মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা,কারো দানে পাওয়া নয়।সত্যিই তাই,৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের সোনার বাংলা।নয় মাসের ক্লান্তিহীন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে স্বাদীনতা।যে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তারই নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পরেছিল ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিকামী নেতা ও কর্মীরা।যার সমাপ্তি ঘটে ষোলই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে।
১৯৭১ এর মার্চের শুরুতে পাকিস্থানের ষঢ়যন্ত্রের স্বরুপ প্রকাশ পেতে থাকে।মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্থানি শাসক গোস্ঠি লোক দেখানো আলোচনার অন্তরালে ব্যাপক গণহত্যা ওধ্বংসযজ্ঞের প্রস্তুতি নিতে থাকে।অন্যদিকে হরতাল,কার্ফুভংগ,আন্দোলনে সমগ্র দেশ উত্তাল।স্বাধিনতার আকাঙক্ষায় মুখর হয়ে ওঠে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি।এই প্রেক্ষাপটে সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষনে স্বাধিনতার ডাক দিলে শুরু হয়ে যায় স্বাধিনতার প্রস্তুতি।আওয়ামীলীগ ও অন্যন্য দেশপ্রেমিক দলের মত ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীগণ স্বাধিনতার দাবিকে সমর্থন জানায় একই সাথে জনগণকে প্রস্তুত করার জন্য রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে অগ্রসর হতে থাকে।এ সময়ে এ তিনটি সংগঠনের কাজের মূল ধারার মধ্যে ছিলঃ
১:স্বাধিনতার দাবিকে সমর্থনের জন্য ব্যাপক জনমত গঠন করা।
২:প্রস্তুতি হিসাবে প্রতিটি এলাকায় স্বেচ্ছসেবক ব্রিগেড গঠন এবং জেলার সর্বত্র ছাত্র,যুব ও মহিলাদের সংগঠিত করে তাদের সামরিক ও গরিলা ট্রেনিংয়ের আওতায় আনার প্রস্তুতি নেয়া।
৩: শিল্পী, সাহিত্যিক,শিক্ষক ওবুদ্ধীজিবিদের স্বাধিনতার পক্ষে সংগঠিত করা।
৪:সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য তাদের তৈরি করা।
৫:যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে অস্ত্র জোগার করা এবং প্রশিক্ষক খুজে বের করা।
এ তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কক্সবাজার সহ বৃহত্তর চট্রগ্রাম ও পার্বত্য রাঙ্গমাটি জেলায় স্বাধিনতার পক্ষে প্রস্তুতি নিতে ঝাপিয়ে পড়ে।পার্বত্য জেলা পর্যায়ের এসব কাজের মূল নেতৃত্বে ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ,আহসান উল্লাহ চৌধুরী,আবু বকর সিদ্দিক,দেওয়ান মোঃ আলী,আবু তাহর মাসুদ,শাহ মোহাম্মদ খোরশেদুল ইসলাম,তপন দত্ত প্রমুখ শ্রমিক নেত।ন্যাপ নেতাদের মধ্যে ছিলেন আহমেদুর রহমান আজমী,পূর্নেন্দু দস্তিদার,নুরুন্নবী,আব্দুল হাই,শফিউল আলম,বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী,সৈয়দ আবূল ফজল মাইজ ভান্ডারী,জহিরুল হক, বখতেয়ার নোমানী,অমল নাথ প্রমুখ।
পূর্নেন্দু কানুনগো,আব্দুস সাত্তার,অনঙ্গ সেন,ধীরেন দাস,কালিপ্রদ চক্রবর্তি প্রমুখ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা।আবুল হায়াত ও মোহাম্মদ মূসা ছিলেন কৃষক নেতা।আর যারা ছাত্র নেতৃত্বে ছিলেন তারা হলেন মাহবুবুল হক,গিয়াস ইদ্দীন আহমেদ,শামসুজ্জামান হীরা,আব্দুল আওয়াল,,শাহ আলম,বালাগাত উল্লাহ,আব্দুল্লাহ,মোহাম্মদ ইউসুফ,আলাউদ্দীন প্রমুখ।কক্সবাজারে এ তিন সংগঠনরে মূল নেতৃত্বে ছিলেন সুরেস সেন,সুভাস দাশ,রাখাল সরকার প্রমূখ রাঙ্গামাটিতে এ তিন সংগঠনের নেতৃত্ব দেনঃজ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,সুনীল কান্তি দে,বাবুল দে,মেমা চিং লিলি,আব্দুর রশীদ,দিলীপ দে, আবুল কাশেম প্রমূখসকল শ্রেনীর মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য নিরলস প্রচেস্টা চালিয়ে যেতে থাকে
১৫ই মার্চ ১৯৭১ চট্রগ্রামের সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজলের নেতৃত্বে লালদীঘিতে শিল্পী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতিরোধ সংঘ স্বাধিনতার পক্ষে যে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে তার নেপথ্যে কাজ করেছে এ তিন সংগঠনের নেতা-কর্মী-সংগঠকেরাঐ সময়ে চট্রগ্রামের নারী সমাজকে সংগঠিত করার কাজেও এ তিন সংগঠনের গুরুত্ব পুর্ন ভূমিকা ছিলকমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মহিলা পরিষদ চট্রগ্রাম শাখা১৮ই মার্চ চট্রগ্রামের জে এম সেন হলে মহিলা পরিষদ স্বাধিনতার পক্ষে নারী সমাবেশের আয়োজন করে কবি সুফিয়া কামাল এবং মালেকা বেগম অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন
২৩ ই মার্চ চট্রগ্রাম হোস্টেলের উত্তর পাশ্বর্স্থ প্যারেড ময়দানে যে বিশাল শিক্ষক,বুদ্ধিজীবিদের সমাবেশ হয় সেটার আয়োজনে ও ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টির এবং ছাত্র ইউনিউন নেতাদের অগ্রনী ভূমিকা লক্ষ করা যায়
২৪শে মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস বন্ধ করার জন্য ঘেরাও আন্দোলন হয়।জাহাজটি ছিল পাকিস্থানের শিপিং করপোরেশনের খাদ্যবাহী জাহাজ।ঐ জাহাজে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার জন্য চাউলের নিচে লুকিয়ে অস্ত্র আনা হচ্ছিল এ তথ্য পেয়ে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল।বন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি,ছাত্র ইউনিইয়ন সহ সর্বদলীয় নেতা কর্মীরা এই বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেয়।
২৪শে মার্চ মাদারবাড়ি এলাকায় অস্ত্রের গুদাম লুট করে প্রচুর পরিমানে অস্ত্র সংগ্রহ করেন ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা।এসব অস্ত্র ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন্য গোপনে বেগম মুসতারী ও ডা.শাফির এনায়েত বাজারস্থ বাসভবনে লুকিয়ে রাখা হয়।কিন্তু পরে গোপন সুত্রে সংবাদ পেয়ে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ঐ বাড়ি ঘেরাও করে এবং ডা.শাফিকে হত্যা করে।
২৫শে মার্চ রাতে ক্যাপটেন রফিকের নেতৃত্বে বাঙ্গালী সেনারা পাক হানাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ করলে এই তিন সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকে।এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ ও বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী।
২৫শে মার্চ কাল রাত্রে গনহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ হলে ২৬শে মার্চ চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।সেদিন কালুরঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বেতার সম্প্রচারের মাধ্যমে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিস্ঠায় ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীদের ভূমিকা ছিল অবিস্বরনীয়।আবুল কাসেম ও বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন এর মূল কারিগড়।তারা দুজনেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির পরম শুভাকাংখি।
২৮ শে মার্চ হানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।তারা টাইগার পাস হিল দখল করে এবং চট্রগ্রাম সার্কিট হাইসে সদর দপ্তর স্থাপন করে।পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্র্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়।ঢাকার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এই তিন দলের নেতারা ভবিষ্যত গেরিলা যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে চট্রগ্রামের গ্রামাঞ্চলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমে তারা আসেন বোয়ালখালির গোমদন্ডী গ্রামের বখতেয়ার নোমানী বাড়িতে।তারপর সেখান তেকে ছরিয়ে পড়ে আশে পাশের বিভিন্ন অঞ্চলে।যেমনগোমদন্ডী,সারোয়াতরী,করলাডাঙ্গা,পাহাড়, পটিয়াতে তারা যুবকদের যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে থাকে।
১১ ই এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয় এবং পটিয়ায় বোমা বর্ষন করলে শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনুর রশিদ ও আহসান উল্রাহ চৌধুরী সেখান থেকে পালিয়ে আগরতলা যেতে সমর্থ হলেও ভগ্ন স্বাস্থের অধিকারী পূর্নেন্দু দস্তিদার ৯ মে ডিজিটলং এ মৃত্যুবরন করেন।ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা নিরাপত্তার কথা ভেবে চট্রগ্রামের দক্ষিনের আরও প্রত্যান্ত অঞ্চলে যাওয়ার সিদ্ধন্ত গ্রহন করেন এবং কর্মী সমর্তক ও পরিবার পরিজনকে পটিয়া- বোয়ালকালি-বেতাগী-বাগোয়ান-আঁধানমানিক-রাউজান-ফাটকছড়ি-রামগড় হয়ে সাবরুমে ভারতীয় সিমান্তে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর চেস্টা চালান।কিন্তু রাউজানে মুসলীম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর চেলাদের কারনে ঐ পথে পাঠানো সম্ভব হয়নী্।এ অবস্থায় বখতেয়ার নোমানী,মাহবুবুল হক,গিয়াস উদ্দিন আহমদ ও শাহ আলম এর সমন্বয়ে গঠিত ৪ জনের একটি অগ্রবর্তী দল জিবনের ঝুকি নিয়ে হানাদার অধিকৃত চট্রগ্রাম শহরের ভিতর দিয়ে মীরেরসরাই-বুড়বুড়িয়া ঘাট-বড় লস্কর হাট-কালীদহ-পীর বক্স মুন্সীর হাট-ফুলগাজি—বেরোনিয়া হয়ে আগরতলা পৌছাতে সক্ষম হয়।তাদের এই সফল অভিযানের ফলে পরবর্তীতে এই রুটটি আগরতলা যাতায়াতের জন ব্যবহৃত হতে থাকে।বখতেয়ার নোমানী,গিয়াস উদ্দিন প্রমুখে নেতাদের এই পথ দিয়ে আগরতলায় পৌছানোর দায়ীত্ব পালন করেন।আগরতলায় ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা ক্র্যাফস হোস্টেলে থাকতেন।এখান থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কমরেড মনি সিংহ,মোজাফ্ফর আহমদ,মোহাম্মদ ফরহাদ,মতিয়া চৌধুরী,জ্ঞান চক্রবর্তী,অনিল মূখার্জি,পঙ্কজ ভট্রাচার্য,মতিউর রহমান,শেখর দত্ত আব্দুল হাদী প্রমূখ।চট্রগ্রামের নেতাদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ,আহসান উল্লাহ চৌধুরী,বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী,খোরশেদুল ইসরাম প্রমুখ।নারী নেত্রী বেগম মুসতারী শফি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মোহাম্মদ বেলাল ও এই হোস্টেলে কিছুদিন ছিলেন।কমান্ডার আব্দুর রউফ ও ড.আনিসুজ্জামান এখানে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।
এরপর আগরতলায় কর্তা বাড়িতে রিক্রুটিং সেন্টার ও অফিস গড়ে তোলা হয়।বাংলাদেশ থেকে পৌছানো কর্মী ও সংগঠকেরা এখানে আশ্রয় পেতেন,তারপর প্রাথমিক বাছাইয়ের পর কিছু প্রশিক্ষন শেষে তাদের মধ্যে থেকে গেরিলা যুদ্ধের জন্য যোদ্ধা বাছাই করা হত।এরপর তাদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য আসামের তেজপুর ক্যাম্প এ পাঠানো হত,প্রশিক্ষন শেষে তারা আবার এখানে ফিরে আসতো এবং এখান থেকেই দেশের ভিতর তাদের ইন্ডাকশনের ব্যাবস্থা করা হত।কমিউনিস্ট পার্টির মতিউর রহমান ও শেখর দত্ত এই দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন এবং ক্যাম্প পরিচালনা করতেন ছাত্রনেতা মাহবুবুল হক।
পরে বড়দুযারিতে আরও একটি ক্যাম্প তৈরি করা হয় যার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মুনজুরুল আহসান খান,ইয়াফেস ওসমান,নিজামুদ্দিন ও মাহবুবুল হক।এখানে নতুন রিক্রুটদের সামরিক প্রশিক্ষন দেয়া হত।এই ক্যাম্প থেকেই গেরিলা ট্রেনিং শেষে দেশের ভেতর এ ইন্ডাকশনরে সময় নিজাম উদ্দীন আজাদ সহ কয়েকজন গেরিলা বেতিয়ারায় শহিদ হন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
১৯৭১ এর মার্চের শুরুতে পাকিস্থানের ষঢ়যন্ত্রের স্বরুপ প্রকাশ পেতে থাকে।মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্থানি শাসক গোস্ঠি লোক দেখানো আলোচনার অন্তরালে ব্যাপক গণহত্যা ওধ্বংসযজ্ঞের প্রস্তুতি নিতে থাকে।অন্যদিকে হরতাল,কার্ফুভংগ,আন্দোলনে সমগ্র দেশ উত্তাল।স্বাধিনতার আকাঙক্ষায় মুখর হয়ে ওঠে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি।এই প্রেক্ষাপটে সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষনে স্বাধিনতার ডাক দিলে শুরু হয়ে যায় স্বাধিনতার প্রস্তুতি।আওয়ামীলীগ ও অন্যন্য দেশপ্রেমিক দলের মত ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীগণ স্বাধিনতার দাবিকে সমর্থন জানায় একই সাথে জনগণকে প্রস্তুত করার জন্য রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে অগ্রসর হতে থাকে।এ সময়ে এ তিনটি সংগঠনের কাজের মূল ধারার মধ্যে ছিলঃ
১:স্বাধিনতার দাবিকে সমর্থনের জন্য ব্যাপক জনমত গঠন করা।
২:প্রস্তুতি হিসাবে প্রতিটি এলাকায় স্বেচ্ছসেবক ব্রিগেড গঠন এবং জেলার সর্বত্র ছাত্র,যুব ও মহিলাদের সংগঠিত করে তাদের সামরিক ও গরিলা ট্রেনিংয়ের আওতায় আনার প্রস্তুতি নেয়া।
৩: শিল্পী, সাহিত্যিক,শিক্ষক ওবুদ্ধীজিবিদের স্বাধিনতার পক্ষে সংগঠিত করা।
৪:সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য তাদের তৈরি করা।
৫:যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে অস্ত্র জোগার করা এবং প্রশিক্ষক খুজে বের করা।
এ তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কক্সবাজার সহ বৃহত্তর চট্রগ্রাম ও পার্বত্য রাঙ্গমাটি জেলায় স্বাধিনতার পক্ষে প্রস্তুতি নিতে ঝাপিয়ে পড়ে।পার্বত্য জেলা পর্যায়ের এসব কাজের মূল নেতৃত্বে ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ,আহসান উল্লাহ চৌধুরী,আবু বকর সিদ্দিক,দেওয়ান মোঃ আলী,আবু তাহর মাসুদ,শাহ মোহাম্মদ খোরশেদুল ইসলাম,তপন দত্ত প্রমুখ শ্রমিক নেত।ন্যাপ নেতাদের মধ্যে ছিলেন আহমেদুর রহমান আজমী,পূর্নেন্দু দস্তিদার,নুরুন্নবী,আব্দুল হাই,শফিউল আলম,বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী,সৈয়দ আবূল ফজল মাইজ ভান্ডারী,জহিরুল হক, বখতেয়ার নোমানী,অমল নাথ প্রমুখ।
পূর্নেন্দু কানুনগো,আব্দুস সাত্তার,অনঙ্গ সেন,ধীরেন দাস,কালিপ্রদ চক্রবর্তি প্রমুখ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা।আবুল হায়াত ও মোহাম্মদ মূসা ছিলেন কৃষক নেতা।আর যারা ছাত্র নেতৃত্বে ছিলেন তারা হলেন মাহবুবুল হক,গিয়াস ইদ্দীন আহমেদ,শামসুজ্জামান হীরা,আব্দুল আওয়াল,,শাহ আলম,বালাগাত উল্লাহ,আব্দুল্লাহ,মোহাম্মদ ইউসুফ,আলাউদ্দীন প্রমুখ।কক্সবাজারে এ তিন সংগঠনরে মূল নেতৃত্বে ছিলেন সুরেস সেন,সুভাস দাশ,রাখাল সরকার প্রমূখ রাঙ্গামাটিতে এ তিন সংগঠনের নেতৃত্ব দেনঃজ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,সুনীল কান্তি দে,বাবুল দে,মেমা চিং লিলি,আব্দুর রশীদ,দিলীপ দে, আবুল কাশেম প্রমূখসকল শ্রেনীর মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য নিরলস প্রচেস্টা চালিয়ে যেতে থাকে
১৫ই মার্চ ১৯৭১ চট্রগ্রামের সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজলের নেতৃত্বে লালদীঘিতে শিল্পী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতিরোধ সংঘ স্বাধিনতার পক্ষে যে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে তার নেপথ্যে কাজ করেছে এ তিন সংগঠনের নেতা-কর্মী-সংগঠকেরাঐ সময়ে চট্রগ্রামের নারী সমাজকে সংগঠিত করার কাজেও এ তিন সংগঠনের গুরুত্ব পুর্ন ভূমিকা ছিলকমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মহিলা পরিষদ চট্রগ্রাম শাখা১৮ই মার্চ চট্রগ্রামের জে এম সেন হলে মহিলা পরিষদ স্বাধিনতার পক্ষে নারী সমাবেশের আয়োজন করে কবি সুফিয়া কামাল এবং মালেকা বেগম অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন
২৩ ই মার্চ চট্রগ্রাম হোস্টেলের উত্তর পাশ্বর্স্থ প্যারেড ময়দানে যে বিশাল শিক্ষক,বুদ্ধিজীবিদের সমাবেশ হয় সেটার আয়োজনে ও ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টির এবং ছাত্র ইউনিউন নেতাদের অগ্রনী ভূমিকা লক্ষ করা যায়
২৪শে মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস বন্ধ করার জন্য ঘেরাও আন্দোলন হয়।জাহাজটি ছিল পাকিস্থানের শিপিং করপোরেশনের খাদ্যবাহী জাহাজ।ঐ জাহাজে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার জন্য চাউলের নিচে লুকিয়ে অস্ত্র আনা হচ্ছিল এ তথ্য পেয়ে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল।বন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি,ছাত্র ইউনিইয়ন সহ সর্বদলীয় নেতা কর্মীরা এই বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেয়।
২৪শে মার্চ মাদারবাড়ি এলাকায় অস্ত্রের গুদাম লুট করে প্রচুর পরিমানে অস্ত্র সংগ্রহ করেন ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা।এসব অস্ত্র ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন্য গোপনে বেগম মুসতারী ও ডা.শাফির এনায়েত বাজারস্থ বাসভবনে লুকিয়ে রাখা হয়।কিন্তু পরে গোপন সুত্রে সংবাদ পেয়ে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ঐ বাড়ি ঘেরাও করে এবং ডা.শাফিকে হত্যা করে।
২৫শে মার্চ রাতে ক্যাপটেন রফিকের নেতৃত্বে বাঙ্গালী সেনারা পাক হানাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ করলে এই তিন সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকে।এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ ও বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী।
২৫শে মার্চ কাল রাত্রে গনহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ হলে ২৬শে মার্চ চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।সেদিন কালুরঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বেতার সম্প্রচারের মাধ্যমে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিস্ঠায় ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীদের ভূমিকা ছিল অবিস্বরনীয়।আবুল কাসেম ও বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন এর মূল কারিগড়।তারা দুজনেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির পরম শুভাকাংখি।
২৮ শে মার্চ হানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।তারা টাইগার পাস হিল দখল করে এবং চট্রগ্রাম সার্কিট হাইসে সদর দপ্তর স্থাপন করে।পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্র্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়।ঢাকার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এই তিন দলের নেতারা ভবিষ্যত গেরিলা যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে চট্রগ্রামের গ্রামাঞ্চলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমে তারা আসেন বোয়ালখালির গোমদন্ডী গ্রামের বখতেয়ার নোমানী বাড়িতে।তারপর সেখান তেকে ছরিয়ে পড়ে আশে পাশের বিভিন্ন অঞ্চলে।যেমনগোমদন্ডী,সারোয়াতরী,করলাডাঙ্গা,পাহাড়, পটিয়াতে তারা যুবকদের যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে থাকে।
১১ ই এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয় এবং পটিয়ায় বোমা বর্ষন করলে শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনুর রশিদ ও আহসান উল্রাহ চৌধুরী সেখান থেকে পালিয়ে আগরতলা যেতে সমর্থ হলেও ভগ্ন স্বাস্থের অধিকারী পূর্নেন্দু দস্তিদার ৯ মে ডিজিটলং এ মৃত্যুবরন করেন।ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা নিরাপত্তার কথা ভেবে চট্রগ্রামের দক্ষিনের আরও প্রত্যান্ত অঞ্চলে যাওয়ার সিদ্ধন্ত গ্রহন করেন এবং কর্মী সমর্তক ও পরিবার পরিজনকে পটিয়া- বোয়ালকালি-বেতাগী-বাগোয়ান-আঁধানমানিক-রাউজান-ফাটকছড়ি-রামগড় হয়ে সাবরুমে ভারতীয় সিমান্তে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর চেস্টা চালান।কিন্তু রাউজানে মুসলীম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর চেলাদের কারনে ঐ পথে পাঠানো সম্ভব হয়নী্।এ অবস্থায় বখতেয়ার নোমানী,মাহবুবুল হক,গিয়াস উদ্দিন আহমদ ও শাহ আলম এর সমন্বয়ে গঠিত ৪ জনের একটি অগ্রবর্তী দল জিবনের ঝুকি নিয়ে হানাদার অধিকৃত চট্রগ্রাম শহরের ভিতর দিয়ে মীরেরসরাই-বুড়বুড়িয়া ঘাট-বড় লস্কর হাট-কালীদহ-পীর বক্স মুন্সীর হাট-ফুলগাজি—বেরোনিয়া হয়ে আগরতলা পৌছাতে সক্ষম হয়।তাদের এই সফল অভিযানের ফলে পরবর্তীতে এই রুটটি আগরতলা যাতায়াতের জন ব্যবহৃত হতে থাকে।বখতেয়ার নোমানী,গিয়াস উদ্দিন প্রমুখে নেতাদের এই পথ দিয়ে আগরতলায় পৌছানোর দায়ীত্ব পালন করেন।আগরতলায় ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা ক্র্যাফস হোস্টেলে থাকতেন।এখান থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কমরেড মনি সিংহ,মোজাফ্ফর আহমদ,মোহাম্মদ ফরহাদ,মতিয়া চৌধুরী,জ্ঞান চক্রবর্তী,অনিল মূখার্জি,পঙ্কজ ভট্রাচার্য,মতিউর রহমান,শেখর দত্ত আব্দুল হাদী প্রমূখ।চট্রগ্রামের নেতাদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ,আহসান উল্লাহ চৌধুরী,বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী,খোরশেদুল ইসরাম প্রমুখ।নারী নেত্রী বেগম মুসতারী শফি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মোহাম্মদ বেলাল ও এই হোস্টেলে কিছুদিন ছিলেন।কমান্ডার আব্দুর রউফ ও ড.আনিসুজ্জামান এখানে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।
এরপর আগরতলায় কর্তা বাড়িতে রিক্রুটিং সেন্টার ও অফিস গড়ে তোলা হয়।বাংলাদেশ থেকে পৌছানো কর্মী ও সংগঠকেরা এখানে আশ্রয় পেতেন,তারপর প্রাথমিক বাছাইয়ের পর কিছু প্রশিক্ষন শেষে তাদের মধ্যে থেকে গেরিলা যুদ্ধের জন্য যোদ্ধা বাছাই করা হত।এরপর তাদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য আসামের তেজপুর ক্যাম্প এ পাঠানো হত,প্রশিক্ষন শেষে তারা আবার এখানে ফিরে আসতো এবং এখান থেকেই দেশের ভিতর তাদের ইন্ডাকশনের ব্যাবস্থা করা হত।কমিউনিস্ট পার্টির মতিউর রহমান ও শেখর দত্ত এই দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন এবং ক্যাম্প পরিচালনা করতেন ছাত্রনেতা মাহবুবুল হক।
পরে বড়দুযারিতে আরও একটি ক্যাম্প তৈরি করা হয় যার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মুনজুরুল আহসান খান,ইয়াফেস ওসমান,নিজামুদ্দিন ও মাহবুবুল হক।এখানে নতুন রিক্রুটদের সামরিক প্রশিক্ষন দেয়া হত।এই ক্যাম্প থেকেই গেরিলা ট্রেনিং শেষে দেশের ভেতর এ ইন্ডাকশনরে সময় নিজাম উদ্দীন আজাদ সহ কয়েকজন গেরিলা বেতিয়ারায় শহিদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলা থেকে নেতাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নিরলস কাজ করেছেন,গেরিলারা জিবনের ঝুকি নিয়ে বিপুল মরনাস্ত্র সজ্জিত পাক হানাদের মোকাবেলা ও পর্যদুস্ত করেছেন।দেশের অভ্যন্তরে বহূ মানুষ জিবনের ঝুকি নিয়ে গেরিলাদের আশ্রয় দিয়েছেন,সহায়তা করেছেন।ভারতীয় জনগণ আমাদের পাশে দাড়িয়ে অকুন্ঠ সমর্থন দিয়েছেন,এক কোটি শরনার্থীকে আশ্রয় দেয়া সহ বহূ ত্যাগ স্বিকার করেছেন।সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সহ বিশ্বের গনতান্ত্রিক স্বাধীনতাকামী ও প্রগতিশীল জনগণ আমাদের প্রতি তাদের অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন।এভাবে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জয় হয়েছে।বিশ্বসভায় উড়তে শুরু করল লাল সবুজের পতাকা। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ২ টি
০৪ জানুয়ারি ’১৬ বিকাল ০৫:২০
মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার পেছনে বামদের ভূমিকা সত্যিই অনস্বীকার্য!
০৪ জানুয়ারি ’১৬ রাত ০৯:৪৪
নিঃস্বার্থভাবে একমাত্র বামরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছিল,এটা আমি বিশ্বাস করি যদিও বামদের সহ্য করতে পারিনা!