যেভাবে হল ভাষার সংগ্রাম
দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রেভাষা যে হিন্দী হবে, সে সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয় ঘটে।
উপমহাদেশের হিন্দুদের হিন্দী-প্রীতির বিপরীতে মুসলমানদের মধ্যে উর্দুর প্রতি দুর্বলতা ছিল বহুদিন ধরে। উপমহাদেশের মুসলমানদের একটা প্রাচীনপন্থী ও আধুনিকপন্থী উভয় শিক্ষার শ্রেষ্ঠতা দু’টি কেন্দ্র যথাক্রমে দেওবন্দে আলীগড় উর্দু অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় উপমহাদেশের প্রচীন ও আধুনিক উভয় শ্রেণির উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেও উর্দুর প্রতি একটা বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছিল। এসব কারণে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যখন হিন্দী হয়েছে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
কিন্তু ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদাই ছিল আলাদা। উপমহাদেশের ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলা শুধুু উন্নততম ভাষাই ছিল না, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সমস্ত পাকিস্তানের শতকরা ৫৪ ভাগ মানুষের মাতৃভাষাও ছিল বাংলা। এর ফলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উঠা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষীদের বিরাট সংখ্যাধিক্য থাকায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই উর্দুকে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার একটা নীরব ষড়যন্ত্র দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। এদিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পুর্ব থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে একটা বির্তক চলে আসছিল রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাককালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দিলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার কঠোর প্রতিবাদ জানান। এক শ্রেণির হীনমন্যতাগ্রস্ত বাঙ্গালির মধ্যে উর্দুর প্রতি দুর্বলতার তীব্র সমালোচনা করে ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করেন কবি ফররুখ আহমদ।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দু‘সপ্তাহের মধ্যে গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখেই “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে। এই পুস্তিকায় তিনটি নিবন্ধ স্থান পায়। একটি অধ্যাপক আবুল কাসেমের। অপর দু’টি কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমদের। অধ্যাপক আবুল কাসেম তার ‘আমাদের ভাষা’ শীর্ষক নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল ছবি তুলে ধরে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি বাংলা ও উর্দু এবং পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালত শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা।
একাধিক ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানের মূল ভিত্তি ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহে অধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে। আমরা আপাতত শুধু বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাই। অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখায় লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখ ছিল বিশেষ তৎপর্যপূর্ণ। কারণ পরবর্তীকালে এই লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীর আলোকেই দেশে স্বায়ত্ত্বশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই স্বাধীনতার চেতনাকে পাকিস্তানী বাহিনী ধ্বংস করে দিতে ঔদ্ধ্যত হলে জনগণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
তমুদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাশেম ভাষা আন্দোলনের মেনিফেষ্টো রুপী পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেননি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ব্যক্তি সংযোগ, ঘরোয়া বৈঠক ও আলোচনা সভা, সরকারের কাছে বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষরসহ স্মারকলিপি পেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রসভা অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৪৭ সালেই ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক তমদ্দুন মজলিসের সদস্য অধ্যাপক (পরে ডক্টর ) নূরুল ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এই সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। এরপর দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে। এসময়ে গণপরিষদে প্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলায় কথা বলার দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে এই দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম হরতাল বিপুল ভাবে সাফল্যম-িত হয়। রেল শ্রমিক কর্মচারীদের সংস্থা পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ বাংলা ভাষার দাবি সমর্থন করায় ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে কেনো ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারেনি। ঢাকার সেক্রেটারিয়েটে গেটে পিকেটিং করতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম পুলিশের লাঠি চার্জে আহত হন। অলি আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ অনেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এ খবর শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা এসে সেক্রেটারিয়েটের চারিদিকে জমায়েত হতে থাকে। ফলে চারিদিকে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা চলে ১১ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত। এতে তদানীন্তন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ভীত হয়ে পড়ে ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাদের সকল দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।
খাজা নাজিমুদ্দিনের এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে আরেকটা কারণও ছিল। ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম জিন্নাহর ঢাকা আসার কথা। তিনি ঢাকায় এসে এ ধরনের অরাজক অবস্থা দেখলে খুশী হবার কথা নয়। জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে প্রথমে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় পর ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সমাপনী ভাষণ দেন। উভয় ভাষণেই তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। উভয় স্থানেই তার ভাষণের রাষ্ট্রভাষা অংশের প্রতিবাদ হয়। রেসকোর্সের জনসভার প্রতিবাদ তিনি লক্ষ্য করেননি। কিন্তু কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তার বক্তব্যের সামনাসামনি প্রতিবাদে তিনি স্থিমিত হন এবং ভাষণ সংক্ষেপ করে হল ত্যাগ করেন। পরেরদিন তিনি সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক ঘরোয়া সভায় মিলিত হন। উভয় পক্ষেই নিজ নিজ বক্তব্যে অটল থাকায় আলোচনা ব্যর্থ হয়। প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক মরহুম অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, সে সময় কায়েদে আজমের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে বাংলা ভাষার সংগ্রাম দ্রুত জোরদার করা সম্ভবপর হয় না। বাংলার প্রতিরক্ষণের ক্ষোভ চাপা আগুনের মত মানুষের মনে ধিকি-ধিকি জ্বলতে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের একটা চক্রান্ত হয় ১৯৪৯ সালে। কিন্তু তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবাদের মুখে সরকার চক্রান্ত থেকে পিছুটান দিতে বাধ্য হয়। এদিকে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১১মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করে জনগণ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানিয়ে দেয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তারা এখনও অটুট রয়েছে।
এদিকে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যু হলে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনের এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ঘোষণা দেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে।
যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ ভাষা আন্দোলনের সকল দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন , তার এ ভাষণকে জনগণ চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই চিহ্নিত করে এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। নতুন করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তমুদ্দুন মজলিস, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ প্রভূতি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে। নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা।
সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস বানচালের উদ্দেশ্য ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলা ঢাকায় হঠাৎ ১৪৪ ধারা জারি করে। পরদিন বাংলা ভাষার সমর্থক ছাত্র জনতার উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করায় শফিক ,রফিক, সালাম, বরকতদের রক্তে ভাষা আন্দোলন এক অনন্য উচ্চতায় অপ্রতিরোধ্য রূপ ধারণ করে। ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরুদ্ধে সকল প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিরোধিতার পালার ইতি হয়। এরপর ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলা সমর্থক যুক্তফ্রণ্টের হাতে পূর্বতন শাষকদল মুসলিম লীগ শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। এরপর যুক্তফ্রণ্টের সদস্যদের ভোটে যে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয় যেখানে ১৯৫৬ সালে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করা হয়। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক বিজয় সূচিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করা। এ ব্যাপারে বিশেষ করে অনেক শিক্ষাবিদের মধ্যে অনেকের মধ্যেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। তমুদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ষাটের দশকে বাংলা মাধ্যমের প্রথম কলেজ বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দেন যে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে দেশে যে স্বায়ত্তশাষন ও স্বাধিকার আন্দোলন এগিয়ে যায় তারই পরিণতিতে একাত্তরে নয় মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯৭২ সালে রচিত এ রাষ্ট্রের সংবিধানে বাংলাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা ঘোষিত হওয়ায় ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.