোদনের ক্ষমতা নেই তাদের। এই ক্ষমতা রয়েছে শুধু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ দুই-একজনের সাথে পরামর্শ করেন। অনুমোদনের পর বিষয়টি আবার মোসাদের কাছে যায় পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির জন্য। কখনো কখনো এতে এক সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগে। বিষয়টি নির্ভর করে টার্গেটের অবস্থান ও তার নিরাপত্তার ওপর।
মোসদের অত্যন্ত গোপন একটি বাহিনী কায়সারিয়া ইউনিট। আরব বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে গুপ্তচর মোতায়েন করা তাদের কাজ। ১৯৭০-এর দশকে এই ইউনিটটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাইক হারারি। আরব বিশ্বসহ মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ টার্গেটের ওপর নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ করে কায়সারিয়া। এই ইউনিটের মধ্যে আবার রয়েছে কিডন নামে একটি বাহিনী। যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞে পারদর্শী পেশাদার খুনিদের একটি দল কিডন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের মধ্য থেকে সাধারণত এই লোকদের নেয়া হয়। ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানী ফাদির হত্যাকারীরা সম্ভাব্য কিডন সদস্য বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। কায়সারিয়া ইউনিটের কাজ অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর স্পেশাল এক্টিভিটিস সেন্টারের (এসএসি) মতো। এসএসির মধ্যে আবার স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি) নামে একটি ইউনিট রয়েছে যারা হত্যাকাণ্ড চালায়। সিআইএর এসওজি আর মোসাদের কিডন একই ধরনের ইউনিট।
রোনেন বার্গম্যান লিখেছেন, দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আগ পর্যন্ত ইসরাইল অন্তত ৫০০ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে যাতে নিহত হয়েছে অন্তত এক হাজার টার্গেট ও অন্যরা। আর দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় তারা এক হাজারের বেশি অপারেশন চালিয়েছে যার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়েছে। সব মিলে সেই থেকে হামাসের নেতাদের বিরুদ্ধে সংস্থাটি ৮০০টির বেশি হামলা চালিয়েছে। তবে মোসাদের টার্গেট যে শুধু ফিলিস্তিনিরা তা নয়, সিরিয়া, লেবানন, ইরান এমনকি ইউরোপের কোনো নাগরিককেও হত্যা করতে পারে সংস্থাটি। মোট কথা ইসরাইল বা ইহুদিবাদীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে রয়েছে এমন যে কাউকে হত্যা করতে পারে এই সংস্থাটি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.