যেভাবে সক্রেটিসকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো
বহুদিন পূর্বের কথা। তখন খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সাল। এথেন্সের শাসকগোষ্ঠী দার্শনিক সক্রেটিসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে। তাকে করা হয় বিচারের মুখোমুখি।
তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগগুলো হল,
১- তিনি রাষ্ট্রের তরুণ সম্প্রদায়ের মনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি করে চলেছেন।
২- তিনি তরুণদের মনে ন্যায় কাকে বলে, অন্যায় কী, এরূপ মৌলিক প্রশ্ন জাগিয়ে তুলছেন।
৩- সক্রেটিস কুতার্কিক। তিনি তরুণসমাজকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছেন।
এসব অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তিনি বিচারকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বিচারকদের বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে; তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এথেন্সের কেন্দ্রবিন্দুতে বসেছে এ আদালত। আদালতের বিচারক সংখ্যা ৫০০। বিচারকরা আসীন কাঠের বেঞ্চিতে। বিচারকদের চার পাশ ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী তিন এথেনীয় নাগরিকও সেখানে হাজির। তিন অভিযোগকারীকে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করে বক্তব্য রাখার জন্য তিন ঘণ্টা সময় দেয়া হয়। এরপর সক্রেটিসকে সময় দেয়া হবে তিন ঘণ্টা সময়, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডনের জন্য।
অভিযোগ খণ্ডন করে ৭০ বছর বয়সী সক্রেটিস বিচারকদের সামনে বক্তব্য রাখবেন। চার পাশে থমথমে ভাব। বিচারকরা অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী উভয়ের বক্তব্য-যুক্তিতর্ক শুনবেন। এরপর বিচারকরা অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ধারণে ভোটের মাধ্যমে তাদের রায় জানাবেন। বিচারকদের সামনে দু’টি গোলাকার কলসি। একটিতে লেখা guilty, আর অপরটিতে not guilty। বিচারকরা তাদের ইচ্ছেমতো যেকোনো একটি কলসে তাদের নিজ নিজ চাকতি ফেলে সক্রেটিসের বিচারের রায় সমাধা করবেন। এভাবে ভোটাধিকারভিত্তিক আদালতের রায়ে সক্রেটিসের পক্ষে ২২০ বিচারক ও বিপক্ষে ২৮০ বিচারকের ভোট পড়ে। অতএব বিচারে সক্রেটিস দোষী সাব্যস্ত হন। এথেনীয় আইন অনুযায়ী এটাই ছিল রায় ঘোষণার পদ্ধতি।
বিচারকদের কোনো বক্তব্য দেয়ার সুযোগ ছিল না। এরপর এলো সক্রেটিসের শাস্তি নির্ধারণের পালা। অভিযোগকারী সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। সক্রেটিসকে সুযোগ দেয়া হয়, তার বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে, সে ব্যাপারে পরামর্শ রাখার জন্য। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন সক্রেটিস হয়তো বলবেন তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে নির্বাসনে দেয়া হোক। তা না করে সক্রেটিস বরং সেদিন বলেছিলেন, তিনি ভণ্ড জ্ঞানীদের মুখোশ খুলে দিচ্ছেন। সক্রেটিসের নিজের ভাষায় : ‘রাষ্ট্ররূপ মন্থরগতি অশ্বের জন্য আমি হচ্ছি বিধিদত্ত এক ড্যাঁশ পোকা।’ অতএব তাকে পুরস্কৃত করাই উচিত। এমনি পরিস্থিতিতে তার ওপর চাপ আসে বাস্তবভিত্তিক কোনো শাস্তির পরামর্শ দিতে। তখন তিনি চাপের মুখে বলেন, তাকে মোটা দাগে জরিমানা করা যেতে পারে। বিচারকরা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুদণ্ডই ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার পর তাকে কাছাকাছি একটি কারাগারে নেয়া হয়।
এথেনীয় আইন অনুযায়ী তার মৃত্যুদণ্ড সেখানেই কার্যকর করা হয়। আর সক্রেটিস নিজ হাতে হেমলক বিষপানে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। মৃত্যুর আগে তিনি বিষপাত্র হাতে নিয়ে বলেছিলেন : I to die, you to live, but only God knows who is correct.
সক্রেটিসের সেদিনের মৃত্যুদণ্ড সাধারণ এথেনীয়রা নিশ্চিতভাবেই মর্মাহত হয়েছিল। মৃত্যুর আগের দিন এমন একটা ব্যবস্থা হয়েই গিয়েছিল কারারক্ষীরা গোপনে তাকে জেলের বাইরে পাঠিয়ে দেবে। উপকূলে অপেক্ষারত জাহাজ তাকে নিয়ে যাবে অন্য কোনো দেশে। সক্রেটিসের বন্ধুরা আগের রাতে সেসব ব্যবস্থার কথা জানিয়েছিলেন। সক্রেটিসকে ক্রিটো জানিয়েছিল : ‘সক্রেটিস, তুমি আমাদের জন্য আশঙ্কা বোধ করো না। তোমাকে সঙ্গোপনে মুক্ত করে নেয়ার জন্য অনেক নাগরিকই প্রস্তুত রয়েছে। সে জন্য বিপদের আশঙ্কাও তেমন নেই। সিবিস ও অন্যান্য নাগরিকও তোমার পলায়নে সাহায্য করতে সব ধনসম্পদ ব্যয়ে প্রস্তুত। তুমি যেখানেই যাবে সেখানেই তুমি সর্বসাধারণের প্রিয়পাত্র হয়ে থাকবে। যদি থেলাসিতে যেতে চাও, তাহলে থেলাসবাসী তোমাকে সম্মানের সাথে সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। প্রিয়বন্ধু মনস্থির করো। আজ রাতেই পালাতে হবে’। সেদিন সক্রেটিসের জবাব ছিল : ‘প্রিয় ক্রিটো, তোমার উৎসাহ অপরিসীম। তুমি জানো, আমি যুক্তিবাদী মানুষ। সারা জীবন যুক্তি দিয়ে চলেছি। সঠিক যুক্তিকে শিরোধার্য করেছি। আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন রক্ষার সুযোগ পেয়ে আমি আমার নিজের কথাকে অস্বীকার করতে পারি না। আমি যে নীতিকে সারা জীবন সম্মান করেছি এবং অনুসরণ করেছি, আজ তার চেয়ে উত্তম নীতির সাক্ষাৎ না পেলে, সে নীতিকে বর্জন করে তোমার সাথে একমত হতে পারি না।’
দৃঢ়চেতা সক্রেটিস বন্ধু ক্রিটোর পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে পরদিন নিজ হাতে বিষপানে আত্মহননের পথটিই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তি ও নীতিকে তিনি গলাটিপে মারেননি। সে জন্যই তো তিনি সক্রেটিস।
সক্রেটিস ছিলেন কুৎসিত চেহারার মানুষ। কিন্তু যুক্তি ও নীতিবাদ তার দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আর তাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। শাসক গোষ্ঠী দেখল গোটা দেশের তরুণ সক্রেটিসমুখী হয়ে যাচ্ছে। তা তাদের ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। অতএব সক্রেটিসকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
সক্রেটিসের মতো মানুষই পারে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করতে। সক্রেটিস নিশ্চিত সেদিন বিচারকদের রায়ের মাধ্যমেই মুক্তি পেতে পারতেন। প্রয়োজন ছিল শুধু একটু প্রতিশ্রুতি : সক্রেটিস স্বর্গ-মর্ত্যরে কোনো সমস্যা নিয়ে আর আলোচনা করবেন না, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন তুলবেন না।
তিনি সেদিন এ প্রতিশ্রুতি আদালতকে দেননি। কিংবা পালিয়ে যাওয়ার মোক্ষম নিরাপদ সুযোগ পেয়ে সে পথে পা বাড়াননি। কারণ তার বিবেক ছিল সেখানে পাহাড়সম বাধা। এক দিকে যেমন তিনি বিবেককে মিথ্যার কাছে বিক্রি করতে চাননি, তেমনি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেও অস্বীকার করেছেন। তিনি আইন ভঙ্গকারী হতে চাননি।
মৃত্যু ছিল সক্রেটিসের পায়ের ভৃত্য, তা তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। বিচারকদের উদ্দেশে তার দেয়া বক্তব্যেও তার সে দৃঢ়তারই প্রতিফলন মেলে। প্লেটো বিচারকদের সামনে তার বক্তব্য তুলে ধরার একপর্যায়ে বলেছিলেন : ‘আমার জীবনের একটি ঘটনা বলতে দিন। এ ঘটনা নিশ্চিত প্রমাণ দেবে, মৃত্যুর ভয়ে অন্যায়ের কাছে আমি নতি স্বীকার করতে পারি না। এবং নতি স্বীকার করতে আমি যেখানে অক্ষম, সেখানে মৃত্যুই আমার পক্ষে শ্রেয়। বিচারালয় সম্পর্কে আমি একটি গল্প বলি। গল্পটি আকর্ষণীয় না হলেও সত্য।
এথেন্সবাসীরা! আপনারা জানেন, সিনেট সদস্য হিসেবে একটিমাত্র রাষ্ট্রীয় পদেই আমি অধিষ্ঠিত ছিলাম। আপনারা এ-ও জানেন, আমি এন্টিওকিস গোত্রভুক্ত। সামরিক বাহিনীর অধিনায়করা আরগিনুসি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত সৈন্যদের মৃতদেহ সাথে করে নিয়ে না আসাতে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের জন্য সোপর্দ হয়েছিল। এই বিচারকমণ্ডলীর সভাপতিত্বে তখন আমার গোত্রই ছিল অধিষ্ঠিত। এই বিচারে আপনারা সমরনায়কদের সমষ্টিগতভাবে বিচার করে দণ্ড দিতে চেয়েছিলেন। এই পদ্ধতি অবশ্য আইনবিরুদ্ধ ছিল। পদ্ধতিটি যে আইনবিরুদ্ধ ছিল, তা আপনারা পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেদিন বিচারকদের মধ্যে একমাত্র আমিই আপনাদের সে অসঙ্গত প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলাম। বাগ্মীর দল আমাকে গ্রেফতার করে বিচার করার হুমকি দিয়েছিল। আপনারা উচ্চস্বরে চিৎকার করে আমাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন’। কিন্তু আমি স্থির করলাম : আইন ও ধর্ম আমার পক্ষে। আপনাদের বিরোধিতা করার জন্য আমাকে বন্দিশালায় পাঠানো হতে পারে, তাও আমি জানতাম। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত ছিল অটল : বন্দিত্ব কিন্তু মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে আমি আপনাদের অন্যায়ে অংশ নেবো না। এ ঘটনা ঘটেছিল দেশে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তিরিশের স্বৈরতন্ত্র যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন তারা আমাকে ও অপর চার ব্যক্তিকে সভাকক্ষে ডেকে নিয়ে আদেশ দিলো, আমরা যেন সালামিসের লিয়কে তাদের যূপকাষ্ঠে বলি দেয়ার জন্য বন্দী করে নিয়ে আসি। কিন্তু সেদিন আমি শুধু মুখের কথায় নয়, কাজ দিয়েই তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, মৃত্যুর জন্য আমি বিন্দুমাত্র ভয় করি না। আমি বলেছিলাম, আমার একমাত্র চিন্তার বিষয় হচ্ছে আমি যেন কোনো অন্যায় ও অপবিত্র কাজে যোগ না দিই। সেদিনও স্বৈরতন্ত্রের পাপের হাত আমাকে অন্যায় কাজে লাগাতে পারেনি।
সক্রেটিস কী অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তার সম্যক একটা চিত্র মেলে, বিচারকমণ্ডলীর উদ্দেশে সেদিন সক্রেটিসের দেয়া সুদীর্ঘ ভাষণ থেকে। স্থানাভাবে পুরো ভাষণ উদ্ধৃত করার কোনো সুযোগ এখানে নেই। তবে গুরুত্বের দিকটি বিবেচনা করে এবং প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এর কয়েকটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :
১. এথেন্সবাসী, আমি জানি না, আমার অভিযোগকারীরা কিভাবে আপনাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এ কথা সত্য, তাদের বিশ্বাস উৎপাদনকারী বক্তৃতা এত সুন্দর হয়েছে যে, আমি নিজেকে পর্যন্ত ভুলে গেছি। তবু, এরা একটি কথাও সত্য বলেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু তাদের বিবৃত মিথ্যা ভাষণের মধ্যে একটি মিথ্যা আমাকে বিস্মিত করেছে। এরা আপনাদের সাবধান করে বলেছে, আমি যেন আপনাদের প্রভাবিত করতে না পারি। তারা এ কথা জানে, আমি মুখ খুললেই তাদের মিথ্যা ভাষণ ধরা পড়বে, আমি বলি এরা একটি কথাও সত্য বলেনি। আমি আপনাদের কাছে সত্যকেই উপস্থাপিত করব।
২. এথেন্সবাসী, আপনাদের আমি সম্মান করি এবং ভালোবাসি। কিন্তু আমার চরম আনুগত্য আপনাদের প্রতি নয়। আমার আনুগত্য বিশ্ববিধাতার প্রতি। আমার জীবন ও শক্তি থাকা পর্যন্ত দর্শনের শিক্ষা ও প্রচার থেকে বিরত হবো না।
৩. আরেকটি বিষয়ের প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব : সম্পদশালী শ্রেণীর যুবকদের খুব কিছু করণীয় না থাকায়, এরা স্বেচ্ছায় আমার কাছে আসে। ভণ্ড জ্ঞানীদের আবার আমাকে নকল করে অনুরূপভাবে পরীক্ষা করার চেষ্টা করে। তারাও অচিরেই দেখতে পায়, এমন অনেক জ্ঞানীই রয়েছেন যারা নিজেদের জ্ঞানী বলে দাবি করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কিছুই জানেন না।
৪. এথেন্সবাসী, আপনারা আমার মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। একাধিক কারণেই আমি এর জন্য দুঃখবোধ করছি না। আপনাদের রায় আমার অপ্রত্যাশিত না। বরং আমি বিস্মিত হয়েছি এই ভেবে যে, এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটের সংখ্যা প্রায় সমান। আমি ভেবেছিলাম, আমার দণ্ডের পক্ষে ভোটের সংখ্যা আরো বেশি হবে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, আর ত্রিশটি ভোট আমার পক্ষে পড়লে অভিযোগ থেকে আমি মুক্তি পেতাম। এখন আমি বলতে পারি মেলিটাসের ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন করতে পেরেছি।
যেভাবে আত্মহনন
আমরা জানি প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের শিষ্য বা ছাত্র। বেঁচে ছিলেন ৮০ বছর। জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭। মৃত্যু খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৭। সক্রেটিস কোনো বই লিখে যাননি। সক্রেটিস সম্পর্কে বই লিখে গেছেন প্লেটো। প্লেটোর সংলাপ নামের বিখ্যাত বইয়ের মাধ্যমে প্লেটো কার্যত সক্রেটিসকে অমর করে তুলেছেন। যদিও সক্রেটিসের জীবন ও কর্মই তাকে অমর করে তোলার জন্য যথেষ্ট। সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় তার কাছে ছিলেন না প্লেটো। তবে তিনি জানতেন সেখানে কারা উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার প্লেটোর সংলাপ বইটিতে ক্রিটো সক্রেটিসের সেদিনের মৃত্যুচিত্র তুলে এনেছেন, যা মোটামুটি এমন :
সূর্যাস্তে সক্রেটিসকে বিষপানে আত্মহত্যা করতে হবে। তার আগে তিনি অনেকের সাথে দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন। সূর্যাস্ত প্রায় সমাগত। দর্শনগত আলোচনা শেষ। সবশেষে সক্রেটিস বললেন : ‘প্রিয় ক্রিটো, দুঃখবোধ করো না। প্রফুল্ল হয়ো এবং নিজের মনকে এই বলে প্রত্যয় দাও তুমি তো আমাকে সমাধিস্থ করবে না, করবে আমার দেহকে মাত্র। সে দেহ নিয়ে যা করা প্রয়োজন ও যা করা স্বাভাবিক, তাই তোমরা করো।’
এই বলে সক্রেটিস বসা থেকে উঠে গোসলের জন্য আরেকটি কক্ষে গেলেন। গোসল শেষে ফিরে এসে বসলেন। কারো সাথে কোনো কথা বললেন না। কিছুক্ষণ পর এসে সক্রেটিসের পাশে দাঁড়িয়ে কারা কর্মকর্তা বলতে লাগলেন : ‘সক্রেটিস, আমি জানি যত বন্দীকে এ কারাগারে আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে আপনার মতো উত্তম, মহৎ ও নম্র আর কেউ কখনো ছিল না। আমি কর্তৃপক্ষের আজ্ঞাবাহক। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দীর মুখে আমাকে বিষপাত্র তুলে দিতে হয়। যারা সাধারণ বন্দী তারা আমার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়। আমাকে কটুবাক্যে বিদ্ধ করে। কিন্তু আমি জানি আপনি প্রবুদ্ধ, আপনি আমার প্রতি বিরূপ হবেন না। আপনি জানেন, এ কাজের জন্য আমি দায়ী নই। এ দায় অপরের। আমি আপনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে এসেছি। আমার কর্তব্য আপনি জানেন। আমি শুধু এই বলব, আপনি যেন সব অনিবার্যকে সহজভাবে নেন।’
এ কথা বলতে বলতে কারা কর্মকর্তার চোখ ভিজে উঠল। কথা শেষ করে চোখে পানি নিয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। সক্রেটিস তখন কারা কর্মকর্তাকে লক্ষ করে বলেছিলেন : ‘আমার প্রতি তোমার এ শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ। তোমার নির্দেশ আমি পালন করব।’
এরপর সক্রেটিস অন্য দিকে ফিরে বললেন, ‘কী চমৎকার এ লোকটি! কারাগারে আমার আসার পর থেকেই প্রায়ই আমাকে দেখতে এসেছে; মাঝে মধ্যে আমার সাথে কথা বলেছে, সাধ্যমতো সদয় ব্যবহার করেছে। আর আজ গভীর দুঃখ প্রকাশ করল। ক্রিটো, তার কথা অমান্য করা আমার উচিত হবে না। সে যেরূপ বলেছে, আমার তেমনই করা উচিত। কাজেই বিষপাত্র প্রস্তুত হয়ে থাকলে তা তোমরা নিয়ে আসো। যদি প্রস্তুত না হয়ে থাকে, তবে পরিচারককে তা প্রস্তুত করতে বলো।’
তখন ক্রিটো বললেন, ‘সক্রেটিস, এখনো কিছু সময় আছে। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অনেক বন্দী বিষপানে বিলম্ব করছে। আমার অনুরোধ তুমি তাড়াতাড়ি কোরো না।’
সক্রেটিস এ কথার জবাব দিয়ে বললেন, ‘যে জীবনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার নিষ্ফল চেষ্টা করে আমি শুধু আমাকে নিজের কাছেই হাস্যস্পদ করে তুলব। কাজেই দয়া করে তোমরা আমার কথা অন্যথা করো না। আমি যেমনি বলেছি, তেমনি তোমার কাজটি সমাধা করো।
কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল কারাভৃত্য। ক্রিটোর ইঙ্গিত পেয়ে বাইরে চলে গিয়ে কিছুক্ষণ পর কারা র্কমকর্তাকে নিয়ে ফিরে এলো। কারা কর্মকর্তার হাতে বিষপাত্র। কারা কর্মকর্তাকে সক্রেটিস বললেন : দয়ালু বন্ধু, তুমি এসব বিষয়ে নিশ্চয়ই অভিজ্ঞ। দয়া করে বলো কিভাবে আমি অগ্রসর হবো।’ লোকটি তখন বললেন, বিষপানের পর আপনি পদচারণা করবেন। পদচারণায় যখন আপনার পা দু’টি ভারী হয়ে আসবে, শুধু তখনই শুয়ে পড়বেন। তাহলেই বিষক্রিয়া ভালোভাবে চলবে।’
এবার কারা কর্মকর্তা বিষপাত্রটি সক্রেটিসের হাতে দিলেন। সক্রেটিসের মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। মুখের রঙে কোনো পরিবর্তন নেই। শান্তভাবে কারা কর্মকর্তাকে বললেন, ‘এ পেয়ালা থেকে আমি কি স্রষ্টার উদ্দেশে কিছু অর্পণ করতে পারি?’ কারা কর্মকর্তা বলল, অতিরিক্ত নয়, প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিষই এখানে আছে।’ সক্রেটিস বললেন, ‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি বন্ধু! তাই হোক। শুধু স্রষ্টাকে ডেকে বলছি এ-লোক থেকে ও-লোকে আমার যাত্রাকে নির্বিঘ্ন করে দাও। আমার এ প্রার্থনা মঞ্জুর করা হোক।’
সক্রেটিস পদচারণা করতে লাগলেন। বিষ কাজ করতে শুরু করেছে। ক্রমেই পা ভারী হয়ে চলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। নির্দেশ মতো শুয়ে পড়লেন। কারাভৃত্য মাঝে মাঝে সক্রেটিসের পা দু’টি পরীক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর সে তার পায়ের তলায় জোরে চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সক্রেটিস তার চাপ অনুভব করতে পারছেন কি না। সক্রেটিস জবাব দিলেন : ‘না’। তখন সে ক্রমেই পায়ের উপরের দিকে চাপ দিয়ে অগ্রসর হতে লাগল। ক্রমেই শরীরের ওপরের দিক অসাড় হয়ে আসতে লাগল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে সব শেষ।
এভাবেই একজন সক্রেটিসকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। যিনি ছিলেন অতিমাত্রায় জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী। দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়াটা সব কথা না। আসলে কে বেঁচে আছে? যারা সক্রেটিসকে সরিয়ে দিয়েছে? নাকি সক্রেটিস বেঁচে গেছেন অনন্তকাল পর্যন্ত? ব্যাক্তিকে সরিয়ে দেয়া যায় হয়তো, কিন্তু সত্যকে কখনোই না।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ২ টি
১২ ফেব্রুয়ারি ’১৮ রাত ১২:০৬
ফিয়া:
একটা বিচারই শেষ কথা নয়, ধন্যবাদ ভাই এই সময়ে এমন একটি বিষয় উত্থাপন করার জন্য।