সৌদি-আমেরিকা দ্বৈরথের পরিসমাপ্তি হচ্ছে
সৌদি আরবের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সরকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতিমালা থেকে যে আরও সরে আসছে তার ইঙ্গিত মিলেছে চলতি সপ্তাহে। বাইডেন সরকার চায় সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কে আইনের শাসন এবং মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া হোক।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব ইয়েন সাকি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র-দেশ সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটিকে পূন:মূল্যায়ণ করতে চান।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার মেয়ের স্বামী জ্যারেড কুশনারের মাধ্যমে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, এবং ইয়েমেনের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র ব্যবহারে ব্যাপক স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বাদশাহ সালমানের সাথে সরাসরি কাজ করতে চান, যদিও ৮০ বছর বয়সী বাদশাহর স্বাস্থ্য ভাল না। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালায় আইনের শাসন এবং মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
প্রশ্ন হলো নতুন এই অবস্থান এই দুই দেশের জন্য কী অর্থ বহন করে? আর ওয়াশিংটন এবং রিয়াদের জন্য এখানে ঝুঁকিগুলো কোথায়? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি যুবরাজের সাথে গড়ে তুলেছিলেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
যে তিনটি বিষয় নিয়ে সঙ্কটে রয়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান
তার জন্য মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের অর্থ হলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানায় যে সুদিন তার জন্য এসেছিল, কার্যত তার অবসান ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত ও নিরাপত্তার সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে হোয়াইট হাউজের নতুন চিন্তাধারাকে মেনে নিতে হবে এবং প্রয়োজনে স্বার্থত্যাগ করতে হবে।
ইয়েমেনে সৌদি-নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে কোন মার্কিন সমর্থন পাওয়া যাবে না। সৌদির বলছে, তাতে কোন সমস্যা নেই। তারাও এই লড়াইয়ের অবসান চাইছে।
কাতারের সাথে সম্পর্ক মেরামত করতে হবে, বলছে মার্কিনীরা। ইতোমধ্যেই এটা করা হয়েছে।
ক্যাপিটল হিল থেকে বলা হয়েছে, সৌদি মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। গত সপ্তাহেই শীর্ষস্থানীয় নারী অধিকার কর্মী লুজায়েইন আল-হাতলুলকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাকে পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে। ১৯৪৫ সালে এক মার্কিন রণতরীতে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ ইবন সৌদের সাথে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের যে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছিল সেটা ছিল এই সম্পর্কের সূচনা।
এরপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক বজায় রয়েছে - ১৯৭৩ সালের তেল অবরোধ, ১৯৯১ সালের পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ, এবং ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেন হামলা, যেখানে আল-কায়েদার বেশিরভাগ আত্মঘাতী হামলাকারী ছিল সৌদি নাগরিক।
জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর সৌদি সরকারের তরফ থেকে তার প্রতি অভিনন্দন-বার্তা পাঠাতে বেশ কিছু দিন সময় লেগেছিল। তবে হোয়াইট হাউজের নতুন প্রশাসন নিয়ে সৌদিরা অস্বস্তিতে পড়লেও তারা যে রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে নতুন বন্ধু খুঁজতে যাবে এমনটা মনে হয় না।
তারা জানে যে যুক্তরাষ্ট্রের ৫ম নৌবহর, যেটি এখন পারস্য উপসাগরে মোতায়েন রয়েছে, ওয়াশিংটন সেটিকে সরিয়ে আনলে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় শত্রু-দেশ ইরান সেই জায়গা দখল করবে, এবং ঐ অঞ্চলে তারা সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশে পরিণত হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও বলছে যে আত্মরক্ষার কাজে তারা সৌদি আরবকে সহায়তা দিয়ে যাবে। ইয়েমেন থেকে হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবে যেসব বিস্ফোরক-বাহী ড্রোন পাঠাচ্ছে, তারা সেগুলোও ঠেকিয়ে দিতে সহায়তা করবে।
মি. বাইডেন যে কৌশল নিয়েছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ঝুঁকি রয়েছে। বাদশাহ সালমান খুবই অসুস্থ, এবং সৌদি আরবের দৈনন্দিন দেশ পরিচালনার কাজটি তিনি করতে অক্ষম। ফলে যুক্তরাষ্ট্র পছন্দ না করলেও তাদের হয়তো সৌদি যুবরাজের সাথে আগামী কয়েক দশক ধরে কাজ করতে হতে পারে।
বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশের কাছেই এমবিএস একটি বিষাক্ত নাম। তার নির্দেশেই ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগজিকে হত্যা করা হয় বলে গভীর সন্দেহ রয়েছে। তবে যুবরাজ এই অভিযোগ অস্বীকার করে থাকেন।
তবে সৌদি আরবের ভেতরে এমবিএস বেশ জনপ্রিয়, বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে। সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে যুবরাজের নেয়া পদক্ষেপগুলোর তারা প্রশংসা করেন।
৩৫ বছর বয়সী এই যুবরাজ যেমন তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়, তেমনি এরই মধ্যে তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতার মালিক হয়েছেন। সৌদি সশস্ত্র বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল গার্ড - সব বাহিনী এখন তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে।
অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে তিনি তার পথের সব কাঁটা দূর করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের একজন সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে যাকে মনে করা হচ্ছিল। তিনি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ। ২০১৭ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এমবিএস তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং এখনও বন্দি করে রেখেছেন।
তবে সৌদি আরবের ওপর চাপ প্রয়োগের প্রশ্নে অনেক সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদামত ফলাফল দেখা যায়নি। ২০০৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস মধ্যপ্রাচ্যে একনায়কতন্ত্রের নিন্দা জানিয়েছিলেন এবং গণতন্ত্রকে বরণ করে সৌদিদের অবাধ নির্বাচন আয়োজন করতে বলেছিলেন।
সৌদি শাসকরা তখন পরীক্ষামূলক-ভাবে গণতন্ত্রের স্বাদ নেয়ার ব্যবস্থা করেছিল, এবং সীমিত আকারে পৌর নির্বাচনের আয়োজন করছিল।
কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল কট্টর, ও প্রধানত পশ্চিমা-বিরোধী, ইসলামপন্থী প্রার্থীরাই ঐ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন।
পরে, সৌদি নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল: "যা চাইবেন তা একটু সতর্কভাবে চাইবেন।"
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.