কোয়ান্টাম মেথডঃ ইসলামী চিন্তাধারার সাথে কি সাংঘর্ষিক?
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীন। দুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূল। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্যই নির্ধারিত।
পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যঃ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হল খিলাফাতের মর্যাদায় আল্লাহ তা'য়ালার ইবাদাত। আল্লাহ তা'য়ালা মানব জাতিকে দুনিয়ায় তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। গোলামের নিজের কোন মত বা পছন্দ থাকে না, বরং তার প্রভুর মত ও পছন্দই গোলামের কাজ- এটাই ইবাদাতের মুল শিক্ষা। আল্লাহর জিকির আর ইবাদাতের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব হৃদয়ের অনাবিল প্রশান্তি, মানসিক সুস্থতা ও মানব জীবনের সার্বিক উন্নতি। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর ইবাদাত প্রসংগে বলেন :
আমি জ্বীন ও মানব জাতিকে কেবলমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। -(সূরা যারিয়াত : আয়াত- ৫৬)
আর আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর পথভোলা বান্দাদের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করে মুক্তি ও কল্যাণের সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। হযরত মুহাম্মাদ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে তিনি তাঁর মনোনীত পথ-নির্দশিকার পূর্ণতা দান করেছেন। তাই আল্লাহর অনুগত বান্দাগণকে সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, মুক্তি ও কল্যাণের একমাত্র পথ হল সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-গণের নমুনায় রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ।
দুনিয়ায় মানব জীবনের লক্ষ্য হল হৃদয়ের অনাবিল প্রশান্তি, মানসিক সুস্থতা ও মানব জীবনের সার্বিক উন্নতি। শান্তি মুক্তি ও কল্যাণের আশায় বিভ্রান্তির বেড়াজালে নিপতিত দিশেহারা মানবজাতি যুগে যুগে বিভিন্ন পথ (যেমনতত্ত্ব-যোগসাধনা, তন্ত্র-মন্ত্র, ধ্যান-মেডিটেশন, তপ-জপ ইত্যাদিসহ) বিভিন্ন মতের উদ্ভাবন, পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ করেছ। মানব জীবনে আল্লাহর মনোনীত পথ-নির্দশিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে যে কোন প্রতিকুলতায় এ সব শিরক, কুফর, বিদআত, জাহিলিয়াত, ও তাগুতমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমানের উপর অবিচল থাকা কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার অসীম অনুগ্রহের ফলেই সম্ভব। এই অবিচলতা মানব মনে এনে দেয় অনাবিল মানসিক প্রশান্তি। সুতরাং প্রশান্তির বিষয়টি আল্লাহর মনোনীত পথ-নির্দশিকা তথা দ্বীন ইসলামের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
অপরপক্ষে আল্লাহর মনোনীত পথ-নির্দশিকা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মানব মনে অতৃপ্তি ও হাহাকার সৃষ্ট হয়। প্রশান্তির আশায় তখন সামনে যা পায় তাই অবলম্বন করতে সে দ্বিধাবোধ করে না। আল্লাহর মনোনীত পথ-নির্দশিকা সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগে মানসিক অতৃপ্তি ও অশান্তির বর্তমান ক্রান্তি লগ্নে প্রশান্তি এবং সাফল্যের চাবিকাঠির প্যাকেট নিয়ে উপস্থিত হয়েছে - কোয়ান্টাম মেডিটেশন। বহু হতাশাগ্রস্থ ও বিভ্রান্ত মানুষ কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে একেই খড়-কুঁটো ভেবে আঁকড়ে ধরছেন। আসুন ! ইসলামের দৃষ্টিতে এই পদ্ধতিটি একটু পর্যালোচনা করি।
কোয়ান্টাম মেথড কি:
তাদের ভাষ্যমতে এককথায় এটি হল- science of living. আশ্রম ও খানকার চৌহদ্দি থেকে বের করে ধ্যানকে গণমানুষের আত্মউন্নয়ন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে প্রয়োগ করাই তাদের উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য যে, লেখাটিতে ব্যবহৃত কোয়ান্টাম মেথড সংক্রান্ত সকল তথ্য তাদের ওয়েবসাইট, লিফলেট এবং টেক্সটবুক (সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড- মহাজাতক : পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণঃ জানুয়ারী, ২০০০) থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। কোয়ান্টাম মেথড বলতে আসলে তারা কি বুঝাচ্ছেন তা জানার উদ্দেশ্য আমরা ওয়েব সাইট থেকে প্রাপ্ত ‘সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড-মহাজাতক’ বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ের মূল বক্তব্যের উপর আলোকপাত করব। সাথে সাথে এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব এবং টেক্সটবুকটির পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করার চেষ্টা করব।
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)- মেডিটেশন : শৃঙ্খলা মুক্তির পথ
আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষ অপার সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু ভ্রান্ত বিশ্বাস/ সংস্কার তথা মনোজাগতিক শিকল তাকে পরিণত করে কর্মবিমুখ, ব্যর্থ কাপুরুষে। অন্যদিকে মুক্ত মানুষ বিশ্বাস হচ্ছে সকল সাফল্য অর্জনের ভিত্তি। বিশ্বাসই রোগ নিরাময় করে, ব্যর্থতাকে সাফল্যে আর অশান্তিকে প্রশান্তিতে রূপান্তরিত করে। দৈনন্দিন জীবন বেশিরভাগ চিন্তাশীল মানুষের জন্যই যুগে যুগে ছিল এক ক্লান্তিকর বিড়ম্বনা। ভাত খাওয়া, গোসল করা, কাপড় পরা, সংসার করা, প্রার্থনা করার একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি চেয়েছেন তারা।
ভ্রান্ত ধারণা ও সংস্কারের শৃঙ্খল মুক্তির পথ হচ্ছে মেডিটেশন। তখন প্রতিবারের প্রার্থনাতেঁই আপনি পুলকিত হবেন, প্রতিটি সেজদাই পরিণত হবে মেরাজে। মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার ‘অন্তরের আমি’র সাথে, আপনার শক্তির মূল উৎসের সাথে। মেডিটেশনের পথ ধরেই আপনি অতিক্রম করতে পারবেন আপনার জৈবিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা।
এ প্রসংগে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
ভ্রান্ত ধারণা ও সংস্কারের শৃঙ্খল মুক্তির পথ হচ্ছে মেডিটেশন- ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মারাত্মক ভুল ধারণা। আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত চির কল্যাণময়, শান্তি ও মুক্তির পথ সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবেই মানুষ এ ধরণের মুখরোচক শ্লোগনে বিভ্রান্ত হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর জিকির, তওবা-ইস্তিগফার, মৃত্যুর স্মরন ও কুরআন তিলাওয়াত দ্বারাই কলবের কালিমা দুর হয়ে যায় এবং কলব পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়- হৃদয় প্রশান্ত হয়।
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
তারা এমন লোক, যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর যিকরে তাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। হুঁশিয়ার! আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়। - (সুরা রাদ : ২৮)
আল্লাহর জিকির : রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
প্রত্যেক জিনিস পরিস্কার করার জন্য যন্ত্র বা রেত আছে। আর কলবসমুহকে পরিষ্কার করার যন্ত্র হল আল্লাহর জিকির। -(বায়হাকী, ইবনে আবী শাইবাহ, তাবরানী মিশকাত)
তওবা ও ইস্তিগফার : হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
যখন কোন মু’মিন বান্দা গুনাহ করে তখন তার কলবের মধ্যে একটি দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যদি সে তওবাহ ও ইস্তিগফার করে তাহলে তার কলব পরিষ্কার হয়ে যায়। - (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
মৃত্যুর স্মরন ও কুরআন তিলাওয়াত: হযরত ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
নিশ্চয়ই কলবসমূহে মরিচা পড়ে যেমন লোহায় পানি লাগলে মরিচা পড়ে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! এটা পরিষ্কার করার উপায় কি? জবাবে তিনি বললেন : মৃত্যুকে খুব বেশি স্মরণ করা আর কুরআন তিলাওয়াত করা।
“প্রতিবারের প্রার্থনাতেঁই আপনি পুলকিত হবেন, প্রতিটি সেজদাই পরিণত হবে মেরাজে” - এটি একটি মুখরোচক শ্লোগান ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে আল্লাহওয়ালাগণের সোহবাতে মুরাকাবার ও মুজাহাদার মাধ্যমে এ ধরণের অবস্থা অর্জিত হতে পারে। মেডিটেশন বা যোগী-সন্নাসীদের ধ্যানের মাধ্যমে নয়। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
যা কিছু কাউকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে অথবা আগুন থেকে দূরবর্তী করে তার এমন কিছুই নেই যা কিনা তোমাদের জন্য স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি।-[তাবারানীর আল মুজাম আল কাবীর]
“মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার ‘অন্তরের আমি’র সাথে, আপনার শক্তির মূল উৎসের সাথে”- কোয়ান্টাম মেডিটেশনের এই দৃষ্টিভংগি ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। ইসলামের দৃষ্টিতে এই অন্তরের আমি এর অনুসরণের পরিণতি হল জাহান্নাম, বরং মুক্তির পথ হল-এই অন্তরের আমি এর অনুসরণ থেকে নিজেকে হেফাজত করা।
এ প্রসংগে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন :
অতঃপর যে সীমালংঘন করে, পৃথিবীর জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাস। আর যে নিজ প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং নাফ্সের (প্রবৃত্তির বা অন্তরের আমি এর ) অনুসরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার বাসস্থান।-(সূরা নাযিয়াত : আয়াত ৩৭-৪১)
অন্তরের এই আমি হল নাফসে আম্মারা, যার উপর শয়তান ভর করে মানুষকে বিপথগামী করে। আর শয়তানের ভর করা বা ওয়াস-ওয়াসা থেকে মুক্তির পথ হল- আল্লাহর জিকির। হযরত ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
শয়তান মানুষের কলবের মধ্যে আসন গেড়ে বসে থাকে। যখন সে আল্লাহর জিকির করে তখন শয়তান কলব ছেড়ে পিছনে সরে যায়। আর যখন জিকির থেকে অমনোযোগী হয়ে যায়, তখন আবার (কলবের মধ্যে) ওয়াস-ওয়াসা দিতে থাকে। - (ইমাম বুখারী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)
ইসলাম কেবল আল্লাহকেই সকল শক্তির মূল উৎস ও সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করে, যিনি আরশের উপরে অধিষ্ঠিত এবং যাঁর সাথে গোটা সৃষ্টির কারো কোন সাদৃশ্য নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে এখানে আর একটি মারাত্মক ভুল - মানুষের ভিতর স্রষ্টার অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, যা হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদ, যা একাধারে কুফর ও শিরক। যেমন-
হুলুল : কতিপয় বিভ্রান্ত সুফী ও অন্যান্য পথভ্রষ্ট দলের পরিভাষায় হুলুল সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার অবস্থান, গোটা সৃষ্টিজগতে কিংবা এর কোন অংশে। গোটা সৃষ্টিজগতে স্রষ্টার অবস্থানের মতবাদ এই যে স্রষ্টা সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সর্বত্র বিরাজমান।
ওয়াহদাতুল উজুদ : স্রষ্টা ও গোটা সৃষ্টি একই সত্তা হওয়ার মতবাদকে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’(وَحْدَة الوُجُود) বলা হয়। যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টির কোন অংশ একই সত্তা হওয়ায় বিশ্বাসী তারা ধারণা করে যে নবী, সৎকর্মশীল, দার্শনিক স্রষ্টারই অংশ! এরা শুধুমাত্র অপবিত্র-নোংড়া বস্তুকে স্রষ্টার অংশ হওয়া থেকে বাদ দেয়। আসলে আল্লাহর জাত নহে বরং কুদরত ও সিফাত সর্বত্র কার্যকর।
কতিপয় দার্শনিক এ সকল জাহিলী ও গোমরাহী মতবাদের অনুসারী ছিল। ইসলামের দৃষ্টিতে হুলুল ও ওয়াহদাতুল উজুদ ইত্যাদি ধারণাসমূহ সুস্পষ্ট কুফর, শিরক ও মারাত্মক ধর্মদ্রোহিতা। কদর্যতার দিক থেকে ওয়াহদাতুল উজুদ হুলুলের চেয়েও মারাত্মক, কেননা তা সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক সত্তায় পরিণত করেছে। সুতরাং এ ধরণের বিভ্রান্তি থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সন্ন্যাসবাদঃ ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম বা মানব স্বভাবজাত জীবন ব্যবস্থার নাম। পার্থিব লোভ লালসা ও ভোগ বিলাস যথাসম্ভব পরিত্যাগ করা ইসলাম ধর্মের একটি মৌলিক শিক্ষানীতি হলেও ইসলামে বৈরাগ্যবাদ বা সন্ন্যাসবাদের কোন স্থান নেই। আজকের খ্রিষ্টধর্মের ধর্ম প্রচারকদের মাঝে এর বহুল প্রচার থাকলেও এটা আসলে কোন ঐশী নির্দেশ নয়। খ্রিষ্টান ধার্মিকগণ যখন অনুভব করলেন বিবাহ ও ঘর-সংসার করে যথেষ্ট আখিরাতমুখিতা অর্জন করা যায় না, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানবীয় বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। ইসলামের মাঝেও একদল মানুষ অনুরূপ নতুন পদ্ধতির সূচনা করেন যাদের আক্বীদা, কার্যকলাপ কোন কিছুই শরীয়াহ সম্মত নয়।
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)- মন সকল শক্তির উৎস :
এরপর অধ্যায় ১,২ তে- মন সকল শক্তির উৎস, চেতনা অবিনশ্বর, প্রাণ রহস্যের চাবিকাঠি যে বিশ্বাস তা এক নতুন বিশ্বদৃষ্টি উন্মোচন (যাতে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করা যায় কোয়ান্টা ফিজিক্সের মাধ্যমে), বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং নানা সফল ব্যক্তিদের (যার মাঝে রয়েছে বিশিষ্ট ব্যালে নর্তকী, আত্মস্বীকৃত নাস্তিক স্টিফেন হকিং) জীবন কণিকা থেকে প্রমাণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিস্তারিত উদাহরণ দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃত এবং আত্ম উন্নয়নে ধ্যান পদ্ধতির প্রবর্তক প্রফেসর এম.ইউ আহমেদের। তিনি ক্লিনিক্যালী মৃত্যুবরণ করার পরও পুনরায় জীবন লাভ করেন শুধু তাকে বাঁচতে হবে, তিনি ছাড়া দেশে নির্ভরযোগ্য মনোচিকিৎসক নেই ......তার এই দৃঢ় বিশ্বাসের জোরে। -(পৃঃ ২২-২৪)
অধ্যায় ৩- এ ব্রেনকে কম্পিঊটারের সাথে তুলনা করে সকল প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অধ্যায় ৪ অনুযায়ী ব্রেনকে সুসংহতভাবে ব্যবহার করার নেপথ্যনায়ক হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। প্রোআক্টিভ হতে উৎসাহিত করা হয়েছে বাইবেল এবং কুরআনে উল্লেখিত ইঊসুফ (আ.) এর কাহিনী থেকে!
অধ্যায় ৫-এ ‘ধ্যানাবস্থার প্রথম পদক্ষেপ’ শিরোনামে ব্রেন ওয়েভ প্যাটার্ণ সারণী দেয়া হয়েছে, যেখানে থিটা লেভেল সম্পর্কে বলা হয়েছে মেডিটেশনকালে সাধকরা এই স্তরে প্রবেশ করেই মহাচৈতন্যের (super consciousness) সাথে সংযোগ স্থাপন করতেন। এর পরবর্তী লেভেল-ডেল্টাতে দরবেশ ঋষিরা এই স্তরেও সজাগ থাকেন আবার মহাচৈতন্যে লীনও হতে পারেন -(পৃঃ ৫৮)। যদিও এই মহাচৈতন্যের সংজ্ঞা বইটির কোথাও সুস্পষ্টভাবে দেয়া নেই।
এ প্রসংগে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
“মন সকল শক্তির উৎস, চেতনা অবিনশ্বর, প্রাণ রহস্যের চাবিকাঠি” কোয়ান্টাম মেডিটেশনের এ বিশ্বাস ও দৃষ্টিভংগি পরিস্কারভাবে কুফর ও শিরক। কেননা, ইসলাম কেবল আল্লাহকেই সকল শক্তির মূল উৎস ও সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করে। অন্য কোন কিছু সকল শক্তির উৎস, অবিনশ্বর, প্রাণ রহস্যের চাবিকাঠি মনে করা বা বিশ্বাস করা আল্লাহর সাথে সুস্পষ্ট শিরক।
“মেডিটেশনকালে সাধকরা এই স্তরে প্রবেশ করেই মহাচৈতন্যের (super consciousness) সাথে সংযোগ স্থাপন করতেন” - এই মহাচৈতন্যের ধারণা একটি ধংসাত্মক বিদআত, কুফুর ও শিরক। যা মানুষকে মূল্যবান ঈমান থেকে খারিজ করে এবং কুফর ও শিরকের পথে ধাবিত করে। ইসলাম মানুষকে আল্লাহর সাথে মহব্বতের সংযোগ স্থাপনের শিক্ষা দেয়, কোন প্রকার মহাচৈতন্যের সাথে নয় এবং তা অর্জনের একমাত্র পথ হল রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ।
এ প্রসংগে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন :
(হে রসূল!) আপনি বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-৩১)
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)- শিথিলায়ন :
মেডিটেশনের প্রথম ধাপ হচ্ছে ‘শিথিলায়ন’ যার মাধ্যমে ব্রেন ওয়েভকে আলফা লেভেলে নিয়ে মনের ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করা হয়। তাদের ভাষ্য:‘শিথিলায়ন’ পুরোপুরি আয়ত্ত হলেই আপনি মনের শক্তিবলয় নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হাতে পাবেন। ধ্যানাবস্থায় মন হয় ত্রিকালদর্শী, চেতনা অতিক্রম করে সকল বস্তুগত সীমা। মনের এই ধ্যানাবস্থার শক্তিকে প্রয়োগ করেই প্রাচ্যের সাধক দরবেশ ঋষিরা একদিন আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ইচ্ছা করেছেন – ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছা করেছেন – মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে। আপনিও এ চাবিকাঠিকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করতে পারেন অতিচেতনা। এই চাবিকাঠি দিয়েই দৃশ্যমান সব কিছুর পেছনে যে নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম কাজ করছে তার সবটাকেই আপনি নিজের ও মানবতার কল্যাণে সক্রিয় করে তুলতে পারবেন। -(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক : পৃঃ ৫৯)
এরপর অধ্যায় ৬ তে ‘শিথিলায়ন’ প্রক্রিয়া অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। অধ্যায় ৭ ও ৮ তে নানা আত্মবিনাশী প্রোগ্রাম যেমন নেতিবাচক চিন্তা, হতাশা, অনুশোচনা, রাগ, হীণমন্যতা ইত্যাদি মোকাবেলা করার অব্যর্থ কৌশল হিসেবে ‘শিথিলায়ন’ কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অধ্যায় ৯, ১০ তে আত্মবিকাশী প্রোগ্রাম হিসেবে অটোসাজেশন এবং মনছবির বিবরণ দেয়া হয়েছে। অধ্যায় ১১,১২, ১৩ তে যথাক্রমে কল্পনাশক্তি, মনোযোগ বাড়ানোর কৌশল জানানো হয়েছে। অধ্যায় ১৪ তে কোয়ান্টা সংকেত, অধ্যায় ১৫ তে জাগৃতি এবং ঘুম নিয়ন্ত্রনের উপায়, অধ্যায় ১৬ তে স্বপ্নের সৃজনশীল প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে যেখানে ইস্তেখারা সালাতকে বর্ণনা করা হয়েছে স্বপ্নচর্চা ও এর সৃজনশীল প্রয়োগের একটি বিশেষ মাত্রা হিসেবে। অধ্যায় ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১ গুলোতে যথাক্রমে ছাত্রজীবনে সফল হবার উপায়, কোয়ান্টাম নিরাময়, ওজন নিয়ন্ত্রনের উপায়, ড্রাগ এবং নেশা থেকে বিরত থাকার উপায় এবং সুস্বাস্থ্যের কোয়ান্টাম ভিত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এতক্ষণ ধরে বইটিতে ধ্যানের প্রথম ধাপের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীতে বাকি ধাপগুলোর ব্যাপারে শুধু আভাস দেয়া হয়েছে যাকে বলা হয়েছে অতিচেতনার পথে যাত্রা। এর পথ ধরেই কোয়ান্টাম গ্র্যাজুয়েটরা কমাণ্ড সেন্টার এবং প্রকৃতির সাথে একাত্মতার অনুভূতি লাভ করেন। নিচে আমরা বাছাই করা কিছু বিষয়ের উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
এ প্রসংগে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
শিথিলায়ণন প্রক্রিয়াকে আস্তিক-নাস্তিক, দরবেশ-ঋষি, মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য আত্মিক উন্নতির পথ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে যার নুন্যতম জ্ঞান রয়েছে তিনিও এই দাবীর অসারতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। ইসলামের বিধান অনুযায়ী আত্মিক উন্নতির পথ নির্ধারিত। এর সাথে বুদ্ধ, যোগী, সন্যাসী, ঋষিদের অনুসৃত শিথিলায়ন পদ্ধতির কোন সম্পর্ক নাই। কুরআন ও ছুন্নাহর বিধান অনুযায়ী আত্মিক উন্নতি কেবলমাত্র নিষ্ঠাবান মুসলিমদেরই হয়ে থাকে এবং তাদের আত্মিক উন্নতির স্তর ঈমান, ইয়াকীন ও আমলের বিশূদ্ধতার মাত্রার উপর নির্ভর করে।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদী ও অন্যান্য ধর্মলম্বীদের আদর্শ যেমন ভিন্ন, তাদের আত্মিক উন্নতির ধারণাও ভিন্ন। আসলে যাদের আত্মা কুফর ও শিরকের আবরণে আচ্ছাদিত তাদের আবার আত্মিক উন্নতি কুফর ও শিরকের দিকেই হয়ে থাকে, আল্লাহর মহব্বতের দিকে নয়। আর শিথিলায়ন ও মেডিটেশন পদ্ধতিতে যদি আত্মিক উন্নতি হয় তাহলে তা কখনও ইসলামের পথ হতে পারে না।
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : নিশ্চয়ই যারা কাফির, আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন অথবা না করুন, তাদের জন্য দুটোই সমান, তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তর ও কানসমূহের উপর (অবিরাম আল্লাহদ্রোহীতা ও নাফারমানীর কারণে) মোহর মেরে দিয়েছেন, তাদের চোখসমূহের উপর রয়েছে পর্দা এবং তাদের জন্য আছে চরম শাস্তি। (সূরা বাকারাহঃ আয়াত ৬-৭)
তিনি আরও বলেন : আর আমি বহু জ্বিন এবং মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখার চেষ্টা করে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনার চেষ্টা করে না। তারা পশুর মত, এমনকি পশুর চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট। বস্তুত তারাই উদাসীন। -(সূরা আরাফঃ আয়াত ১৭৯)
“ইচ্ছা করেছেন – ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছা করেছেন – মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে। আপনিও এ চাবিকাঠিকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করতে পারেন অতিচেতনা” –এ ধরনের বিশ্বাস ও কর্ম তৎপরতা পরিস্কার কুফর ও শিরক। ইসলাম কেবল আল্লাহকেই সকল শক্তির মূল উৎস, যাঁর সাথে গোটা সৃষ্টির কারো কোন সাদৃশ্য নেই। “কুন” শব্দ ব্যবহারে ইচ্ছার মাধ্যমে যে কোন ঘটানোর মালিক একমাত্র আল্লাহ। কোয়ান্টাম মেডিটেশনে এই “কুন” শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ইচ্ছা শক্তির প্রতিফলন সুস্পষ্ট শিরক।
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
যখন তিনি কোন কিছু করার ইচ্ছা করেন, তখন তাঁকে কেবল বলতে হয় হও- ফলে তা হয়ে যায়। অতএব মহাপবিত্র ও মহাপ্রশংসিত আল্লাহ। তাঁর হাতে আছে সকল বিষয়ের সকল ক্ষমতা। আর তাঁর নিকটেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। - (সূরা ইয়াসীন : ৮২-৮৩)
সুতরাং উল্লেখিত ধারণায় বিশ্বাস করলে, প্রয়োগ করলে এবং ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কিছু ঘটেছে বলে মনে মনে বিশ্বাস করলে তিনি ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যাবেন, আল্লাহর দরবারে কাফির ও মুশরিক হিসাবে গন্য হবেন, যদিও তিনি নিজেকে মুসলিম বলে ধারণা করেন, বা নামাজ-রোজা পালন করেন। কোয়ান্টাম এভাবেই সবাইকে শিরক ও কুফরের দিকে ধাবিত করছে।
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)-কোয়ান্টা ভঙ্গি :
আপনি মহামতি বুদ্ধসহ প্রাচীন ঋষিদের যে ভাস্কর্য দেখতে পান, তার বেশিরভাগই অভয়মুদ্রা করে সিদ্ধাসনে বসা। আর এই অভয়মুদ্রার আধুনিক নামই কোয়ান্টা ভঙ্গি। -( কোয়ান্টাম টেক্সটবুক : পৃঃ ১৬৩) কোয়ান্টা ভঙ্গির জ্যোতিষ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল- হাতের বুড়া আঙ্গুলের ক্ষেত্র হল শুক্র বা ভেনাসের ক্ষেত্র । আর তর্জনীর ক্ষেত্র হচ্ছে বৃহস্পতির ক্ষেত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে শুক্র ও বৃহস্পতি কল্যাণ ও সাফল্যের প্রতীকরূপে গণ্য। আর মধ্যমার ক্ষেত্র শনির ক্ষেত্র রূপে পরিচিত। শনি বিলম্ব ও বাধার প্রতীক। প্রাচীন ঋষিরা এ কারণেই ভেনাস ও জুপিটারের প্রবৃদ্ধিকেই সংযুক্ত করেছেন, এর সাথে শনির প্রভাবকে যুক্ত করতে চাননি। কোয়ান্টা ভঙ্গি করে হাত সামনে এনে খেয়াল করলে দেখবেন হাতে আরবী আলিফ, লাম ও হে অর্থ্যাৎ আল্লাহু হয়ে আছে। অর্থ্যাৎ কোয়ান্টা ভঙ্গি করার সাথে সাথে আপনি প্রকারান্তরে স্রষ্টাকে স্মরণ করছেন।’’ -( কোয়ান্টাম টেক্সটবুক : পৃঃ ১৬৪, http://quantummethod.org.bd/book/hajaro-prosner-jobab-1/12895)
কোয়ান্টা ভঙ্গির ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
“আপনি মহামতি বুদ্ধসহ প্রাচীন ঋষিদের যে ভাস্কর্য দেখতে পান,তার বেশিরভাগই অভয়মুদ্রা করে সিদ্ধাসনে বসা। আর এই অভয়মুদ্রার আধুনিক নামই কোয়ান্টা ভঙ্গি”- এ কোয়ান্টা ভঙ্গীকে আল্লাহকে স্মরণ করার যে উপায় হিসেবে দেখানো হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অভিনব একটি বৌদ্ধ ধর্মের সাধনার উদাহরণ। এটা বুদ্ধসহ প্রাচীন ঋষিদের ভঙ্গী। ইসলাম এ ধরণের কোন ভঙ্গীর শিক্ষা প্রদান করে না। এছাড়া আল্লাহর স্মরণ বা যিকির ইসলামের একটি প্রতিষ্ঠিত ইবাদাত। তাই এর উৎস অবশ্যই ওহী হতে হবে। আর কোয়ান্টা ভঙ্গীর যে অস্ট্রোলজিকাল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এবং শুক্র-বৃহস্পতি-শনির শুভ-অশুভ প্রভাবের যে ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে আবার এর সাথে আল্লাহকে সম্পর্কিত করা হয়েছে- যা সুস্পষ্ট কুফর ও শিরক। ইসলামে যে এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য তা দিবালোকের মত পরিষ্কার।
অন্য ধর্মের সাথে সামঞ্জস্য প্রসংগে হাদীসে এসেছঃ হযরত আবু উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচারের অনুকরণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে এবং যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়কে মহব্বত করবে, তাদের সাথে তার হাশর হবে।” -(সুনানে আবু দাউদঃ হাদীস নং ৩৫১৪)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য বা মিল রাখে, সে তাদেরই দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” -(মুসনাদে আহমদ)
যারা মুসলিম তারা কখনও বুদ্ধসহ প্রাচীন যোগী-ঋষিদের ভঙ্গী ও ধ্যান গ্রহন করেন না। ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান। এর মধ্যে বুদ্ধসহ প্রাচীন যোগী-ঋষিদের আদর্শ গ্রহন করার কোন সুযোগ নাই। মুসলিমগণ কখনও বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি গ্রহের প্রভাবকে সাফল্য বা ব্যর্থতার কারণ হিসাবে বিশ্বাস করে না। সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে কুরআন ও ছুন্নাহর মহান আদর্শ মেনে চলাই ইসলামের শিক্ষা। যারা বুদ্ধসহ প্রাচীন যোগী-ঋষিদের কোয়ান্টা ভঙ্গি গ্রহণ করে ধ্যান করে আল্লাহর দরবারে তারা তাদের তাদেরই দলভূক্ত বলে গন্য হবেন। তারা কখনও রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবাগণের দলভূক্ত বা মুসলিম উম্মাহভুক্ত বলে গণ্য হবেন না।
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)- মনছবি :
শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মাঝে এমন এক ক্ষমতা তৈরি হয় যার ফলে সে তার কল্পনা শক্তি দ্বারাই নিজের চাওয়া পাওয়া পূরণ করে ফেলতে পারে। কোয়ান্টাম টেক্সটবুক এ উল্লেখিত একটি ঘটনা হুবহু তুলে ধরা হলঃ এক ইঞ্জিনিয়ার।সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার মনছবি দেখতে লাগল। ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। ভিসা পাওয়ার পর মনছবি দেখতে লাগল সমমানের চাকরির, যাতে নিজের প্রকৌশল জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারেন। দেশে তিনি কাজ করতেন বিদেশি প্রতিষ্ঠানে। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যে একই প্রতিষ্ঠানে আগের চেয়েও দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি হয়ে গেল তার। -(পৃঃ ১১৫)
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)- কোয়ান্টাম নিরাময় :
রোগের মূল কারণকে মানসিক আখ্যায়িত করে এখানে মেডিটেশনের মাধ্যমে সকল রোগ ব্যাধি উপশমের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মনছবি বা ইমেজ থেরাপি ছাড়াও রয়েছে ‘দেহের ভিতরে ভ্রমণ’ নামক পদ্ধতি যেখানে রোগীকে প্রথমে শিথিলায়ন করতে বলা হয়, তারপর শরীরের নানা অঙ্গের মধ্য দিয়ে কাল্পনিক ভ্রমণ করতে বলা হয়। এতে সে তার সমস্যার স্বরূপ সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি লাভ করে এবং নিজেই কমান্ড সেন্টারের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। শিথিলায়ন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে, শিথিলায়নের মাধ্যমে ব্যথা উপশম করার জন্য আপনাকে সাধু সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু হবার প্রয়োজন নেই। এজন্য নির্বাণ বা ফানাফিল্লাহর স্তরেও আপনাকে যেতে হবেনা। -(পৃঃ ১৯০)
যেমন: একজন ক্যান্সারের রোগী তার ক্যান্সারের কোষগুলোকে কল্পনা করে সর্ষের দানারূপে। আর দেখে অসংখ্য ছোট ছোট পাখি ওই সর্ষে দানাগুলো খাচ্ছে। আর সর্ষের দানার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। আস্তে আস্তে সর্ষের দানা নিঃশেষ হয়ে আসছে। সর্ষের দানাও শেষ, নিরাময়ও সম্পন্ন। -(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক : পৃঃ ১৯৪)
মনছবি ও মনের শক্তির ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
মেডিটেশন পদ্ধতিতে নিজের ওপর তাওয়াক্কুল ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার শিক্ষা দেয়া হয়, বলা হয় : তুমি চাইলেই সব করতে পার। এ ব্যাপারে কোয়ান্টামের বক্তব্য : মনের এই ধ্যানাবস্থার শক্তিকে প্রয়োগ করেই প্রাচ্যের সাধক দরবেশ ঋষিরা একদিন আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ইচ্ছা করেছেন-ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছা করেছেন-মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে, যা পরিস্কার শিরক। অন্তরের ইবাদতসমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল তাওয়াক্কুল - যা আল্লাহ ছাড়া আর কারও ওপর করা যাবে না। কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া এমন কোন সত্তার ওপর এমন কোন ব্যাপারে তাওয়াক্কুল করে যা সংঘটনের ক্ষমতা তার নেই, তবে তা বড় শিরক হবে যা একজন ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডীর বাইরে নিয়ে যায়।
“ইচ্ছা করেছেন-ঘটনা ঘটেছে, ইচ্ছা করেছেন-মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে”- এরূপ বিশ্বাস ও দাবী মানুষেদরকে মনের অজান্তেই ঈমান থেকে খারিজ করে কুফর ও শিরকের মধ্যে নিপতিত করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মনছবি বা মনের শক্তিতে কোনকিছুই ঘটে না, বরং কেবলমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায়ই সব কিছু ঘটে থাকে। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা বা তাকদীরই সব কিছুর উপর বিজয়ী হয়। মনছবি বা মনের শক্তি আল্লাহর নির্ধারিত পরিকল্পনা কখনও পরিবর্তন করতে পারে না।
তাহলে দেখা গেল যে, মনের স্বাধীন শক্তির এই ধারণাটি ইসলামের শিক্ষার সাথে রীতিমত সাংঘর্ষিক। মনের এমন কোন ক্ষমতা নেই, যা প্রকৃতির নেপথ্য শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জৈবিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা বা স্থান-কালের ঊর্দ্ধে যেতে পারাও সম্ভব নয় মানব আত্মার পক্ষে। আল্লাহ ব্যতীত আর কোন শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করাই শিরক।
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)- কোয়ান্টা সংকেত:
বইটির সংশ্লিষ্ট অংশে বলা হচ্ছে-‘‘ কথিত আছে অলৌকিক শক্তিবলে ঋষিরা ইসম বা মন্ত্র উচ্চারণ করতেন আর যাদুর মত সব ঘটনা ঘটে যেত। যে কোন ঋষিরা মন্ত্র উচ্চারণের আগে বছরের পর বছর ইসম বা মন্ত্র জপ করতেন বা জিকির করতেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আল্লাহ, ইয়াহু, ইয়া হক, ওম ইত্যাদি। ধর্মবহির্ভূত ধ্যানীরা নিজের পছন্দমত কোন শব্দ লক্ষ লক্ষবার উচ্চারণ করেন। তাদের বিশ্বাস এইভাবে অগণিতবার উচ্চারণের ফলে এই ধ্বনি এমন এক মনোদৈহিক স্পন্দন সৃষ্টিতে সহায়ক হয় যার ফলে সে তার মনোদৈহিক শক্তি পুরোপুরি একাগ্রভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।’’-(পৃঃ ১৬১)
এ প্রসংগে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
যে কোন ঋষিরা মন্ত্র উচ্চারণের আগে বছরের পর বছর ইসম বা মন্ত্র জপ করতেন বা জিকির করতেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আল্লাহ, ইয়াহু, ইয়া হক, ওম ইত্যাদি - এরা যোগী-ঋষিদের মন্ত্র জপ, হিন্দু সন্যাসীদের ওম আর আল্লাহর জিকিরকে একই মানদন্ডে নিয়ে এসেছে এবং অলৌকিক শক্তি অর্জনের মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করেছে ; যা হচ্ছে র্সবশ্বেরবাদ, যা একাধারে কুফর ও শিরক। ইসলামে মুনী-ঋষি বা যোগী-সন্যাসীদের ন্যায় এ ধরনের ইসম বা মন্ত্রজপ বা জিকিরের কোন অস্তিত্ব নাই। যার মধ্যে ইসলামের নুন্যতম শিক্ষা রয়েছে, তিনি অবশ্যই বৌদ্ধ, যোগী-ঋষি ও হিন্দু সন্যাসীদের পথ পরিহার করবেন এবং সর্বদা রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ অনুসরণ করবেন।
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)-কমান্ড সেন্টার :
কমান্ড সেন্টারকে একথায় বলা যায় মনের বাড়ির শক্তি ও কল্যাণ কেন্দ্র।মানব অস্তিত্বের যে অংশ স্থান কালে আবদ্ধ নয়, সে অংশ এই কমান্ড লেভেলে প্রকৃতির নেপথ্য নিয়ম ও স্পন্দনের সাথে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করে । যাকে তারা জীবনে কখনও দেখেননি, যার কথা জীবনে কখনও শোনেননি, শুধু তার নাম, বয়স ও ঠিকানা বলার সাথে সাথে তার এমন হুবহু বর্ণনা দিতে সক্ষম হন কোয়ান্টাম গ্র্যাজুয়েটরা যে প্রশ্নকর্তা নিজেই অবাক হয়ে যান।-( পৃঃ ২৩৩)
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)-কমান্ড সেন্টারের প্রয়োগ :
‘‘ছেলে কোলকাতায় গিয়েছে, যাওয়ার পরে ২ দিন কোন খবর নেই।বাবা কোয়ান্টাম গ্র্যাজুয়েট, মাগরিবের নামাজ পড়ে মেডিটেশন কমান্ড সেন্টারে গিয়ে ছেলের বর্তমান অবস্থা দেখার চেষ্টা করতেই কোলকাতার একটি সিনেমা হলের গেট ভেসে এল।ছেলে সিনেমা হলের গেটে ঢুকছে। বাবা ছেলেকে তার উদ্বেগের কথা জানালেন। বললেন শিগগিরই ফোন করতে।’’ -( কোয়ান্টাম টেক্সটবুক : পৃঃ ২৪১,
http://quantummethod.org.bd/book/hajaro-prosner-jobab-1/12896)
(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)-অন্তর্গুরু :
আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হতে হলে একজন আলোকিত গুরুর কাছে বায়াত বা দীক্ষা প্রয়োজন। এছাড়া আধ্যাত্মিকতার সাধনা এক পিচ্ছিল পথ।যে কোন সময়ই পা পিছলে পাহাড় থেকে একেবারে গিরিখাতে পড়ে যেতে পারেন। কমান্ড সেন্টার নির্মাণ করে সবকিছু ঠিক মত সাজানোর পর ধ্যানের বিশেষ স্তরে অন্তর্গুরুর আগমন ঘটে।
অন্তর্গুরু প্রথমে সকল অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য ‘সাইকিক বর্ম প্রদান করেন যা অতীতের সকল অশুভ প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং ভবিষ্যতের এ ধরণের প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখে। অন্তর্গুরুকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যত তীব্র হবে, তত সহজে আপনি তার দর্শন লাভ করবেন। এ ব্যাপারে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে কোয়ান্টাম গ্র্যাজুয়েটদের। -(কোয়ান্টাম টেক্সটবুক : পৃঃ ২৪৭,
http://quantummethod.org.bd/book/hajaro-prosner-jobab-1/12906)
- কমান্ড সেন্টার এবং অন্তর্গুরুর ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
ইসলামে কমাণ্ড সেন্টারের অবস্থান : আল-কুরআন এবং হাদীসে দিনের আলোর মত স্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে গায়েবের জ্ঞান বা অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহ পাকের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্য, এতে কারও কোন অংশীদারিত্ব নেই। গায়েবের জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে এমন সবকিছু যা মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা জানা যায় না। সেটা হতে পারে অতীতের ঘটনা, কিংবা ভবিষ্যতের ঘটনা কিংবা দূরত্বের কারণে মানুষের জ্ঞান থেকে অন্তরালে থাকা কিছু যেমন জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ পাক চাইলে তাঁর সৃষ্টির কোন অংশকে জানাতে পারেন, যেমন তিনি নবীর(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারফত আমাদেরকে জান্নাত জাহান্নামের বিবরণ জানিয়েছেন। তেমনি আল্লাহ পাক পৃথিবীতে মানুষের রিযিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত তথ্য ফেরেশতাগণের নিকট প্রকাশ করলে তাঁরা তা জানতে পারেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নবী-রাসূল কিংবা ফেরেশতারা গায়েব জানেন, বরং গায়েবের জ্ঞানের একাংশ আল্লাহ পাক তাদেরকে জানালে তবেই কেবল তারা তা জানতে পারে। আর তাই এটি ইসলামী আকীদার একটি অন্যতম মূলনীতি যে গায়েবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্য, এই বৈশিষ্ট্য কারও প্রতি আরোপ করলে তাকে আল্লাহর সমকক্ষ করা হয়।
ইসলামে অন্তর্গুরুর অবস্থান : ইসলামে অন্তর্গুরু নামক কোন পুরোহিততন্ত্র নেই - যা ইসলামের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কমাণ্ড সেন্টারের প্রয়োগ ও অন্তর্গুরুর অবস্থান দেখলেই আমরা বুঝব তা মানুষকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দাবী করছে যখন সে গায়েবের জ্ঞানের অধিকারী হয়। কোয়ান্টাম মেথডের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরও ভয়ংকর এই কারণে যে এখানে অন্তর্গুরু কল্যাণ বা অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখে, যা প্রকাশ্য শিরক হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই।
সাধু সন্ন্যাসী, ভাগ্যগণক, যাদুটোনা চর্চাকারীদের দ্বারা সংঘটিত নানা অলোকিক ঘটনা দেখে বহু মানুষ তাদেরকে আল্লাহর প্রিয় পাত্র ভাবা শুরু করে এবং তাদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার আতিশয্যে তারা যা বলে তাই করতে থাকে। পুরো ব্যাপারটিই ঘটে জ্বীনজগত সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার কারণে। একদল লোক যাদুটোনা, ভাগ্যগণনা জাতীয় বাতিল ও নিষিদ্ধ বিষয় চর্চার জন্য জ্বীনদের সাহায্য নেয়, তারা শয়তান জ্বীনদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য নানাপ্রকার শিরকী ও কুফরী কাজ করে, জ্বীনদের ইবাদত করে, ফলে শয়তান জ্বীনেরা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে এই সব চর্চায় সাহায্য করে।
এ প্রসংগে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ আর যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে সমবেত করবেন। সেদিন বলবেন, হে জিনের দল, মানুষের অনেককে তোমরা বিভ্রান্ত করেছিলে এবং মানুষদের মধ্য থেকে তাদের সঙ্গীরা বলবে, হে আমাদের রব, আমরা একে অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং আমরা পৌঁছে গিয়েছি সেই সময়ে, যা আপনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলবেন, আগুন তোমাদের ঠিকানা, তোমরা সেখানে স্থায়ী হবে। তবে আল্লাহ যা চান তা ব্যতীত। নিশ্চয় তোমার রব বিজ্ঞ, সর্বজ্ঞ।-(সূরা আল আনআম : ১২৮)
কোয়ান্টাম মেথড সকল ধর্মই সত্য এই মতবাদ প্রচার করে :
আসলে একজন খ্রিষ্টান যদি নিয়মিত কোয়ান্টায়ন করেন, মৌন সাধনা করেন তাহলে তিনি একজন ভালো খ্রিষ্টান হবেন, সন্তে রূপান্তরিত হবেন। একজন মুসলমান যদি নিয়মিত কোয়ান্টায়ন করেন তাহলে তিনি একজন ভালো মুসলমান হবেন, বুজুর্গে রূপান্তরিত হবেন। একজন হিন্দু যদি নিয়মিত কোয়ান্টায়ন করেন তাহলে তিনি একজন ভালো হিন্দু হবেন, ঋষিতে রূপান্তরিত হবেন। একজন বৌদ্ধ যদি নিয়মিত কোয়ান্টায়ন করেন তাহলে তিনি একজন ভালো বৌদ্ধ হবেন, ভিক্ষুতে রূপান্তরিত হবেন। অর্থাৎ কোয়ান্টায়ন বা মৌন সাধনা হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া বা অনুশীলন। যিনিই অনুশীলন করবেন তিনি এ থেকে সমানভাবে উপকৃত হবেন। অতএব আপনার ধর্ম বিশ্বাস যা-ই হোক, কোয়ান্টায়ন থেকে আপনি সমানভাবে উপকৃত হতে পারবেন। কোয়ান্টাম মেথড সকল ধর্মই সত্য এই মতবাদ প্রচার করে।
- এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী :
কোয়ান্টাম মেথড সকল ধর্মই সত্য এই মতবাদ প্রচার করে - আর যারা মুসলিম তারা কখনও সকল ধর্মকে সত্য মনে করেন না, বরং ইসলামকেই একমাত্র সত্য মনে করে। সকল ধর্ম সত্য-এ মতবাদ ইসলামের সাথে প্রকাশ্য দুশমনী, মারাত্মক গোমরাহী এবং প্রকাশ্য কুফরী।
এ প্রসংগে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র দ্বীন। যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও তারা কেবল বিদ্বেষের কারণে পরস্পর মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছিল। আর যে আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত দ্রুত হিসাবগ্রহণকারী। - (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৯)
তিনি আরও বলেন : ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অনুসরণ করলে তা কখনো কবূল করা হবে না বরং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ এমন জাতিকে কেন হিদায়াত দান করবেন, যারা ঈমান আনার পর ও রাসূলকে সত্য বলে স্যা দেয়ার পর এবং তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও কুফরি করে? (যারা এমন করে তারা যালিম) আর আল্লাহ তো যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দান করেন না। এমন লোকদের কাজের পরিণাম হল, নিশ্চিতভাবেই তাদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ এবং সকল মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হবে। তারা অনন্তকাল এ অভিশাপের মধ্যে থাকবে। তাদের উপর থেকে কখনোই শাস্তি হাল্কা করা হবে না এবং তাদেরকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে কোন বিরতিও দেয়া হবে না। অবশ্য এরপরও যারা তওবা করবে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে (তাদেরকে ক্ষমা করা হবে) কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা হলেন পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। ঈমান আনার পর যারা কুফরি করে এবং যাদের কুফরি করার প্রবণতা বাড়তেই থাকে, তাদের তওবা কখনোই কবূল করা হবে না। এরাই প্রকৃত পথভ্রষ্ট। -(সুরা আলে ইমরান : আয়াত ৮৫-৯০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদের আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়। প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত, আর প্রতিটি বিদআতই পথভ্রষ্টতা। - [মুসলিম ২/৫৯৩]
কোয়ান্টাম বা অন্য যে কোন পদ্ধতি যা একজন খৃষ্টানকে ভাল খৃষ্টান বানায়, একজন হিন্দুকে ভাল হিন্দু বানায়, একজন বৌদ্ধকে ভাল বৌদ্ধ বানায়- তা কখনও একজন মুসলিমকে ভাল মুসলিম বানাতে পারে না। কারণ, ভাল মুসলিম হওয়ার একমাত্র পথ হল ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া- যা কোন ইয়াহুদী, খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য কোন ধর্মালম্বীর জন্য প্রযোজ্য নয়।
তাছাড়া একজন খৃষ্টানকে ভাল খৃষ্টান, একজন হিন্দুকে ভাল হিন্দু, বা একজন বৌদ্ধকে ভাল বৌদ্ধ বানানোর জন্য মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়ায় নবী-রাসূল (আ) প্রেরণ করেন নাই। বরং ইসলাম এসেছে দুনিয়ার সব পথ-ভোলা মানুষকে কেবলমাত্র আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পনকারী একনিষ্ঠ মুসলিম বানানোর জন্য। আসুন! আমরা সবাই একনিষ্ঠ মুসলিম হই।
কোয়ান্টাম মেথডের নানা দিক: আসলে তা কিভাবে ঘটে?
কমাণ্ড সেন্টার, অন্তর্গুরু ইত্যাদী যে বিষয়গুলো কোয়ান্টাম মেথডের সাথে জড়িত, তার কথা তো অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আসলে কিভাবে এগুলো ঘটে সে ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে আমাদের জানতে হবে যাদু-টোনা, শয়তান ও জ্বীনদের সম্পর্কে। মেডিটেশনের ধাপগুলো আসলে যাদু-টোনা, শয়তান ও জ্বীনদের সাহায্য অর্জিত প্রক্রিয়া মাত্র। এই বিষয়ে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক পড়াশোনা থাকলেই আমরা কমাণ্ড সেন্টারে অপরিচিত মানুষদের ব্যাপারে কিভাবে পুংখানুপুঙ্খ বিবরণ দেয়া হয় তা বুঝতে পারব। যাকে অন্তর্গুরু হিসেবে চাওয়া হচ্ছে তাকে কিভাবে দেখা যাবে তাও বোঝা যাবে। সবক্ষেত্রে আসলে অন্তর্গুরু হচ্ছে জ্বীন ও শয়তান! আর তথাকথিত সাইন্টিফিক মেথড বা Science of Living যে আসলে শয়তানের পুজারী, পারসিক, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের যোগী, সন্যাসী ও ধর্মগুরুদের ধ্যান ও সাধনার একটি মিশ্রিত নির্যাষ ছাড়া আর কিছুই নয়- এ বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। কেন এটি পরিত্যাজ্য সে ব্যাপারে বোধহয় দলিল-প্রমানের আর কোন প্রয়োজন নেই।
আমাদের করণীয় :
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : আপনার আগে আমি ওহীসহ মানুষই প্রেরণ করেছিলাম। তোমরা যদি না জান তাহলে আহলুজ্জিকির(জ্ঞানী) গণকে জিজ্ঞাসা কর -(সূরা আম্বিয়া : ৭)। তিনি আরও বলেন : বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে - [সূরা ফাতির : ২৮]। তিনি আরও বলেন : হে ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল এবং (তাকওয়া অর্জনের জন্য) সিদ্দিকীনগণের সংগী হও। (সূরা তওবা : ১১৯) তিনি আরও বলেন : হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমন ভয় তাঁকে করা উচিত এবং প্রকৃত মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না। -(সূরা আলে ইমরান : ১০২)
সবধান! কোয়ান্টাম, মেডিটেশন, ধ্যান ইত্যাদি বিভিন্ন নামে প্রচারিত তথাকথিত মনের ব্যায়াম নামক ঈমান বিধ্বংসী কর্মতৎপরতা থেকে আমাদের ঈমান ও আমলকে অবশ্যই হিফাজত করতে হবে। ইসলামী লেবাসে বৌদ্ধ, যোগী, সন্যাসী ও অগ্নিপুজারী সাধকদের সাধনার মিশ্র পন্থা কোয়ান্টাম নামে মুসলিম মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে- এব্যাপারে মুসলিম উম্মাহকে সজাগ ও সচেতন করতে হবে। আর সময় থাকতে মুসলিম উম্মাহকে অবশ্যই আল্লাহওয়ালা গণের সোহবতে কুরআন ও সুন্নাহ-এর শিক্ষা ও চর্চায় আত্ম নিয়োগ করে শিরক, কুফর, নিফাক, তাগুত, বিদআত ও জাহিলিয়াতমুক্ত খাটি ঈমান ও আমল নিয়ে প্রকৃত মুসলিম হিসাবে মৃত্যু বরণ করার আজীবন সাধনা করতে হবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : বানী-ইসরাইলীগণ বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মাত বিভক্ত হবে তিয়াত্তর দলে, সকলেই জাহান্নামে যাবে কিন্তু একটি মাত্র দল জান্নাতে যাবে। সাহাবাগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন- এই দল কারা? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : যারা আমার ও আমার সাহাবাগণের আদর্শের উপর কায়েম থাকবে (তিরমিজি-২৫৭৮ : হাসান, আবু দাউদ, সহীহ তারগীব-৪৮)।
আল্লাহ আমাদেরকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করুন! তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন! সকল কলুষতা দুর করে আমাদের জীবন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রা)-গনের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত কল্যাণময় জীবন হিসাবে গড়ে তোলার তৌফিক দান করুন! এবং তাঁদের মহান জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
২৬ জুন ’১৬ বিকাল ০৪:২১
যা কিছু ভালো তাকে ভালো হিসেবে গ্রহণ করতেও হাজার প্রশ্ন। এত জায়েজ-না জায়েজ না ভেবে নিজের বিবেক খাটালেই তো হয়ে যায়!
২৬ জুন ’১৬ সন্ধ্যা ০৬:২০
সাধক:
কোয়ান্টাম মেথড নিয়েও ফতোয়া জারি করে বসলেন? তো মশাই কিসে আপনাদের চুলকানী থাকবে বলুন তো !
২৭ জুন ’১৬ সকাল ১০:১৬
শিথিলায়নের সাথে ইসলামের কোন সংঘর্ষ দেখিনা বরং ভালো একটি পন্থা নিজেকে স্থির করার জন্য। আল্লাহ বলেছেন,আমি নিশ্চয় ধৈরযোশীলদের থাকি। সো মেডিটেশন খারাপ বলে আমি মনে করিনা