ভালোবাসার মতবাদ
কোন মত যখন বহুমানুষের জীবন চর্চার মূলনীতি হয়ে ওঠে, তখন সেই মত থেকে মতবাদে পরিনত হয়। এভাবেই বহু মনামনিষী তাদের সামাজিক সমস্যার সমাধান করেছেন। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে গিয়ে রাজনৈতিক মতবাদের জন্ম দিয়েছেন। অর্থনৈতিক সমস্যার বিপরীতে প্রদিপ জ্বালিয়েছেন। তাদের সাধারন মানবতা চেতনা গুলই অসাধারন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মত থেকে মরবাদ হয়েছে। তারা হয়েছেন স্মরণীয় মানুষ।
কিন্তু সত্যি বলতে কি, এইসব মানুষেরা স্মরণীয় হতে চাননি। তাদের একান্ত চাওয়া ছিলো ভুলে যাওয়া মানুষগুলোকে যেন মানুষেরা স্মরণ করে। তাদের কথাগুলো মনে রাখে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি যাদের শোষণ করে তাদের পুজো করেই তারা মহান হয়েছেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার ঠিক এখানেই। এইসব মহামানুষ যা চাননি ঠিক তা-ই হয়েছে এদেরকে ঘিরে! এই মানুষ গুলো মহামানুষ হতে চাননি। তাদেরকে মহামানুষ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফল স্বরুপ, এই সাধারন মানুষগুলোর সাধারন সমাধান গুলোও মানুষের মন থেকে হারিয়ে গেছে। সেখানে এসে বসেছে মহামানুষের পুজা।
চিন্তা করুন তো! একজন সাধারন মানুষ রাস্তার অসহায় মানুষের মুক্তি দেয়ার জন্য সহজ আর মানবিক সমাধান আবিস্কার করলেন। তার ফলে সে সময় ঐ সমাজের রাস্তার মানুষ গুলো তার আলোকিত ভাবনার বদৌলতে হাসি খুজে পেল। এর ঠিক এক শতাব্দি পর সেই সমাজের সেই রাস্তা গুলোতে ঐ সাধারন মানুষটির শিক্ষা ভুলে যাওয়া হল। রাস্তা জুড়ে ঐ সাধারন মানুষকে অসাধারন আখ্যা দিয়ে ঐ মানুষের দেবতাদের ধাক্কা দিয়ে মিছিল বের হল! মানুষের স্থানে মহামানুষ শব্দ যোগ করে ঐ মানুষের সাধনাকে ঐ রাস্তাতেই পিষে চলে গেল ঐ মানুষের ভক্ত নামধারিরা। রাতভর উৎসবের কারনে রাস্তায় ঘুমানোর যায়গা হারালো অসহায় মানুষ গুলো!
মাঝে মাঝে পৃথিবীর এই চক্রাকার বিবর্তন আমাকে ক্লান্ত করে। মাঝে মাঝে শুধু হাসি। মানুষ সত্যিই একেকটা ফানুশ। দম আছে বলে কত কিছু মাড়িয়ে উঠে যায়! আবার যারা দম নিয়ে অসহায়ের পুজো দেয় কালক্রমে তারাও পরোক্ষভাবে মৃত্যুর পর মানুষকেই মাড়াতে থাকে।
অতিসাধারন চিন্তা থেকেই মতবাদের জন্ম হয়। সাধারন কাজকর্ম ভুলে যাওয়া মানুষই সেসব মতামতকে অসাধারন মনে করে। অসাধারন বলে প্রচার করে। যার কারনে মহাত্মা গান্ধী, যিশু, মুহাম্মাদ সহ সকল মানুষের হাতে গড়া সাধারন সব কাজের ধারা পরের মানুষজন অসাধারন আর কঠিন মনে করে।
অনেকটা এমন- সাধারন কাজ করতে করতে সাধারন মানুষ অসাধারন হয়ে যায়। আবার অসাধারন হবার কারনেই তাদের নাম করে সাধারন কাজগুলোকে মাড়িয়ে দেয়া হয়।
অথবা এমন- সাধারন মানুষগুলো দূর্বলের পুজো করে করে 'অসাধারন' হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ঐ অসাধারন মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু কৃত্রিম ডিমান্ড পূরণ করতে গিয়ে সাধারন কাজগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
কিংবা এমন- সমাজের অন্ধগলির মানুষ আর মহামানব নামের অতিসাধারন মানুষের মাঝে পার্থক্য শুধুই সময়ের। প্রথম জনেরা নিজ সময়ে প্রত্যক্ষ থেকে অসহায়ের ক্ষতি করে। আর দ্বিতীয়জনেরা পরবর্তি সময়ে পরোক্ষ অবস্থায় ক্ষতি করেন।
পরোক্ষ একারনে যে, এই মানুষ গুলো সাধারন থাকতে চাইলেও তাদের উগ্র সমর্থক গোষ্ঠী এদেরকে অসাধারন বানিয়ে এদের নামেই অসহায়ের ক্ষতি করে। যদিও এই ক্ষতির ভার তাদের নয়। কারন এই মানুষ গুলো যে কাজ করতে বলে যাননা, ঠিক সেই কাজগুলই এদের প্রতি ভালোবাসার নামে করা হয়।
কেউ যদি সত্যিই মতবাদকে ভালোবাসে। সত্যিই যদি মত প্রবর্তকদের ভালোবাসে, তাহলে তাকে একজন মানুষের বন্দনা করলে হবেনা। বরং ঐ মানুষটার মত বহু মানুষের বন্দনা করতে হবে। বন্দনা করতে হবে একেবারেই সাধারন মানুষের।
নচেৎ বুঝতে হবে, সে ভালোবাসার মতবাদ লালন করছেনা। বরং ভালোবাসাহীন নিরস মতবাদকে লালন করে একটা অভিনয় করে চলেছে।
আসুন, আমরা সবাই নিজ নিজ মতবাদের মাঝে ভালোবাসা গুলোকে জীবন্ত করে তুলি। তাহলে দেখব- যা যিশু, তাই গান্ধী, যা গান্ধী তাই লেনিন, যা লেনিন তাই মুহাম্মাদ...
মানুষের সেবা করাই মতবাদ। এটাই ভালোবাসা। এর বাইরে বাকী সব কার্যক্রমই শ্রেফ ভন্ডামো। মহামানবের পুজো নয় অনুসরন করা চাই। মহামানব মারা গেলেও মানুষ আজও জীবিত আছে। তাই মহামানবের একমাত্র প্রাসঙ্গিকতাই হল মানুষের সেবা।
এখন এই সেবা যারা দিচ্ছে তারাই সকল মতবাদের কর্মী। সেটা নামে হোক কিংবা বেনামে। মতবাদের দাবি করে হোক কিংবা ভিন্ন কোন পন্থায়। এরা কেউই মহামানব নয়, সবাই মানব। কিন্তু অসহায় মানুষ এদের সবাইকে মহামানবের মতই শ্রদ্ধা করে। নিরবেই শ্রদ্ধা আসে।
মতবাদের চেয়ে তাই সাধারন মত লালন ও প্রতিষ্ঠাই মানবতা ধর্ম।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৫ টি