লকডাউন নয়, লাগবে টিকা
করোনাভাইরাস ঠেকাতে কঠোর বিধি-নিষেধের সময়সীমা ৭ জুলাই ২০২১ থেকে আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে এখন ১৪ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও দেশে মৃত্যু এবং সংক্রমণ সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়ার ফলে পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ১ জুলাই, কঠিন লকডাইনের দিন রেকর্ড ১৪৩ জন মারা যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, সর্বশেষ ৫ জুলাই দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৫৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যা এ পর্যন্ত কোভিডে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক। ২৭ জুন থেকেই দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা একশ’র উপরে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সুস্পষ্ট প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। মে মাসে ৪৫ শতাংশ ও জুন মাসে ৭৮ শতাংশ নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। সামনে কী অপেক্ষা করছে একমাত্র আল্লাহ জানেন। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বা ভারতীয় জাতের এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। ভারতের আপত্তির মুখে যেটিকে পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেল্টা নাম দিয়েছে। আপত্তির কারণও ছিল কারণ উহানে ধরা পড়েছে বলে তো করোনার ‘উহান ভ্যারিয়েন্ট’ বা ‘চায়না ভ্যারিয়েন্ট’ নাম দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগজনক ভাইরাস হিসেবে যে চারটিকে শনাক্ত করেছে তাদের মধ্যে ডেল্টা একটি। বাকি তিনটির আলফাকে আগে ‘ইউকে ভ্যারিয়েন্ট’ বলা হতো কারণ তার উৎপত্তি ব্রিটেনে হয়েছে, সেইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টকে নাম দেওয়া হয়েছে বিটা এবং ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টের নতুন নামকরণ করা হয়েছে গামা।
শুধু বাংলাদেশ নয়, আমেরিকা, ইউরোপেও উদ্বেগ আছে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে তৃতীয় ঢেউ চলে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কিছু দেশে। আজ পর্যন্ত ৮০ টি দেশে এটি ছড়িয়েছে এবং খুব কম সময়ে সহজে বিস্তার লাভ করছে। একটি মাত্র ভালো দিক হচ্ছে কোভিডের যত টিকা বেরিয়েছে সবগুলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে কাবু করতে পারে। তবে রোগের লক্ষণ প্রথম যখন করোনা দেখা দিয়েছিল সেই অরিজিনাল লক্ষণের থেকে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। লোকজনকে হাসপাতালেও যেতে হচ্ছে বেশি বেশি।
কোভিড সংক্রমণের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে উদাসিনতা, অবহেলার এবং নানা দুর্নীতিতে নাম কামালেও ভারতের সেরাম ইনিস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা দেওয়া শুরু করলে মানুষের ক্ষোভ কমেছিল। গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে ওই টিকা দিয়ে শুরু হয় গণ টিকাদান কার্যক্রম। কিন্তু চুক্তি করলেও শেষ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত টিকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারত করোনাভাইরাসের টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচিতে সৃষ্টি হয়েছে সংকট, অনিশ্চয়তাও। এমনকি যারা প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন তাদের অনেককেই দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়ার মতো মজুদ ছিল না। ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজের টিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায়, বাংলাদেশ সরকার নতুন করে চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ থেকে টিকা আনার ব্যাপারে চেষ্টা শুরু করে।
ফাইজার বা সিনোফার্মের কিছু নতুন টিকা আসায়, পহেলা জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ সারা দেশে আবারও করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যারা অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি তাদের কী হবে? সংখ্যায় তারা কম নয়, সাড়ে ১৩ লাখের মতো। তাদের ফাইজার বা সিনোফার্মের টিকা নেওয়া নিরাপদ হবে কিনা, নাকি নতুন করে কোনও টিকার দুই ডোজ নিতে হবে সেই অনিশ্চয়তাও কাটেনি। কারণ ভ্যাকসিন মিক্স করা যায় কিনা সেটা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রিপোর্ট বেরিয়েছে। এইসব রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেবেন যে অন্যান্য দেশের মতো টিকার মিক্স-ম্যাচ আমাদের দেশে করা যাবে কিনা। সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদেরকে কোনও টিকা দেওয়া হচ্ছে না।
টিকা নিয়ে যখন এমন অনিশ্চয়তা কাজ করছে তখন ভারতের প্রতিশ্রুত টিকা পাওয়া সম্ভব কিনা সেটাও দেখা হচ্ছে। ভারত থেকে টিকা কেনার এজেন্ট ছিল বেক্সিমকো। তারা নিজেরা ব্যর্থ হয়ে সেরাম থেকে প্রাপ্য টিকার চালান আনার জন্য ভারত সরকারের ওপর চাপ দিতেও বলেছিল বাংলাদেশ সরকারকে কারণ সেরামকে দেড় কোটি ডোজ টিকার জন্য অগ্রিম অর্থ দিয়েছে বাংলাদেশ, তাই সেটি ভারত আটকাতে পারে না। সেরাম থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার জন্য বাংলাদেশ চুক্তি করেছে। তবে ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ২০ লাখ ডোজ টিকাসহ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এক কোটি ২ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। ভারত কি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে বাকি টিকা দিবে? দিলে কবে?
এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী এক হাজার হাড়িভাঙ্গা আম পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য। ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দের জন্যও পাঠানো হয়েছে আরও হাজার কেজি। শুধু তাই নয়, আম পেয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরাও। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার হাড়িভাঙ্গা আম উপহার পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রিপুরার বিপ্লব দেব, মেঘালয়ের কনরাড সাংমা আর আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মা। ফলে দিল্লি থেকে কলকাতা, গুয়াহাটি, শিলং বা আগরতলা— সর্বত্রই নাকি হাড়িভাঙ্গার স্বাদ আর অপূর্ব সুবাস বয়ে যাচ্ছে!
ভারত বাংলাদেশ দু’দেশই এটাকে ‘ম্যাঙ্গো ডিপ্লোম্যাসি’ বলতে নারাজ। বলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ব্যক্তিগত প্রীতি উপহার’ এবং এর মধ্যে কূটনীতি খোঁজার অর্থ হয় না। তারপরেও কেউ কেউ আশা করছেন যেদিন ভারত আবার টিকা রফতানি করার মতো জায়গায় যাবে, সেদিন সবার আগে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে বাংলাদেশের প্রয়োজনের কথা ভাবতে হবে। অবশ্য যেখানে নরেন্দ্র মোদি সকাল-বিকাল টুইট করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সেখানে রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম খেয়ে তিনি কতটা আনন্দিত এখন পর্যন্ত টুইট করে কিছু বলেননি।
চলমান লকডাউনে মানুষের জীবন-জীবিকা সবই হুমকির মুখে। আসন্ন কোরবানী ঈদে সরকার এটি প্রত্যাহার করে নেবেন বলাই যায় কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই কঠোর লকডাউন চলছে সেটি অর্জিত হবে কিনা বড় প্রশ্ন হয়ে থাকবে। ভারতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের নতুন সংস্করণ ডেল্টা প্লাস বেরিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আংশকা করছেন আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তা ভারতে আঘাত আনতে পারে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই তার ছোঁয়া থেকে দূরে থাকবে না। আর নির্দিষ্ট কোনও ভ্যারিয়েন্টের জন্য নির্দিষ্ট কোনও দেশ দায়ীও না কারণ কেউ জানে না আগামীকাল বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট বলে যদি নতুন করোনাভাইরাস আবিষ্কার হয় সেটি বিশ্বের জন্য কতটা হুমকি।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সেইসব দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বেশি দেখা দিচ্ছে সেসব দেশে কোভিড টিকাদানের হার ৫ শতাংশের বেশি না। আবার ইসরায়েলের মতো দেশ যেখানে ৬০ শতাংশ নাগরিক কোভিড টিকা নিয়েছে সেখানে মৃত্যু এবং হাসপাতালে রোগী যাওয়ার সংখ্যা অতি নগন্য। সুতরাং টিকাই দরকার সবার আগে। লকডাউন, শাটডাউন যত নামে, যত কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হোক না কেন- করোনা থেকে রক্ষা পেতে টিকা কর্মসূচি পূর্ণ বাস্তবায়নের কোনও বিকল্প নেই।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.