আ.লীগ-জাসদ দ্বন্দের আধুনিক স্বরুপ
(আওয়ামী-জাসদ জোটের মাঝে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতারা জাসদের বিরোধীতায় সরব হয়েছেন গত বছর থেকে। নতুন করে এ বছর আবারও বিতর্ক ডানা মেলেছে। এর কারন কী? আওয়ামী-জাসদ বিরোধীতার ক্ষেত্র ঠিক কতটা শক্তিশালী? লেখাটিতে ইতিহাস বিশ্লেষণ ও চলমান আওয়ামী-জাসদ দ্বন্দের স্বরুপ তুলে আনার চেষ্টা করেছি।)
স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদ বনাম আওয়ামীলীগ দ্বন্দ? ওরে বাবা! এক কথায় বলা যায় সাপে-নেউলে সম্পর্ক!! একজন সাপ হলে অন্যজন্য ঠিক নেউলে! কেউ কাউরে না ছাড়ে সমানে সমান। একেবারে গোড়ায় গেলে পাওয়া যাবে দুই তাত্ত্বিক পুরুষের দুই মেরু। একই দল থেকে দুই বিপরীত আদর্শ প্রতীষ্ঠার দুই বিপুল সংগ্রাম। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ যেমন আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে তার ডান অঙ্গনকে লঘু করেছিলো ঠিক একই ভাবে আদর্শিক দিক থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে সিরাজপন্থীরা আওয়ামীলীগের ডান অঙ্গনকে আরো লঘু করতে চেয়েছিলো। এই অঙ্গনের প্রবাদ পুরুষ সিরাজুল আলম খান। অন্যদিকে রয়েছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে আওয়ামীলীগের মুসলিমলীগ পরবর্তী লঘু ডান ধারার বিপরীতে সিরাজুল আলমপন্থীরা নিজেদেরকে আওয়ামীলীগের বামধারা বলে পরিচিত করলেন। আর এই অবস্থা বিরাজ করেছিলো স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদ গঠনের আগ পর্যন্ত। জাসদপন্থী বামধারা ও ডানপন্থী ধারার বিরোধ ছিলো স্পষ্ট। যদিও রাজনৈতিক অভিন্ন ইস্যুতে তারা একসাথে নীতি নির্ধারনী সভায় বসতেন। একই সাথে কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতেন।
তাত্বিক দ্বন্দের পরও সিরাজুল আলম খান ও বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক বন্ধুত্ব ছিলো প্রচন্ড গভীর। তারা ছিলেন সাহায্যকারী ও নৈতিক বন্ধরে সুদৃঢ়। তবুও তাদের আদর্শিক ভাবনা ছিলো শত্রুতা ও ধ্বংসাত্বক। শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা, তাকে অনন্য নেতৃত্বের আসনে নিয়ে যাওয়ার মূল কৃতিত্ব সিরাজুল আলম খানের। তদুপরি জাসদ গঠনের পর থেকে সিরাজুল আলম পন্থীরা বঙ্গবন্ধু শব্দ আর উচ্চারন করতেন না। তখন থেকে শেখ মুজিব বলা শুরু করেছিলেন। এটি হল জাসদের তাত্বিক গুরু কর্তৃক প্রদানকৃত উপাধি পুনরায় ছিনিয়ে নেয়ার জিঘাংসা মাত্র।
ষাটের দশক থেকেই জাসদপন্থীরা ছাত্রলীগে ছিলেন একক প্রভাবশালী। তখন ছাত্রলীগের কমিটি গুলোতে জাসদপন্থীদের পরচয় ছিলো 'নিউক্লিয়াস' হিসেবে। অর্থাৎ এই গ্রুপের নেতারাই ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগকে সমাজতন্ত্রে পরিনত করবে, তার পরিস্কার ইঙ্গিত ছিলো। সে সময় তারা ছাত্রলীগকে এমন ভাবে দখল করে নিয়েছিলো যে, প্রতিটি কমিটিতে প্রভাবশালী অংশ অবশ্যই নিউক্লিয়াস গ্রুপ থেকে হতে হত। আর সিরাজুল আলম খানের সাথে এই ধারার সঙ্গী হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আপন ভাগ্নে শেখ মনি! এভাবেই আওয়ামীলীগে বাম ধারাটি বেড়ে উঠেছিলো।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসার পর প্রায় তিন মাস কাল ব্যাপী সিরাজুল আলম খান বাস্তব রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবকে সমাজতন্ত্রের যুক্তি ও শক্তিমত্তা দিয়ে বুঝাতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এরপর যখন বঙ্গবন্ধুর দিক থেকে এ ব্যাপারে অনীহা দেখা যেতে লাগল, তার কিছু সময় পর ঢাকায় ভিন্ন দুই গ্রুপের আহ্বানে ঢাকার দুটি স্থানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় মিটিং আহ্বান করা হয়েছিলো। আর দুই স্থানেই প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু সিরাজুল আলম খান হলেন ব্যার্থ। বঙ্গবন্ধু সিরাজুলের ডাকে সাড়া না দিয়ে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের মিটিং এ যুক্ত হলেন। আর এর পরবর্তীতে শেখ মনিও বঙ্গবন্ধুর সাথেই যুক্ত হয়েছিলেন। এমন একটি পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে জাসদ গঠনের ঘোষণা দিলো সিরাজুল পন্থী 'নিউক্লিয়াস' গ্রুপ। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রতীষ্ঠার নামে আওয়ামীলীগের সাথে প্রথম প্রকাশ্য বিরোধ ঘোষণা হল এর মাধ্যমে।
ইতিহাস আওয়ামীলীগ ও জাসদের মাঝে কাকে নায়ক ও কাকে ভিলেনের স্থানে বসাবে, তা নির্ভর করছে এক প্রেক্ষাগৃহ থেকে জন্ম নেয়া দুই আদর্শের একটির পরিপূর্ণ রাজনৈতিক বিজয়ের ওপর। ফলে উদারপন্থী আওয়ামীলীগ ও বামপন্থী জাসদের আদর্শিক লড়াই মোটেও স্বাভাবিক রাজনৈতিক বিষয় হয়ে যায়নি। ইতিহাস নির্ভর আদর্শ চর্চা থেকে দল দুটি কখনই আলাদা হতে পারেনি, পারবেও না। এর মাঝে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বীষফোড়াটি খোদ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে। একই দেশের ক্ষমতাশালীদের ভেতর একদিকে শোক ও অন্যদিকে গর্বের দিবস পালন। একদিকে শোক দিবস ও অন্যদিকে সিপাহী জনতার বিপ্লব বঙ্গবন্ধুর হত্যাকেই কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। আর এই বিষফোড়া এবং আদর্শিক বিজয়ের মাধ্যমে ইতিহাসের নায়ক-ভিলেন নির্ধারনী রাজনীতিতে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। ঠিক এই পয়েন্টেই বাংলাদেশের জনগণকে সাথে নিয়ে ইতিহাসে একবার যেমন রক্ষিবাহিনী সহ সরকারী নির্মমতাকে পুজি করে জনতার জাসদ হয়ে উঠেছিলো। ঠিক তেমনই ভাবে বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামীলী বিরোধী অবস্থানে গিয়ে জাসদের পক্ষে জনতার জাসদ হবার পথে প্রধান আদর্শিক শত্রু হিসেবে খেলার মাঠে এসে পড়েছে ইসলামপন্থী গ্রুপ হেফাজতে ইসলাম ও তার সহযোগীরা। ফলে একদিকে জাসদের পুরাতন বিরোধীতা কারীরা যেমন জোর পাচ্ছেন ঠিক তেমনই জাসদপন্থীরা তাদের রাজনৈতিক উত্তরনের পথে হতাসায় পর্যবসিত হচ্ছেন। আর এই হতাসার কার্যকর কারনটি হল সাম্প্রতিক নাস্তিক ও ব্লগার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর ডানপাশে অবস্থান।
আর সেই অবস্থানের কারনেই, নতুন করে ধীরে ধীরে আওয়ামী সরকারের অভ্যন্তরে প্রভাবশালী হতে থাকা জাসদের পক্ষ ও বিপক্ষ অংশও যার যার অবস্থানকে পরিস্কার করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ফলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় মিটিং এ উপস্থিত হয়ে সৈয়দ আশরাফ সম্প্রতি আবারও হুঁশিয়ারি উচ্চারন করছেন। জাসদকে আওয়ামীলীগের শত্রু আখ্যা দিয়ে তিনি জাসদের মন্ত্রী বানানোয় আওয়ামীলীগকে 'প্রায়শ্চিত্য' করতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেন। আশরাফের এই বক্তব্যের স্থানটিই তাৎপর্যপূর্ন। স্বাধীনতা পরবর্তী 'জাসদমুক্ত' আওয়ামী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় মিটিং স্মরন করিয়ে দেয়া। অর্থাৎ ছাত্রলীগের সেই সাবেক নিউক্লিয়াস শক্তির বিরুদ্ধেই আশরাফের এই হুঁশিয়ারী অবস্থান! এদিকে বর্তমানে বিরোধী দলে থাকা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা কাজী ফিরোজ রশিদও সংসদে জাসদ নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি জাসদকে ২০ লাখ লোককে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে মন্ত্রী সভায় জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুর অবস্থানকেই ট্রিট করেন। একই সাথে নিউক্লিয়াস অংশের বিপরীতে ছাত্রলীগে তাদের অতীত অবস্থানের দিকেও ইঙ্গিত করেন ফিরোজ রশীদ।
একথা স্পষ্ট যে, আওয়ামীলীগ ও জাসদের শক্তিশালী নির্বাচনী জোট গঠনের মাধ্যমেই উপর্যুপরি দ্বিয়ীতবারের মত ক্ষমতা দখল করেছে আওয়ামী জোট। আর এই দুটি দলের অতীত কালিমা মুছার প্রয়াসে দল দুটির ঐক্য শক্ত করার দিকে নানা ভাবে মনযোগ দেয়া হয়েছে। তদুপরি কঠিন বাস্তবতা হল, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ভেঙ্গে যাওয়া দুই মেরুর আদর্শবাহী দল দুটি পুনরায় একত্রিত না হয়ে নিছক রাজনৈতিক জোটের মাঝেই সীমাবদ্ধ আছে। কঠিন বাস্তবতা- এরা এদের দলীয় বিজয়ের জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। যার পরিনতি ভবিষ্যতে একটি দলকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের নায়ক ও অন্যদলকে ভিলেনে পরিনত করে দিতে পারে। ফলে আওয়ামীলীগ ও জাসদের চিরোচারিত দ্বন্দ মৌলিক। আর সেটা দুই দল বর্তমান থাকাকালীন কখনই নিঃশেষ হয়ে যাবেনা। এই আলাদা দলীয় পথ চলার মাঝেই পরস্পররের হন্তারক হবার ছায়া লুকিয়ে আছে। হেফাজত উত্তর পরিবর্তিত বাংলাদেশী পরিবেশে সেই ছায়াটিই নিজের পরিবর্তিত আসন তৈরি করে নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৫ টি
১৬ জুন ’১৬ বিকাল ০৩:১২
যেমন বলুন না কেন। সত্য কথা হল এসবই প্রগতীশীল বনাম সাম্প্রদায়িকতার লড়াই। ক্ষমতার লোভে কেউ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে মাথানত করে আর কেউ করেনা। ইতিহাস চিরোদিন বীরের সাথেই থাকে। কাগজে লেখা ইতিহাস নয়।
১৬ জুন ’১৬ বিকাল ০৩:২৭
মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদ-আওয়ামীলীগ দ্বন্দ্ব না হলে দেশের চিত্র অবশ্যই আরো উন্নত ও প্রগতীপক্ষ থাকতো।