এই ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ গুণটি আমরা অনেকেই এখনও অর্জন করতে পারিনি।
তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। সেবা প্রকাশনীর মাসুদ রানা সিরিজের দারুণ ভক্ত আমি। আমার এক কাছের বন্ধুর আব্বুর কালেকশনে রানা সিরিজের তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো উপন্যাসই ছিল। সে সংখ্যাটা কমপক্ষে দুই শ’ তো হবেই। আমরা দু বন্ধু মিলে তখন ক্লাসের পড়া ফাঁকি দিয়ে মাসুদ রানার সাথে কাল্পনিক রোমাঞ্চকর সব অভিযানে বেরিয়ে পড়তাম। কখনও ফাইটার প্লেন চালিয়ে শত্রুদের ঘাঁটিকে গুড়িয়ে দিতাম, কখনো বা জাহাজে করে ভেসে বেড়াতাম দূর সমুদ্রে। মাসুদ রানা কখনও আমাদের নিয়ে যেত আফ্রিকার জঙ্গলে, কখনওবা বরফে ঢাকা সাইবেরিয়ায়। গুপ্তধনের সন্ধানে মাসুদ রানার সাথে আমিও দিনের পর দিন দুর্গম পাহাড় চষে বেড়াতাম। এফবিআই, সিআইএ, কেজিবির মত দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংগঠনগুলোর সাথে তখন থেকেই আমার পরিচয়। মাসুদ রানা তখন আমার জীবনের হিরো। রোমাঞ্চ আর এডভেঞ্চারের এক মায়াজগতে মাসুদ রানা আমাকে সম্মোহিত করে রাখত।
মাসুদ রানা সিরিজের সব বই যে ভাল লাগত এমন নয়। কোন কোন বই ছিল আমার দৃষ্টিতে বি গ্রেডের, কোনটা ছিল হয়তো এ গ্রেডের, আবার কোন কোনটাকে আমি দিতাম এ প্লাস। এ প্লাস বইগুলো আমি কমপক্ষে দুবার করে পড়তাম। এমনও হযেছে একেকটা বই পাঁচবার/ছয়বার পর্যন্ত পড়েছি। তো এমনই একটি এ প্লাস বই নিয়ে এই ঘটনা। আজ আর সেই বইয়ের নাম আমার মনে নেই। আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন আমার চাচাতো বোনের স্বামী মানে আমার দুলাভাই। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। একদিন তিনি আমাকে বললেন তুই কি সব ছাইপাশ পড়িশ, দে তো আমাকে পড়ে দেখি। আমি মহা উৎসাহে মাসুদ রানার এ প্লাস একটি উপন্যাস তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘এই বইটা একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত উঠতে পারবেন না।’ আমি তাকে বইটা দিয়ে স্কুলে গেলাম। স্কুল থেকে ফিরে এসে তাকে জিজ্ঞেশ করলাম, ‘কেমন লাগলো বইটা?’ তার জবাব শুনে থ হয়ে গেলাম। দুলাভাই বললেন, ‘বইটা আমার একটুও ভাল লাগেনি। পুরো বইটা আমি পড়িও নি। দশ/বার পৃষ্ঠা পড়ে জাম্প করে বইয়ের মাঝখানে চলে গেছি। আবার দশ বার পৃষ্ঠা পড়ে বইটার শেষের কয়েক পৃষ্ঠা পড়েছি। কী আছে এই সব বইয়ে? কী হয় এগুলো পড়ে?’ তার এই জবাবে আমি যতটা না অবাক হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মুখেমুখি হয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এই বই যে-ই পড়া শুরু করবে, শেষ না করে উঠতে পারবে না। এডভেঞ্চার আর রোমাঞ্চে ভরপুর এই বই পাঠকের ভাল লাগবে না, এটা হতেই পারে না। আমার সেই দুলাভাই সেদিন আমার ধারণা আর বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছিলেন।
আমার ক্লাস নাইনের এই ছোট্ট ঘটনাটাকে আমি অনেকদিন ভুলতে পারিনি। সত্যি বলতে কী, আজও ভুলতে পারিনি। যে বইটা আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে, সে বইটা যে অন্য একজনের কাছে ভাল নাও লাগতে পারে এই সত্যি ব্যাপারটা আমি কোন মতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। সেদিনের সেই ঘটনা আমার ছোট মনে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল। সেদিনই প্রথম আমি এই কঠিন সত্যকে হজম করেছিলাম যে, আমার পছন্দ আর রুচির সাথে অন্যদের পছন্দ আর রুচির অমিল থাকাটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সেদিনই আমি প্রথম শিখি যে, আমার কাছে যেটাকে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়, অন্যের কাছে সেটাকে যুক্তিযুক্ত নাও মনে হতে পারে। কোন বিষয়কে আমি যেভাবে দেখি অন্যরা সেটাকে সেভাবে নাও দেখতে পারে। কোন একটি বিষয়কে আমি হয়তো একরকমভাবে বিবেচনা করি, অন্যরা হয়তো বিচার করে অন্যরকমভাবে। এই স্বাভাবিক বিষয়টাকে মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হয়।
অন্যের বিশ্বাস, মতামত আর বিবেচনাবোধের সাথে আমার বিশ্বাস, মতামত আর বিবেচনাবোধের ভিন্নতা থাকবে এটাই চরম সত্য কথা। তাই শুধুমাত্র বিশ্বাস আর মতামতজনিত ভিন্নতার কারণে কাউকে ভাল বা মন্দ আখ্যা দেয়াটা মানসিক দৈন্যতার পরিচায়ক। আমি হয়তো সেকুলারিজমে বিশ্বাস করি না। তাই বলে সেকুলারিজমের অনুসারীদের সবাইকে যদি আমি খারাপ আখ্যা দেই তাহলে এর চেয়ে মূর্খতা আর কী হতে পারে? আমার দৃষ্টিতে হয়তো কমিউনিজম একটি বাজে মতবাদ। কিন্তু অন্যের দৃষ্টিতে এটিই হয়তো পৃথিবীর তাবৎ সমস্যার একমাত্র সমাধান। তাই শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে আমি যদি কমিউনিজমের অনুসারীদেরকে খারাপ লোক বলে মনে করি, তাহলে তা চরম অন্যায় হবে। দুঃখের বিষয় হলো, অন্যের বিশ্বাস আর মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মত এই ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ গুণটি আমরা অনেকেই এখনও অর্জন করতে পারিনি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৪ টি
২৩ ফেব্রুয়ারি ’১৬ বিকাল ০৫:১৭
সাধক:
ভাল একটা লেসন পেলাম। আমারো এমন মনে হয়। আসলেই একই জিনিসের পছন্দ ভিন্ন হতে পারে
।