কোটা সংস্কার কেন চাই?
প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু অংশ নেন সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থী (চলতি বছরের হিসাবে)। কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি নাও পেতে পারেন। কারণ ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে। কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না। আবার কোটা থাকলে কেউ ৫০০০ বা ৭০০০ হয়েও চাকরি পেতে পারেন।
চলমান কোটা পদ্ধতির যে সংস্কার প্রয়োজন সেটা যে কোনো বোধসম্পন্ন মানুষই স্বীকার করবে। এমনকি সরকারি কর্ম-কমিশনও (পিএসসি) প্রতিবছর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই কোটা সংস্কারের কথা বলে আসছে। ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটা প্রস্তাব সরকারকে দেয় পিএসসি। কিন্তু বাস্তবে কোটা সংস্কারের সব প্রস্তাবই কাগজে বন্দি হয়ে রয়েছে।
কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে আন্দোলনকারী এই তরুণরা বেশ কিছুদিন ধরেই আন্দোলন করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের উপর হামলা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিলেন চট্টগ্রামের পটিয়ায় দেয়া ভাষণে, কোটা কোটার মতই থাকবে কোন সংস্কার হবে না। অবশ্য এর মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু সেটি নিয়েও বিপত্তি বাঁধিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোটায় শূন্য থাকা সিটে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, এক কোটার শূন্য আসন অন্য কোটা দিয়ে পূরণ করা হবে। এটা রীতিমত প্রহসন।
বর্তমানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরিতে শতভাগ কোটা। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৫৬ ভাগ কোটা। এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ প্রার্থীরা। প্রচলিত এই পদ্ধতির সংস্কার চাইছে তারুণ্য। কোটার সংস্কার চাইলে অনেকেই সেটাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে উড়িয়ে দেন। যারা এমন কথা বলেন তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের একটা সিদ্ধান্তের কথা বলতেই হয়।
১৯৭৪ সালে সরকার যে অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিস রিঅর্গানেইজেশন কমিটি (এএসআরসি) গঠন করে সেই কমিটি প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে কোন ধরনের কোটা না রাখার সুপারিশ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে জাতির জনককে হত্যার পর সেই কাজ থেমে যায়। আবারও উল্টো পথে চলা শুরু করে জাতি।
আমি নিশ্চিত বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজকে কোটার এই কাঁটা থাকতো না। শুধু বঙ্গবন্ধুর সরকার নয় এরপরেও অসংখ্যবার সরকারের কমিটিগুলো কোটা সংস্কারের সুপারিশ করেছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি বা করা যায়নি। কারণ এখানে মুক্তিযুদ্ধ জড়িত। এবং এটা বেশ স্পর্শকাতর।
আমাদের সংবিধান বা মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা তাতে সবার জন্য সমান সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। কাজেই কোটা সংস্কার চাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকা। আমি এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথা বলতে চাই।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চয়ই আপনাদের সন্দেহ নেই। সেই আনিসুজ্জামান স্যারও বলেছেন, বর্তমানে ১০ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত।’ স্যার বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের নামে যে কোটা আছে, সেটা এখন আর থাকা উচিত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সন্তানরাও এখন বড় হয়ে গেছে। তাই এটা এখন কোনভাবেই চলা উচিত নয়। এটা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা।’
আরেক মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেছেন, নিয়োগ পদ্ধতি হওয়া উচিত প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে সবচেয়ে যোগ্য জনবল দরকার। সেখানে কোটা থাকা উচিত নয়। আর কোটার জন্য কেউ যুদ্ধ করেনি। কোটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তাম কমান্ড যে ন্যাক্কারজনক আচরণ করে যাচ্ছে তাতে মুক্তিযোদ্ধারাই অপমানিত হচ্ছেন।
পিএসসির উদ্যোগে যে গবেষণা হয়েছে সেখানে আকবর আলী খান এবং সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিনও কোটা সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। আকবর আলীকে যারা শুধুই সুশীল মনে করেন তাদের মনে করিয়ে দেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক বা এসডিও ছিলেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচার করে এবং ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি সরকারি চাকুরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর আগের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সমর্থন দেন। পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে হবিগঞ্জ পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অণুপ্রাণিত করেন।
আবারও বলছি আমাদের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোটা। যারা মনে করেন কোটা পুরস্কার তাদের বলি সংবিধানে পরিস্কার করে বলা আছে, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কোটা। আমার প্রশ্ন, যে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকুরি করেছে, যার সন্তান চাকুরি করেছে তার নাতি কী করে পিছিয়ে পড়া?
যারা কথায় কথায় কোটার সাথে মুক্তিযুদ্ধকে মেলান তাদের বলি এদেশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেই। অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করে বহু মুক্তিযোদ্ধা। তাদের কী কোটা দিতে পেরেছেন? শহীদের সন্তানরা কেন কোটা পাবে না? কেন পাবে না বীরাঙ্গনার সন্তানরা?
আর বাস্তবতা যদি বলেন, রাজাকার আর গুটিকয়েক লোক বাদে ৭১ এ পুরো বাংলাদেশই তো স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। গ্রামেগঞ্জে প্রচুর মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে। তাহলে তারা কেন কোটার সুবিধা পাবে না? তাদের কথা না হয় বাদ দিলাম এ দেশের ৩০ লাখ শহীদের কারও কী মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে? কয় লাখ ধর্ষিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে? বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কতোজন সনদ নিয়েছেন? তার মানে আপনারা যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা চাইছেন তারা আসলে সনদধারীরা জন্য কোটা চাইছেন তাই তো।
কোটা সংস্কার যতদিন হচ্ছে না ততদিন মেধানির্ভর জনপ্রশাসন গঠন সম্ভব নয়। আমি আশা করছি সরকার দ্রুতই বিষয়টা অনুধাবন করতে পারবে। আর এটা যত দ্রুত হবে ততই সরকারের জন্য মঙ্গলজনক। আর ছাত্রলীগের কথা কী বলবো? এরা ইতিহাস হয়ে যাক এটাই কামনা। বাংলাদেশে আর ছাত্রলীগের প্রয়োজন নেই। ছাত্রলীগ যতদিন বেঁচে তত বেশি ঘৃণা কুড়াবে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.