শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহনীয় মাত্রার দূর্নীতি কি আদৌ বন্ধ হবে?
শিক্ষামন্ত্রীর পিওসহ দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর তাদের ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা অনিয়ম, অপকর্ম, ঘুষ, দুর্নীতিসহ থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসছে। শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে বসে ঘুষের হাট বসানোর তথ্য ফাঁস হয়েছে। মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা ভবনে ঘুষ বাণিজ্যে জড়িত অন্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকাও চলে আসছে গোয়েন্দাদের হাতে। আতঙ্কে রয়েছেন ওই দুর্নীতিবাজরাও। এদিকে, ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিও) মাধ্যমে ঘুষের টাকা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পকেটে যেত বলেও বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠছে। আর মন্ত্রী পত্নীর সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সচিবালয় ও শিক্ষা ভবনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সখ্যতার গুঞ্জনও আছে। এমনকি তাদের পদোন্নতি, বদলিসহ মন্ত্রণালয়ের নানা কাজে মন্ত্রী পত্নীর নাক গলানোর বিষয়টি ওপেন সিক্রেট বলেই সচিবালয়ে আলোচনা হয়।
এর আগে ‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ’ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা সহকর্মীদের একমাস আগে এ পরামর্শ দেয়া হয়। অবশ্য সহনীয় ঘুষের পরিমাণ কত- তা ওই বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। এক মাস পর মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মোতালেব হোসেন ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চমান সহকারী নাসিরুদ্দিন কোটি কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করে গোয়েন্দাদের জালে ধরা পড়েছেন। মন্ত্রীর পিওসহ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ দুই কর্মী গ্রেফতারের পর ‘সহনীয়’ ঘুষের পরিমাণ নিয়ে একটি ধারণা পাওয়ার কথা বলছেন কেউ কেউ। জঙ্গি তৎপরতায় অভিযুক্ত লেকহেড গ্রামার স্কুলের মালিক খালেদ হাসান মতিনের সঙ্গে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়েন তারা। ঘুষের বিনিময় স্কুল চালু করার সুযোগ নেয়ার দায়ে গ্রেফতার হন মতিনও। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন।
সূত্র বলছে, মোতালেব-নাসিরের ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়টি সচিবালয়েই ছিল ওপেন সিক্রেট। আড়াল-আবডালে বলাবলি হতো একই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে। কিন্তু মন্ত্রী ও মন্ত্রী পত্নীর আশীর্বাদের কারণে তাদের টিকি ছোঁয়ারও সাধ্যি ছিল না কারও! তাদেরকে দফতরে রেখে ‘সততা’র দাবিদার শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। ঘুষ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে বিতর্কে আসা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে এই অভিযোগে গ্রেফতারের পর অনেকে মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে ঘটনার যোগসূত্র তৈরির চেষ্টাও করছেন। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথাকথিত ‘সহনীয়’ ঘুষ বাণিজ্যে সরকারও বেকায়দায় পড়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ঘুষ বাণিজ্যের নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দু’জনকে গ্রেফতারের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ চক্রের আরো ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন। গোয়েন্দারা তাদেরকে নজরে রাখছেন। যেকোনো মুহূর্তে তাদেরকেও গ্রেফতার করা হতে পারে। তবে এই মুহূর্তেই তাদের নাম জানাতে চাচ্ছেন না গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। অবশ্য আবু আলম নামে এক কর্মচারী এরই মধ্যে গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন। তাকে খুঁজছেন গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আলমসহ অন্যদেরকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিভিন্ন সময় পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও বেরিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতির দায় শিক্ষামন্ত্রী এড়াতে পারেন না। এটা দু-একদিনের ঘটনা নয়। বছরের পর বছর মন্ত্রীর পাশে থেকে শত কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য হলো অথচ তিনি জানেন না, এটা বলার সুযোগ নেই। পিও’র ঘুষ কেলেঙ্কারির দায় মন্ত্রীর ওপরও বর্তায়। শিক্ষামন্ত্রীর উচিত এ দায় নিয়ে পদত্যাগ করা।
অপরদিকে, প্রশ্নফাঁস, পাঠ্যপুস্তকে অসংখ্য ভুল, মন্ত্রীর ব্যর্থতায় দাবি আদায়ে শিক্ষকদের আন্দোলন আর ‘সহনীয়’ মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ এবং ‘মন্ত্রীরাও চোর’ বলার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ে বারবার রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হয়েছে। এতে একাধিকবার শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও উঠে। নতুন করে আবারও শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। যদিও জনগণের এ দাবি আগেও পাত্তা দেননি শিক্ষামন্ত্রী, এখনো দিচ্ছেন না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন কর্মকাণ্ডে অস্বস্তিতে আছে সরকার। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র বলছে, শিক্ষামন্ত্রীর ‘সহনীয়’ ঘুষের পরামর্শ এবং ‘মন্ত্রীরাও চোর’ বলায় সরকারের ভেতরেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। মন্ত্রীদের মধ্যেই দু-একজন নুরুল ইসলাম নাহিদকে মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার দাবি তুলেছিলেন। তবে সরকারের শেষ সময় হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রীকে পদত্যাগ না করিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেরামত আলীকে ওই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে কেরামত আলী প্রশ্নফাঁস ঠেকানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে ২০১৮ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সে চ্যালেঞ্জের পরীক্ষা দিতে হবে নতুন প্রতিমন্ত্রীসহ শিক্ষামন্ত্রীকে। কিন্তু এর আগে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ কেলেঙ্কারি ফাঁস- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-কেই প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।
অভিযোগ উঠেছে, মন্ত্রীর পরামর্শে সহনীয় মাত্রায় ঘুষ নিয়ে অনেকেই কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। শুধু মন্ত্রীর পিও মোতালেব এবং উচ্চমান সহকারী নাসিরই নন, পুরো মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বিভাগ ডুবেছে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে। তবে নাসিরুদ্দিন ও মোতালেব নিখোঁজের পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ২১ জানুয়ারি তাদের আটকের কথা জানায়। সেই সাথে তাদের দু’জনের ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যবসা, জমি ও বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণের তথ্য জানা-জানি হয়। ৩০ হাজার টাকা বেতনের মোতালেব ঢাকায় ৪ কোটি টাকার ৭তলা বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করছেন। আর নাসির বেতন পান ১৫ হাজার ঢাকা। কিন্তু ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট, একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ গাড়ির মালিক তিনি।
মোতালেব-নাসিরের সর্বশেষ অবস্থা
ঘুষ লেনদেনের দায়ে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. মোতালেব হোসেন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চমান সহকারী নাসিরুদ্দিন গ্রেফতার হওয়ার পর তাদেরকে ইতিমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ২৩ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। মন্ত্রী বলেন, তারা সাময়িক বরখাস্তে থাকবে। মামলার রায়ের পর তাদের ব্যাপারে দাফতরিক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। প্রথমে নিখোঁজের অভিযোগ আসলেও ২১ জানুয়ারি মোতালেব ও নাসিরুদ্দিনকে আটকের কথা জানায় ডিবি। একই সময় নিখোঁজ বিতর্কিত লেকহেড গ্রামার স্কুলের মালিক মতিনকেও আটকের কথা জানায় মহানগর গোয়েন্দারা। এর একদিন পর ২২ জানুয়ারি রাতে আটক তিনজনের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে বনানী থানায় মামলা করে ডিবি পুলিশ। সেই সাথে তাদেরকে গ্রেফতার দেখানো হয়। রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা করেন ডিবির এসআই মনিরুল ইসলাম মৃধা। মামলা নম্বর ৩৬। বনানী থানার ডিউটি অফিসার এসআই রফিজ উদ্দিন জানান, ঘুষের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ১৬১, ১৬২ ও ১৬৩ ধারায় মামলাটি করা হয়। ২৩ জানুয়ারি তাদেরকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে ডিবি। অপরদিকে, আসামিদের জামিন চেয়ে আবেদন করেন তাদের আইনজীবীরা। মহানগর হাকিম জিয়ারুল ইসলাম উভয় পক্ষের আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিদের কারাগারে পাঠান।
যেভাবে গোয়েন্দাদের জালে ধরা পড়েন
গোয়েন্দা সূত্রমতে, দীর্ঘদিন থেকেই শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার প্রতি নজরদারি ছিল গোয়েন্দাদের। জঙ্গি তৎপরতা ও ধর্মীয় উস্কানির অভিযোগে লেকহেড গ্রামার স্কুল বন্ধ হওয়ার পর স্কুলকে কেন্দ্র করে তদন্ত শুরু করেন গোয়েন্দারা। তদন্তের এক পর্যায়ে খালেদ হাসান মতিনের সঙ্গে নাসিরুদ্দিনের যোগাযোগের সূত্র পান তারা। ওই সূত্র ধরেই জানা যায়, এতে সম্পৃক্ত রয়েছে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব। বিপুল অঙ্কের টাকার মাধ্যমে গোপনে দফারফা হয় লেকহেড স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। স্কুল খুলে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ক’জন। কথা ছিল টাকা দেয়া হবে কয়েক ধাপে। বিষয়টি জেনে তৎপরতা বৃদ্ধি করেন গোয়েন্দারা। অবশেষে টাকা নিতে গিয়ে গ্রেফতার হন নাসিরুদ্দিন। একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় বাকি দুজনকেও।
পিও মোতালেবের উত্থান যেভাবে
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মোল্লাহাট ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের কৃষক দেনছের আলীর ছেলে মোতালেব। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে বড় তিনি। চাকরি পান তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে। পদোন্নতি পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। সেই সুবাদে ‘সহনীয় ঘুষ বাণিজ্য’ করে কোটি কোটি টাকার মালিক। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে টাইপিস্ট হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। পিও পদে পদোন্নতি পান ২০০৮ সালের ৯ এপ্রিল। নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তার পিও হিসেবে কাজ করছেন মোতালেব। মাঝখানে দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রীর কাছ থেকে দূরে যেতে হয়েছিল। তবে নাহিদের কাছের লোক হওয়ায় বেশিদিন দূরে থাকতে হয়নি। এ ছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. হেলাল উদ্দিন ও যুগ্ম সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) বেলায়েত হোসেনের পিও হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পিও মোতালেব দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে সব মিলিয়ে বেতন পান ৩০ হাজার ৬০০ টাকা। অফিস থেকে ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। বেতন থেকে ঋণের কিস্তি বাবদ প্রতি মাসে কাটা যায় ১২ হাজার টাকা। গ্রিন রোড স্টাফ কোয়ার্টারের সরকারি বাসায় থাকেন তিনি। বাড়িভাড়া বাবদ কেটে নেয়া হয় ১৪ হাজার টাকা। ঋণের কিস্তি আর বাড়িভাড়া দিয়ে তার হাতে থাকে মাত্র ৪ হাজার ৬০০ টাকা। এই টাকায় তিন সস্তান ও স্ত্রীসহ সারা মাস তার কীভাবে কাটে- তা নিয়ে সহকর্মীদের অনেকের বেশ কৌতূহল ছিল। এই কৌতূহল আরো বেড়ে যায়- রাজধানীতে তার বিশাল বাড়ি নির্মাণে। সরেজমিনে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে মোতালেব বসিলার পশ্চিম ধানম-ি আবাসিক এলাকায় তিন কাঠা জমি কেনেন। ‘বি’ ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর হোল্ডিংয়ে ২০১৬ সালের শেষদিকে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১০তলা ফাউন্ডেশনের বাড়িটি সাততলা অবধি হবে। এর মধ্যে ছয়তলা পর্যন্ত ছাদ হয়েছে। প্রতি তলায় দুটি করে ইউনিট। একেক ইউনিট প্রায় ৮৬০ বর্গফুট। দোতলার দুটি ইউনিট ভাড়া দেয়া হয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, দ্রুতগতিতে এ বাড়ি নির্মাণের কাজ চললেও গত শনিবার (২০ জানুয়ারি) বিকেলে এখান থেকেই কয়েকজন মোতালেবকে কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে। পাশের ২৭ নম্বর বাড়ির মালিক আতাউল্লাহ বলেন, তিনি এবং মোতালেব ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে একই সঙ্গে জমি কিনেছিলেন। স্থানীয়রা জানান, এ এলাকায় প্রতি কাঠা জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৬০ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোতালেবের তিন কাঠা জমির দাম বর্তমানে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর ভবন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় তিন কোটি টাকা। এছাড়াও মিরপুর ডিওএইচএসে তার ফ্ল্যাট রয়েছে বলে তার সহকর্মীরাই তথ্য দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রীর দফতরে কাজ করার সুবাদে পুরো মন্ত্রণালয়েই তার দাপট ছিল বরাবরই। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় তিনি প্রভাব বিস্তার করে ঘুষ-বাণিজ্য করতেন। শুধু তাই নয়, আরও কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মচারীকে নিয়ে তিনি একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এই সিন্ডিকেট ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষকদের বদলি থেকে শুরু করে পদোন্নতি, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুরনো প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি ও শাখা খোলা, মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা ছাড়াও সনদ-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত দায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের অনুমতি পর্যন্ত করিয়ে দিতেন। সর্বশেষ লেকহেড গ্রামার স্কুল থেকে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যান এ সিন্ডিকেটের হোতা মোতালেব।
শিক্ষামন্ত্রীর কাছের লোক, বসিলার লিডার!
পশ্চিম ধানমন্ডির বসিলা এলাকার সবাই একনামেই চিনেন মোতালেবকে। সবাই তাকে চিনেন শিক্ষামন্ত্রীর কাছের লোক হিসেবে। ছুটির দিনে ওই বাড়িতে যখনই তিনি আসতেন অল্প সময়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ছুটে যেতেন অনেকে। পাড়ার গলিতে তখন গাড়ির দীর্ঘ সারি। আগতরা তাকে লিডার হিসেবে সম্বোধন করেন।
যেভাবে কোটিপতি হয়েছেন কর্মচারী নাসির
পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মচারী উচ্চমান সহকারী নাসিরুদ্দিনের মূল চাকরি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে। তিনি সংযুক্ত রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের পত্র গ্রহণ ও বিতরণ শাখায়। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে অসংখ্য ঘুষ বাণিজ্যসহ দুর্নীতির প্রমাণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি পান কুষ্টিয়ার নাসিরুদ্দিন। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অফিস সহকারী পদে স্থানান্তর হন। এরপর মাউশির এমপিও শাখার দায়িত্ব পান তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এখানে তাকে খুশি না করলে বৈধ কাগজপত্র থাকলেও এমপিওভুক্ত হতে পারতেন না শিক্ষক-কর্মচারীরা। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং পেয়ে তিনি যেন হাতে পেয়েছেন আলাউদ্দিনের চেরাগ। ১০ হাজার ২০০ টাকা বেতন স্কেলে তার সর্বমোট বেতন ১৫ হাজার ২৮০ টাকা। অথচ তার রয়েছে বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাটসহ গাড়ি ও অন্তত ৫টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
খিলক্ষেতের কনকর্ড লেকসিটির বৈকালী ভবনের ৬/বি/১/৩ নম্বর ফ্ল্যাটে সপরিবারে থাকেন নাসিরুদ্দিন। সেটিসহ ওই লেকসিটিতে দুটি ফ্ল্যাট আছে তার। সরেজমিনে জানা গেছে, ২০০৭ সালে নাসিরুদ্দিন কনকর্ডে আনুমানিক ৫০ লাখ টাকা দিয়ে দু’টি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। ওই সময় প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম ছিল ২৫ লাখ টাকা। বর্তমানে দু’টি ফ্ল্যাটের দাম অন্তত ১ কোটি টাকা। তিনি ২০১২ সালের দিকে একটি প্রাইভেট কার কেনেন। ওই ভবনের বাসিন্দারা জানান, এই আবাসিক এলাকায় নাসিরের আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যেটি ভাড়া দেয়া। তার একটি প্রাইভেট কারও রয়েছে। শুধু তাই নয়, কনকর্ড লেকসিটি শপিং কমপ্লেক্সে ৪টি টেইলার্স ও একটি বুটিক শপ রয়েছে তার। নাসিরের এক প্রতিবেশী জানান, ‘নাসির তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ বিঘা জায়গা কিনেছেন। তিনি প্রায়ই আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে গল্প করেন। যার দাম ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা।’ অন্য প্রতিবেশীরা জানান, এলসিসি শপিং কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায় ৩৩৫, ৩৪০, ৩৪২, ৩৪৬ ও ৩৮৪ নম্বরের পাঁচটি দোকানের মালিক নাসিরুদ্দিন। এর মধ্যে দু’টি কাপড়ের, দু’টি টেইলার্স (একটির নাম নিশাত টেইলার্স) ও একটি বুটিকের দোকান। দোকানগুলো গত একবছর আগে চালু করেছে বলে জানিয়েছেন শপিং মলটির অন্য দোকান মালিক-কর্মচারীরা। এসব দোকানে অন্তত ২০ জন কর্মচারী রয়েছেন। যাদের বেতন ৮ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার পর্যন্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিশাত টেইলার্সের একজন কর্মচারী বলেন, ‘আমাদের এসব দোকানের এমডি (ম্যানেজিং ডিরেক্টর) নাসিরুদ্দিন।’ তার এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন নিজের শ্বশুরকে। এদিকে, নাসির খিলক্ষেত এলাকায় এফএনএফ (ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি) ক্লাব (সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট। দুদক কোটিপতি এই কর্মচারীর দুর্নীতি তদন্ত করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, জঙ্গি ও ধর্মীয় উস্কানির দায়ে সম্প্রতি বন্ধ হওয়া (হাইকোর্টের আদেশে পরে খুলে দেয়া) লেকহেড গ্রামার স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ১৫ লাখ টাকায় রফা হয়। অগ্রিম হিসেবে ছয় লাখ টাকা নাসিরের হাতে দেয়া হয়। কাজ হলে বাকি টাকা দেয়ার কথা ছিল। এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি মাধ্যমিক শাখার কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত বলে জোর অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র বলছে, নাসিরুদ্দিন ১৯ জানুয়ারি হয়ে যাওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বনভোজন আয়োজন কমিটিতে ছিলেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, বনভোজনের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর থেকেই নাসির তৎপরতা শুরু করেন। বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বনভোজনের নামে বিরাট অঙ্কের চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ আসতে থাকে। এ ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা তাকে ডেকে নিয়ে সাবধান করার পরও থামেননি তিনি। তাকে মোট ১৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা ওঠানোর দায়িত্ব দেয়া হলেও রাজধানীর এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে নাসির চাঁদা চাননি। বনভোজনের একদিন আগে নিখোঁজ হওয়ার আগপর্যন্ত নাসিরের কাছে বনভোজনের প্রায় ২৯ লাখ টাকা ছিল বলে কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন।
মাউশির কর্মচারী সমিতির নেতারা জানান, জাল সনদে চাকরি দেয়া ও এমপিওভুক্তিতে জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম করে নাসির এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। ২০১৩ সালে এমপিও জালিয়াতির দায়ে নাসিরকে ঢাকার বাইরে সিরাজগঞ্জে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাকে বেশিদিন থাকতে হয়নি।
সূত্র বলছে, এর পর একজন মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে মাউশিতে বদলি হয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন মাউশির মহাপরিচালক তার ব্যাপারে সায় দেননি। পরে মোতালেব চক্রকে ধরে প্রেষণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসেন নাসির। দায়িত্ব দেয়া হয় পত্র গ্রহণ ও ছাড়পত্র শাখায়। তবে তিনি সব শাখায় দৌড়ঝাঁপ করতেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাকে আনার পেছনে শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক একজন এপিএস কলকাটি নেড়েছিলেন বলে আলোচনা আছে।
ঘুষের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁস
জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া লেকহেড গ্রামার স্কুলটিকে খুলে দিতে আদালতের আদেশ অমান্য করে রাষ্ট্রীয় নথি পাচার করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গ্রেফতারকৃত মোতালেব ও নাসির। মামলার এজাহারে উল্লেখ আছে, আসামি মো. মোতালেব হোসেন ও নাসিরুদ্দিন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থেকে লেকহেড গ্রামার স্কুলের মালিক ও মামলার অপর আসামি খালেদ হাসান মতিনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে জঙ্গি কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বন্ধ হওয়া লেকহেড গ্রামার স্কুলটিকে আদালতের আদেশের শর্ত ভঙ্গ করে দ্রুত খুলে দেয়ার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। এর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় গোপন নথিপত্র এই দুই কর্মচারী লেকহেড গ্রামার স্কুলের এমডি খালেদ হাসান মতিনের কাছে বেআইনিভাবে হস্তাস্তর করেন।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেছেন, ‘লেকহেড স্কুল খুলে দিতে পরিচালক খালিদ হাসান মতিনের সঙ্গে ঘুষের চুক্তি হয়েছিল শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. মোতালেব হোসেন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (প্রেষণে) উচ্চমান সহকারী নাসির উদ্দিনের। এর মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধের সময় তাদেরকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ ডিসেম্বর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব তথ্য জানান। যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া তিনজনই ঘুষ লেনদেনের কথা স্বীকার করেছেন। এছাড়া লেকহেড স্কুলের পরিচালক খালিদ হাসান মতিনের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততা ও জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে মতিনের বিরুদ্ধে আলাদা করে মামলা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া তিনজনকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়।’ তবে আদালত তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। বাতেন বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ লেনদেনের মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শিডিউলভুক্ত হওয়ায় মামলাটির তদন্ত করবে দুদক। মামলার নথিপত্র দুদক কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
একই দিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মামলাটির তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানান। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতারকৃত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু’জনসহ লেকহেড গ্রামার স্কুলের মালিকের বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির মামলা তদন্ত করবে দুদক। এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে। দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, এরই মধ্যে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিতে আরও গ্রেফতার হয়েছিলেন যারা
এর আগে ২০১২ সালের অক্টোবরে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের দপ্তরের এমএলএসএস (পিয়ন) মোহাম্মদ আলীকে ঘুষের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তিনি ছাড়া পান। এখন তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দফতরেই কর্মরত। শিক্ষামন্ত্রীর দফতরের আরেক কর্মকর্তাকে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক উঠলে এর আগে তাকে ঢাকায় আরেকটি প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়। শুধু মন্ত্রণালয় নয়, মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বেশ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় কখনো শক্ত ব্যবস্থা নেয় না বলে সমালোচনা রয়েছে। কিছুদিন আগে ডিআইএর এক কর্মকর্তাকে ফাঁদ পেতে ঘুষসহ হাতেনাতে ধরে দুদক।
অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো মন্ত্রী পত্নীর?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অনিয়মে মন্ত্রীর স্ত্রীর নামও জড়িয়ে যাচ্ছে। অভিযুক্তদের অনেকের সঙ্গেই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের স্ত্রী জোহরা জেসমিনের যোগাযোগ ছিল বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব প্রায়ই মন্ত্রীর বাসায় যেতেন এবং মন্ত্রীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতেন বলেও তথ্য এসেছে গোয়েন্দাদের কাছে। এর আগে মন্ত্রীর একজন সহকারী একান্ত সচিবের বিরুদ্ধেও দুর্নীতর তথ্য প্রমাণ ছিল। অব্যাহত দুর্নীতির কারণে মন্ত্রী তাকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই এপিএস মন্ত্রী পত্নীর ‘বিশ্বস্ত’ ছিলেন বলেও গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের স্ত্রী মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে থাকেন। গত এক দেড় বছরে এই হস্তক্ষেপ বাড়ে। বদলী ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মন্ত্রী পত্নীর হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি ছিল বলেও গোয়েন্দাদের হাতে তথ্য এসেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। দুদকের একটি সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তার প্রশ্রয় ও আনুকূল্য পেতো। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের প্রাপ্ত তথ্যাদি তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সুরঞ্জিতের পর নাহিদ
২০১২ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকর্মীর ঘুষ কেলেঙ্কারির পর এবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতি ‘রাষ্ট্রা’। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার এপিএসের দুর্নীতির কারণে ঘটনার আট দিনের মাথায় পদ থেকে সরে দাঁড়ান। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সরাসরি কিছু না বলে ২২ জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, ‘(কেউ) কোনও অন্যায়, দুর্নীতি বা ঘুষের মধ্যে জড়াবে না (চাকরিবিধিতে) এরকম তো বলা আছেই। কিন্তু তারা এ ধরনের কাজে জড়িত, এমন রিপোর্ট কেউ আমাদের দেয় নাই।’ তবে তিনি এ নিয়ে পদত্যাগ করবেন কিনা- সে বিষয়ে কিছুই বলেননি। সাধারণত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মন্ত্রীর যাবতীয় কাজের হিসেব রাখেন। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রীর পিওর কাজ বিভিন্ন ফাইল, অভিযোগ, আবেদন রিসিভ করা। সিন (দেখানো) করানো। সিন করানোর পর ফাইল ডাউন করা (মন্ত্রীর কাছ থেকে সচিবের দফতরে পাঠানো)। মন্ত্রীকে টেলিফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া। এছাড়া, মিটিং ও অন্যান্য কাজে আপ্যায়ণের ব্যবস্থা করা মূল কাজ। এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষা ভবনে ‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার’ পরামর্শ দিয়ে বক্তব্য রেখে তোপের মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী। টিআইবি বিবৃতি দিয়ে তাকে পদত্যাগের দাবি তুললেও সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশিত সংবাদ ভুল বলে দাবি করেন মন্ত্রী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিআইএর (পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর) এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর সব সংস্থার সঙ্গে আমি বসেছি। তখন বলেছি, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সব জায়গায় এ কথা বললেও ইইডির (শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর) সভায় বলেছি, আপনারা ভালো কাজ করবেন। আপনারা ঘুষ খাবেন, কিন্তু সহনশীল হয়ে খাবেন। কেননা, আমার সাহসই নাই বলার যে, আপনারা ঘুষ খায়েন না।’ ওই সময় নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেকে ও সব মন্ত্রীকেও ‘চোর’ বলে আখ্যায়িত করেন।
মন্ত্রী ঘুষখোরদের ‘সুরক্ষা’ দিচ্ছেন
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, “দেশের সব সেবাখাতের মতো শিক্ষাখাতও দুর্নীতিগ্রস্ত। আমাদের বিভিন্ন জরিপে তা উঠে এসেছে। কিন্তু শিক্ষাখাতের এই দুর্নীতি- জাতির জন্য অনেক খারাপ খবর। এখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। এখানে সেবা নিতে ঘুস দিতে হয়। শিক্ষামন্ত্রী যখন এই খাতে ‘সহনীয়’ মাত্রায় দুর্নীতি করার কথা বলেন, তখন তিনি দুর্নীতিকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে আরো উৎসাহিত করেন। তাই আমরা নৈতিক জায়গা থেকে তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম।” তিনি বলেন, ‘এই দুর্নীতি এককভাবে হয় না। এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরেই সিন্ডিকেট আছে। তারা সবাই ভাগ পায়। সেই ভাগ কোন পর্যন্ত যায় তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষামন্ত্রী সহনীয় দুর্নীতির কথা বলে, তার চারপাশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রকারান্তরে দুর্নীতিকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেয়াও দুর্নীতি।” তিনি আরো বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কি অল্পদিন হয় যোগ দিয়েছেন? তিনি কি এই প্রথম ঘুস নিলেন? তা যদি না হয় তাহলে ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতি শিক্ষামন্ত্রীর চোখে পড়বে না কেন? তিনি তো চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। সবাই তাদের অবৈধ সম্পদের কথা জানেন, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী জানবেন না, এটা কী করে হয়?”
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.