রুনা লায়লাঃ সঙ্গীতজগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তী
রুনা লায়লা, বাংলা সঙ্গীতের এক পরিপুরক নাম। তার জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ই নভেম্বর, তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের সিলেটে। রুনার পিতার নাম এমদাদ আলী এবং মায়ের নাম অনিতা সেন ওরফে আমেনা লায়লা। বোন দীনা লায়লা ও ভাই সৈয়দ আলী মুরাদ। তার পিতার বাড়ি রাজশাহী।
সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা প্রথম নাচ শিখেছিলেন। বাবা এমদাদ আলী ছিলেন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। থাকতেন পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে মেয়েকে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করেন মা আমিনা লায়লা। এই প্রতিষ্ঠানে চার বছর নাচ শিখেছেন রুনা। শিক্ষক ছিলেন আফরোজা বুলবুল। রুনা তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন কত্থক আর ভরতনাট্যম।
মঞ্চে রুনা লায়লার গান গাওয়ার শুরুটা একদম হঠাৎ করেই। তখন তিনি করাচিতে থাকতেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে গান শুরু করেন রুনা। করাচিতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন। এখানে গান করবেন দিনা (রুনার বড় বোন)। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিনা। বিপদে পড়েন আয়োজকেরা। শেষে বড় বোনের জায়গায় ছোট বোনকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর মাত্র সাড়ে ১১ বছর বয়সে পাকিস্তানের ‘জুগনু’ ছবির মাধ্যমে প্লেব্যাকের খাতায় নাম লেখান তিনি। গানটি ছিল ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। পুরো এক মাস চর্চা করেন রুনা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দুই ঘণ্টা আর স্কুল থেকে ফেরার পর দুই ঘণ্টা। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন মনজুর হোসেন।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্লেব্যাক করেন পাকিস্তানের অনেক ছবিতে।
১৯৭৪ সালে ‘এক ছে বারকার এক’ ছবির মধ্য দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু হয় তার। একই বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে সত্য সাহার সুরে ‘জীবন সাথী’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন তিনি। এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন ছবিতে একের পর এক সুপারহিট গান উপহার দিতে থাকেন রুনা। বাংলা, হিন্দি, উর্দু গানে নিজেকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ গানটি রুনা লায়লাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এ গানটি পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেরই গানপাগল শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক- সব ধাঁচের গানই গেয়েছেন তিনি। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজিসহ ১৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।
রুনা লায়লা প্রথম বাংলা গান রেকর্ডিং করেন পাকিস্তান রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। দেবু ভট্টাচার্যের সুর করা গান দুটি ছিল ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ আর ‘আমি নদীর মতো পথ ঘুরে’।
১৯৭৪ সালে রুনা লায়লা পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বেতার টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
একই বছর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে প্রথম ভারত সফর করেন রুনা। ভারতে প্রথম গান করেন দিল্লি বিজ্ঞান ভবনে, এরপর মুম্বাইয়ে শান মুখআনন্দ হলে। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে তাঁকে বলা হয় ‘দামাদাম গার্ল’। তাঁর প্লেব্যাক করা প্রথম হিন্দি ছবি এক সে বড়কার এক।
পাকিস্তানে নিসার বাজমির সুর করা অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা। রুনাকে দিয়ে নানা ধরনের গান করিয়েছেন এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক। পরে মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান রুনাকে দিয়ে নিসার বাজমির সুর করা গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করে। প্রতিদিন একই সুরকারের ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন রুনা। পরে তা বিশ্বরেকর্ড হিসেবে স্থান পায় গিনেস বুকে।
১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর। এদিন রুনার গাওয়া বাপ্পী লাহিড়ীর সুর করা গান নিয়ে ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশ করে সুপার রুনা অ্যালবাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রথম দিনেই অ্যালবামটির এক লাখ কপি বিক্রি হয়। উপহার হিসেবে রুনাকে দেওয়া হয় গোল্ড ডিস্ক। রুনা বললেন, ‘অ্যালবামটির কাজ করেছিলাম লন্ডনে। লন্ডনের এবি রোডেস, যেখানে বিটল্স গান রেকর্ডিং করত।’
ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে পাকিস্তান থেকে তো বটেই, ভারত থেকেও অসংখ্য প্রস্তাব পান রুনা লায়লা। কিন্তু তখন তিনি গানকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শেষে একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ছবির নাম শিল্পী। 'শিল্পী'চলচ্চিত্রে তিনি মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। তার সহশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন চিত্রনায়ক আলমগীর। পরবর্তীতে তাকেই বিয়ে করে এখন পর্যন্ত সংসার করে যাচ্ছেন।
জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন রুনা লায়লা। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে 'স্বাধীনতা দিবস' পুরস্কারে ভূষিত করে। তিনি মোট চারবার চলচ্চিত্রের শ্র্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সঙ্গীতের জন্য তিনি নিজের দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
তিনি ভারতে 'সায়গল পুরস্কার' পেয়েছেন। পাকিস্তানে দু'বার নিগার পুরস্কার, দু'বার গ্র্যাজুয়েট পুরস্কার এবং 'জাতীয় সঙ্গীত পরিষদ স্বর্ণপদক' পেয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি দেশে ও বিদেশে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
দিল্লির ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক বিখ্যাত সাংবাদিক খুশওয়ান্ত সিং দিল্লিতে আমার একটা কনসার্টে এসেছিলেন। পরে তিনি পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে ওই কনসার্টের বর্ণণা শেষে লিখেছিলেন, ‘শিল্পী রুনা লায়লার গান শোনা এবং তাকে দেখার পর বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ করব, তারা যেন রুনা লায়লাকে আমাদের দিয়ে, বিনিময়ে ফারাক্কার সব পানি নিয়ে নেয়!’
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৮ টি