৭৬ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সাহিত্য সম্রাট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধা

সাহিত্য সম্রাট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি আসুন জেনে নিই অপরাজেয় কথাশিল্পীর জীবনী
জন্ম ও পরিবার
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা্র নাম ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামক তাঁর দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামক তাঁর এক বোন ছিল। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে নিয়ে ভাগলপুরেশ্বশুরবাড়ীতে থাকতেন বলে শরৎচন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিল।
শিক্ষাজীবন
শরৎচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সকালে মতিলাল তাঁকে দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন, যেখানে তিনি দুই তিন বছর শিক্ষালাভ করেন। এরপর ভাগলপুর শহরে থাকাকালীন তাঁর মামা তাঁকে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্র ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে মতিলালের ডিহিরির চাকরি চলে গেলে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে দেবানন্দপুরে ফিরে গেলে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুলে ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সময় তিনি হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে দারিদ্র্যের কারণে স্কুলের ফি দিতে না পারার কারণে তাঁকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এই সময় তিনি কাশীনাথ ও ব্রহ্মদৈত্য নামক দুইটি গল্প লেখেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল পুনরায় ভাগলপুর ফিরে গেলে প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষালাভের প্রতি শরৎচন্দ্রের আগ্রহ লক্ষ্য করে তাঁকে তাঁর বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলী কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তাঁর মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে প্রতি রাত্রে পড়াতেন, তার বিনিময়ে অঘোরনাথ তাঁর কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেন। এতদ্সত্ত্বেও এফ.এ. পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পারার জন্য তিনি পরীক্ষায় বসতে
ভাগ্যান্বেষণ
কলেজ ত্যাগ করার পর শরৎচন্দ্র ভাগলপুর শহরের আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলা ও অভিনয় করে সময় অতিবাহিত করতে শুরু করেন। এই সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে একটি সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে তিনি বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা ইত্যাদি উপন্যাস এবং অনুপমার প্রেম,আলো ও ছায়া, বোঝা, হরিচরণ ইত্যাদি গল্প রচনা করেন। এই সময় তিনি বনেলী রাজ-এস্টেটে তিনি কয়েকদিন চাকরি করেন কিন্তু পিতার ওপর কোন কারণে অভিমানবশতঃ তিনি সন্ন্যাসী সেজে ঘর ছেড়ে চলে যান। এই সময় তাঁর পিতার মৃত্যু হলে তিনি ভাগলপুর ফিরে এসে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে কলকাতা যাত্রা করেন, যেখানে তিনি কলকাতা উচ্চ আদালতের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে হিন্দি বইয়ের ইংরেজি তর্জমা করার জন্য মাসে ত্রিশ টাকা মাইনের চাকরি পান। এই সময়, তিনি মন্দির নামক একটি গল্প লিখে কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠালে তা বিজয়ী ঘোষিত হয়।
ছয় মাস লালমোহনের বাড়িতে কাটানোর পর শরৎচন্দ্র ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রেঙ্গুনে লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভগ্নিপতী উকিল অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে চলে যান। অঘোরনাথ তাঁকে বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে একটি অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। দুই বছর পর তাঁর চাকরি চলে গেলে তিনি তার বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগু চলে যান ও সেখানে অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসবাস করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রনাথ মিত্রের সাহায্যে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে এই অফিসে চাকরি পান ও পরবর্তী দশ বছর এই চাকরি করেন।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে এলে যমুনা নামক পত্রিকার সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ পাল তাঁকে পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন। সেই অনুযায়ী, শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে ফিরে গিয়ে রামের সুমতি গল্পটি পাঠিয়ে দেন, যা যমুনা পত্রিকায় ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার জন্যেও লেখা পাঠাতে শুরু করেন। ফনীন্দ্রনাথ পাল তাঁর উপন্যাস বড়দিদি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স ও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স তাঁর উপন্যাসগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন।
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছুটি নিয়ে মনোমালিন্যের কারণে শরৎচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রেঙ্গুন ছেড়ে বাংলায় ফিরে আসেন।
বৈবাহিক জীবন
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রীদের পল্লীতে বসবাস করতেন। তাঁর বাসার নীচে শান্তি দেবী নাম্নী এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রীর কন্যা বসবাস করতেন। তাঁর পিতা তাঁর সাথে এক মদ্যপের বিবাহ স্থর করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করলে শরৎচন্দ্র তাঁকে বিবাহ করতে বাধ্য হন। তাঁদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়, কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তাঁর এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরন করেন। এর অনেক কাল পরে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনেকৃষ্ণদাস অধিকারী নামক এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তাঁর ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন।
শেষ জীবন
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্র প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি স্বাস্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেওঘরে তিন চার মাস কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তাঁর যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা তাঁর পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রভৃতি চিকিৎসক তাঁর অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪নং ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দেহে অস্ত্রোপচয়ার করেন, কিন্ত্য চার দিন পরে সকাল দশটায় শরৎচন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রকাশিত বই
উপন্যাস
• বড়দিদি, ১৯১৩
• বিরাজবৌ, ১৯১৪
• পন্ডিতমশাই, ১৯১৪
• পল্লী-সমাজ, ১৯১৬
• চন্দ্রনাথ, ১৯১৬
• শ্রীকান্ত-প্রথম পর্ব, ১৯১৭
• দেবদাস, ১৯১৭
• চরিত্রহীন, ১৯১৭
• দত্তা, ১৯১৮
• শ্রীকান্ত-দ্বিতীয় পর্ব, ১৯১৮
• গৃহদাহ, ১৯২০
• বামুনের মেয়ে, ১৯২০
• দেনা পাওনা, ১৯২৩
• নব-বিধান, ১৯২৪
• পথের দাবী, ১৯২৬
• শ্রীকান্ত-তৃতীয় পর্ব, ১৯২৭
• শেষ প্রশ্ন, ১৯৩১
• শ্রীকান্ত-চতুর্থ পর্ব, ১৯৩৩
• বিপ্রদাস, ১৯৩৫
• শুভদা, ১৯৩৮
নাটক
• ষোড়শী, ১৯২৮
• রমা, ১৯২৮
• বিরাজ বৌ, ১৯৩৪
• বিজয়া, ১৯৩৫
গল্প
• রামের সুমতি ১৯১৪
• পরিণীতা, ১৯১৪
• বিন্দুর ছেলে, ১৯১৪
• পথ-নির্দেশ, ১৯১৪
• মেজদিদি, ১৯১৫
• আধাঁরে আলো ১৯১৫
• দর্পচূর্ণ ১৯১৫
• বৈকুণ্ঠের উইল, ১৯১৬
• অরক্ষণীয়া, ১৯১৬
• নিষ্কৃতি, ১৯১৭
• কাশীনাথ, ১৯১৭
• স্বামী, ১৯১৭
• ছবি, ১৯২০
• বিলাসী, ১৯২০
• মামলার ফল, ১৯২০
• হরিলক্ষী, ১৯২৬
• মহেশ, ১৯২৬
• অভাগীর স্বর্গ, ১৯২৬
• অনুরাধা, ১৯৩৪
• সতী, ১৯৩৪
• পরেশ, ১৯৩৪
প্রবন্ধ
• নারীর মূল্য
• তরুণের বিদ্রোহ, ১৯১৯
• স্বদেশ ও সাহিত্য, ১৯৩২
• স্বরাজ সাধনায় নারী
• শিক্ষার বিরোধ
• স্মৃতিকথা
• অভিনন্দন
• ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য
• গুরু-শিষ্য সংবাদ
• সাহিত্য ও নীতি
• সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি
• ভারতীয় উচ্চ সঙ্গীত
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৬ টি