হাসাসিন: পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয়া গুপ্তঘাতক বাহিনী

১১৭৬ সালের সালের কথা। দিগবিজয়ী বীর সালাউদ্দিন আইয়ুবী, যিনি সালাদিন নামেই ব্যাপক পরিচিত। ক্রুসেডে ইউরোপিয়ানদের হটিয়ে তৃপ্ত হয়ে নিজ দেশের দিকে মনযোগ দিয়েছেন। প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে মিশর থেকে সিরিয়ার পথে রওনা করলেন সালাদিন। ঝড়ের মত ঢুকে পড়লেন সিরিয়ার আন-নুসারিয়া পার্বত্য অঞ্চলে। গোটা এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন ১৫/২০ দিনে। কিন্তু একটা দূর্গও দখল হলো না। প্রত্যেকটা দূর্গ পাহাড়ের মাথায়, চারদিক থেকে আক্রমণ সম্ভব না, অবরোধ না করে উপায় নেই। আর ৯ টা দূর্গ আলাদা আলাদা করে অবরোধ করতে হবে। মাসিয়াফ দূর্গ অবরোধ করতে হবে আগে, খবর আছে ওদের নেতা, রাশিদ আদ-দিন সিনান মাসিয়াফেই আছে।
মাসিয়াফ দূর্গটা খুব বিশাল না, কিন্তু দুর্ভেদ্য। কারণ পেছনে খাড়াই, দুপাশে খাদ, শুধু সামনে থেকে আক্রমণ করা যাবে। চতুর্দিক আগুন জ্বালিয়ে তাঁবুর চারপাশে শুকনো পাতা বিছানো, শব্দ গোপন করে কারো আসার কোন সুযোগ নেই, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন সালাদিন। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো, আচমকা। পেশাদার যোদ্ধার প্রশিক্ষিত সতর্কতা সালাদিনের। চোখ মেলেই দেখলেন, একটা ছায়ামূর্তি তাঁবুর পাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো। মাথার পাশে বালিশে ছুরি দিয়ে গাঁথা একটা ত্রিকোন প্রতীক, হাসাসিনদের প্রতীক, মানে ওটা বিষাক্ত ছুরি। তাতে একটা চিঠি আটকানো:
"মহামান্য খলিফা, ইচ্ছা করলেই ছুরিটা বালিশে না গেঁথে, আরো নরম কোথাও গাঁথা যেত। কিন্তু আপনাকে বোঝানোটাই জরুরী ছিলো। আপনাকে মেরে ফেলার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। আমাদেরকে আমাদের মত থাকতে দিন, নিজেও সুস্থ থাকুন। আমরা আপনার বন্ধু না হলেও শত্রু নই। আমি নিজে না এসে অন্য কাউকেও পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আপনার সম্মানার্থে, আমি নিজেই প্রস্তাব রেখে গেলাম। চলে যান এখান থেকে, আমাদের তরফ থেকে আপনার উপরে আর কোন হামলা হবে না
– রাশিদ আদ-দিন সিনান, আমির-ই-হাসাসিন"
সালাদিন দুদিন পরেই মিশরের পথে ফিরতি যাত্রা করেন। ১১৭৬ সাল ছিলো ৩০০ বছরেরও বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করা হাসাসিনদের যৌবনকাল বলা যায়। ১১৭৩ থেকে ৩ বছরে সালাদিনকে অন্তত ৫ বার খুন করার চেষ্টা করেছিলো তারা। এই ৩০০ বছরের মধ্যে ওরা অন্তত দুই জন খলিফা, আর অসংখ্য অসংখ্য উজির, সুলতান আর ক্রুসেড নেতাদের খুন করেছে, ছোটখাটো তো ছিলোই। গুপ্তঘাতকের ল্যাটিন পরিভাষা, Assassin, এই হাসাসিনদের থেকেই এসেছে।
এই কাহিনীর শুরু ১০৭০ এর দিকে, মিশর এবং আরব তখন শিয়া ফাতিমিদ খিলাফত এবং খলিফা একজন ইসমাইলি শিয়া, আল-মুস্তান। পারস্য, ইরাক ও সিরিয়া তখন সুন্নী সেলজুকদের দখলে। পারস্য শাষন করছে প্রধান উজির নিজাম-উল-মুলক, চরম শিয়া বিদ্বেষী । পারস্যের ১৭ বছরের তরুণ স্কলার হাসান-ই-সাব্বাহ একজন শিয়া সে ফাতিমিদ খলিফার আনুগত্য স্বীকার করলো, কয়েক বছরেই ফিদাই (সাধারণ সমর্থক) থেকে দায়িই (আদর্শ প্রচারক) তে পদোন্নতি হলো, এবং নিজাম-উল-মুলক'এর কোপানলে পড়ে গেলো। পারস্য এখন বিপদজনক, তাই হাসান ভাবলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র কায়রো ঘুরে আসা যাক, জ্ঞানও অর্জন হবে, খলিফাকেও দেখা হবে, আর খলিফাই তো ইসমাইলিদের ইমাম। ১০৭৬ এ রওনা দিয়েও পারস্য থেকে কায়রো যেতে দুই বছরের বেশি লেগে গেলো হাসানের। কারণ, পথে যতগুলো বড় শহর পড়েছে সবখানেই কিছুদিন থেকে মানুষের চিন্তাভাবনা, পলিটিকাল ধারণা, ধর্মীয় নেতাদের ভাবনা, এগুলো স্টাডি করছিলো হাসান। ফাইনালি হাসান যখন ১০৭৮ এ কায়রো পৌঁছালো, সেখানে তখন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছে। মুস্তানের বড় ছেলে নিজার, স্বাভাবিকভাবেই পিতার মৃত্যুর পরে তার খলিফা হবার কথা। কিন্তু প্রধান সেনাপতি বদর আল-জামালির ইচ্ছা পুরোই ভিন্ন কিছু। হাসানের খবর সবাই আগেই জানতো তাই উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলো। কিন্তু নাজিরকে সমর্থন দেয়ার কারণে সেনাপতি বদর তাকে জেলে পুরে দিলো, এবং কোন এক রাতের অন্ধকারে বন্দী হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর থেকে পারস্যের জাহাজে উঠিয়ে দিলো।
জাহাজ যখন দামাস্কাস বন্দরের কাছাকাছি তখন ঝড়ে পড়ে জাহাজ বিদ্ধস্ত হয় এবং হাসান সিরিয়ারই কোন এক উপকূলে ভেসে যায়। পরের ১০ বছরে হাসানের একটাই উদ্দেশ্য ছিলো, এই নাজির সমর্থক ইসমাইলি বা নিজারি ইসমাইলিদের সংগঠিত করা। সিরিয়া পারস্য আর ইরাকের সমস্ত এলাকা ঘুরে সবথেকে নিবেদিতদের নিয়ে বড় আকারে হাসাসিন (কোড অফ হাসান) নামে একটা এক্সিকিউটিভ গোষ্ঠী তৈরী করে এবং তাদেরকে যোগ্যতা অনুসারে তিনটে ইউনিটে ভাগ করে।
১) দাইই (প্রচারক)
২) রাফিক (প্রচারণা সঙ্গী)
৩) লাসিক (অনুগত নির্বাহক)।
ততদিনে নিজাম উল মুলক'এর টনক নড়েছে, একা হাসানই যথেষ্ট মাথা ব্যাথার কারণ ছিলো ১২ বছর আগে, এবারে সে দলবল নিয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। সেনাবাহিনী পাঠায় নিজাম, হাসানকে দলবলসহ চিরতরে বিনাশ করতে। হাসান তার দল নিয়ে আল বুর্জ পার্বত্য অঞ্চলের এত গভীরে ঢুকে যায়, যে গোটা পারস্য ফোর্স দিয়েও হয়তো ওদের খুঁজে বের করা সম্ভব না। ওখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকা অবস্থায় হাসান ভাবতে থাকে, নিজেদের একটা শক্তিশালী আস্তানা দরকার, যেখান থেকে নিজেদের কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা যাবে। তার মনে পড়ে বেশ কিছুদিন আগে দেখা, আলামুত নামে একটা পার্বত্য দূর্গের কথা।
তৎকালীন পারস্যের রুদবার নামে পার্বত্য এলাকায়, পর্বতশ্রেণীর মাঝে ৫০ কিলোমিটার লম্বা ও ৫ কিলোমিটার চওড়া একটা উপত্যকার মাথায় অবস্থিত আলামুত দূর্গ, প্রাকৃতিক সুরক্ষায় সুরক্ষিত। জানা যায়, প্রায় বিনা রক্তপাতে দখল করেছিলো আলামুত। প্রথমে ঐ এলাকায় দাইই এবং রফিকদের পাঠানো হয়, যারা আলামুত উপত্যকার সাধারণ মানুষের মন জয় করে তাদের ইসমাইলি আদর্শে দীক্ষিত করে। এরপরে ১০৯০ এর দিকে সাধারণের সাথে ভিড়িয়ে দেয়া হয় লাসিকদের এবং লাসিকরা দূর্গে অনুপ্রবেশ করেই দূর্গাধিপতি এবং তার কাছের লোকজনকে জিম্মি করে ফেলে। ফলাফল, প্রায় বিনা রক্তপাতে দূর্গ দখল। এর পরে আরো ৩৫ বছর জীবিত ছিলো হাসান-ই-সাব্বাহ, কিন্তু একদিনের জন্যেও আলামুত ছেড়ে বের হয় নি। ব্যস্ত ছিলো দর্শন, স্থাপত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, এলকেমি, চিকিৎসা শাস্ত্র ও গণিত নিয়ে গবেষনায় এবং অবশ্যই হাসাসিনদের প্রশিক্ষন ও নিজারি ইসমাইলি দর্শন প্রচার, প্রসার এবং নীতি নির্ধারণে।
হাসাসিনিদের প্রশিক্ষন শুরু হতো ১০/১২ বছর বয়স থেকে। ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক আচরণ এবং পাশাপাশি অস্ত্রকৌশল বিশেষ করে নাইফ ফাইটিং, ছদ্মবেশ, আত্ম নিয়ন্ত্রণ এবং সমরকৌশলের শিক্ষা দেয়া হতো। ৭/৮ বছরের মধ্যেই ওরা হয়ে উঠতো লিভিং উইপন, ফিদায়ান (আত্ম নিবেদিত যোদ্ধা)। যেকোন মূল্যে সিভিলিয়ানদের উপরে কোন আঘাত নয়, এই ছিলো ওদের কৌশল। যে কোন এলাকায় গিয়ে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে একদম মিশে যেত একজন হাসাসিন। টার্গেটের সাইকোলজি স্টাডিও ওদের কৌশলের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। শোনা যায় একটা এসাসিনেশন প্রচেষ্টার শারীরিক ও মানসিক শক্তিবৃদ্ধি ও স্থিরতার জন্য শেষ ধাপের আগ মুহুর্তে ওরা হাশিশ ব্যবহার করতো, যদিও এই ধারণা তর্কসাপেক্ষ। সচরাচর বিষ মাখানো ছুরিই ব্যবহার করতো ওরা খুনের জন্যে এবং খুনগুলো করা হতো সর্বসম্মুখে, যেন লোকে বোঝে এটা হাসাসিনদের কাজ। আতঙ্ক সৃষ্টি করা হাসাসিনদের রাজনৈতিক কৌশল। পারস্য এবং সিরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের আলাদা আলাদা এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠে ইসমাইলি রাষ্ট্র এবং পুরোটাই হাসাই-ই-সাব্বাহ'র জীবৎকালে।
হাসাসিন রাষ্ট্র গঠনের প্রধান পদক্ষেপ ছিলো নিজাম-উল-মুলক'কে হত্যা এবং হত্যাকান্ড ঘটানো হয় প্রকাশ্য দরবারে। নিজাম-উল-মুলকই প্রথম হাই প্রোফাইল খুন। সেলজুকেরা প্রথম থেকেই হাসাসিনদের উচ্ছেদের প্রচেষ্টা চালায়, ফলশ্রুতিতে ওদের অন্তত ৫ জন সুলতান খুন হয় এদের হাতে। মিশরের ফাতিমিদ খিলাফতকে উচ্ছেদ করার পরে সুন্নি খলিফারা ইসমাইলিদের উপরে অত্যাচার শুরু করে, সে সময় অন্তত দুই জন খলিফা খুন হয় হাসাসিনদের হাতে। গ্রান্ড মাস্টার রাশিদ আদ-দিন সিনানের সময়ে হাসাসিন এবং সারাসিনদের কমন শত্রু হয়ে দাঁড়ায় ক্রুসেডাররা। শোনা যায়, কিং রিচার্ডের সাথেও একটা সময় সন্ধি চুক্তি হয় রাশিদের। রাশিদের মধ্যস্ততায়ই সালাদিন ও রিচার্ড সাময়িক সন্ধি করে, যা ক্রুসেডারদের সহায়তা করে। কেন ক্রুসেডারদের সাথে হাসাসিনদের সখ্যতা তৈরী হয় তা অবশ্য জানা যায় নি।
সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ারও হাসাসিনদের পছন্দের কৌশল ছিলো, খুন করার ঝামেলায় না গিয়ে ভয় দেখিয়ে সাবমিশনে বাধ্য করা। সেলজুক সুলতান মোহাম্মদ তাপারকে খুন করার পরে ওর ছেলে সাঞ্জার যখন সুলতান, সালাদিনের মত একই পদক্ষেপ নেয়া হয়, হাসাসিন দূতকে দরবার থেকে চাবকে বের করে দেয়ার পরে। সাঞ্জার ভয় পেয়ে শুধু হাসাসিন এলাকার কর আদায় বন্ধ করেনি, ঐ এলাকার সমস্ত কর আদায়ের অধিকারও হাসাসিনদের দিয়ে দেয়। পারস্য থেকে তুরষ্ক, সিরিয়া থেকে মিশর, যখনই যেখানে নিজারি ইসমাইলিদের উপরে আঘাত এসেছে, হাসাসিনরা সেখানেই অপারেট করে গেছে প্রায় দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
১২৫০ এর দিকে হাসাসিনরা একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসে। মোঙ্গল শাসক মোংকে খানকে খুন করে। পরবর্তি খান, হালাকু ক্ষমতায় বসেই প্রধান সেনাপতি কিতুবাকে নিযুক্ত করে হাসাসিনদের সমূলে বংশে বিনাশ করতে। ১২৫৩ থেকে কিতুবা হাসাসিনদের ৯ টা দূর্গে উপর্যুপরি হামলা চালিয়েও যখন সুবিধা করতে পারলো না, হালাকু খান স্বয়ং আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে আসে ১২৫৬ তে। ফাইনালি ১২৫৬'র ডিসেম্বরে আলামুত দূর্গ অবরোধ করা হয়। প্রায় ৩/৪ মাসের অবরোধে থাকার পরে হাসাসিনরা গোপন পথে আলামুত ছেড়ে চলে যায়। ১২৭৫ এ ফের আলামুত দখল করে হাসাসিনরা, কিন্তু ততদিনে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নি:শেষিত।
পরবর্তি ১০০ বছরে মামলুকরা হাসাসিনদের নিজেদের কাজে লাগাতো। চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতা, মামলুক সালতানাত ভ্রমণের সময় হাসাসিনদের সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলো, যেমন খুন প্রতি ফিক্সড রেট কত। কিন্তু শেষপর্যন্ত হাসাসিনরা তাককিয়া (আদর্শ ও আত্মপরিচয় গোপনের নীতি) অবলম্বন করে অপেক্ষা করতে থাকে, কবে তাদের মধ্য থেকে একজন গ্রান্ড মাস্টার উঠে আসবে এবং ফের তারা পূর্বের গৌরবে ফিরবে। এভাবেই মোটামুটি ৩০০ বছরের মধ্যেই সে যুগের সবথেকে দুধর্ষ ও আতঙ্কজাগানিয়া হাসাসিন গোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.