আল জাজিজার প্রতিবেদন ও আমরা

গত ১ ফেব্রুয়ারি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ প্রতিবেদনটি আমাদের সরকার পরিচালনার কিছু দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, যেখানে যোগ্যতা বিবেচনা না করে ব্যক্তিগত পছন্দ বা সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগের প্রসঙ্গ এসেছে। সেই সঙ্গে প্রকাশ করেছে আমাদের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন, সেই বিষয়টিও।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমত, ইসরায়েলের নাম গোপন করে দেশটির একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত সংবেদনশীল টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র কেনার অভিযোগ এসেছে, যেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কই নেই। দ্বিতীয়ত, দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধানের ক্ষমতা অপব্যবহার করে তার ভাইকে ছদ্ম নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ভুয়া পাসপোর্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তার ভাই হাঙ্গেরিতে থাকতে পারে এবং ব্যবসা করতে পারে। প্রতিবেদন থেকে আরও একটি প্রশ্ন উঠেছে। সেটি হলো— স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি এই পলাতক ভাইয়েরা কীভাবে পুলিশের অজান্তে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছে, যোগ দিচ্ছে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠানে? এর প্রত্যেকটিই ফৌজদারি অপরাধ। এর মধ্যে যেকোনো একটি অপরাধ করলেই যেকোনো সাধারণ মানুষের কারাগারে থাকার কথা। তবে যাদের নিয়ে এই প্রতিবেদন, তারা কোনো সাধারণ মানুষ নন।
ইসরায়েল থেকে নজরদারি করার যন্ত্র কেনার বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কাজেই এই বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার করে সবার সামনে তুলে ধরা দরকার। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) প্রতিবাদলিপিতে ইসরায়েল থেকে এ জাতীয় যন্ত্র কেনার কথা অস্বীকার করে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরি থেকে কেনা হয়েছে। হাঙ্গেরি থেকে কেন এই সরঞ্জাম কেনা হলো? এই জাতীয় সরঞ্জাম তৈরির জন্য হাঙ্গেরি কখনোই নির্ভরযোগ্য বলে জানা যায় না। আল জাজিরার প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য আইএসপিআরের উচিত হাঙ্গেরির যে প্রতিষ্ঠান থেকে সরঞ্জাম কেনা হয়েছে তার নাম প্রকাশ করে নথিগুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা। যেহেতু আড়িপাতার যন্ত্রগুলো জাতিসংঘের মিশনের জন্য কেনা হয়েছিল, তাই এ সম্পর্কিত তথ্য সামনে আনা হলে দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার কথা না। তা না করে কেবলমাত্র প্রতিবাদলিপি দেওয়ার মাধ্যমে অস্বীকার করে অভিযোগের বরফ খুব বেশি গলানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
যতটুকু সরকার ও আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশি গণমাধ্যম যতটা প্রচার করছে, সেটাই এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। আমাদের হাজারো পাঠক জানতে চাইছেন আল জাজিরা কী বলেছে সেটা প্রকাশ না করে আমরা কীভাবে সরকার ও সামরিক বাহিনীর প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করছি? সাংবাদিকতার সাধারণ চর্চা এবং দ্য ডেইলি স্টারে যেটা অনুসরণ করি সেটা হলো— আমরা যদি মূল ঘটনা প্রকাশ না করি, তাহলে প্রতিবাদলিপিও প্রকাশ করি না। এক্ষেত্রে মূল ঘটনাটি আল জাজিরার প্রতিবেদন এবং প্রতিবাদলিপি দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনী। পাঠক জানতে চায়, কী কারণে আমরা প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু প্রকাশ করিনি।
গণমাধ্যম হিসেবে আজ আমরা মুক্ত হলে প্রতিবেদনটি নিয়ে আরও গভীর আলোচনা করতে পারতাম এবং এটি নিয়ে পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করে এর পেছনের সত্যটা বের করতে পারতাম। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হিসেবে আল জাজিরার এই প্রতিবেদনকে সর্বোচ্চ মানের বলা যায় না। প্রতিবেদনটির শক্তিশালী কিছু দিক থাকলেও দুর্বলতা রয়েছে বিস্তর। আমি মনে করি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনুমান ও কটাক্ষ করে দাবি করার চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ তুলে ধরাটা বেশি জরুরি। প্রতিবেদনটিতে যত জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে, তত তথ্য দিয়ে সব বিষয়ের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। তবে, এই প্রতিবেদনের শক্তিশালী দিক হলো— এটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণ দিয়েছে। এ ছাড়াও কিছু শক্তিশালী ও সুনির্দিষ্ট বিষয়ের তথ্য-প্রমাণও প্রতিবেদনে রয়েছে।
কিন্তু, সে কথা কে বলবে? আমরা যদি আরও ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে পারতাম, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারতাম এই প্রতিবেদনের দুর্বল দিকগুলো। আমরা কি সেটা করতে পারি? আমরা কি জনগণের কাছে নীতি নির্ধারকদের জবাবদিহি করাতে পারি? আমরা কি এটা প্রকাশ করতে পারি যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে কেন এত দেরি হয় এবং সেগুলোর খরচ কেন প্রাক্কলিক বাজেটের চেয়ে তিন-চার গুণ বেড়ে যায়? আমরা কি খুঁজে বের করতে পেরেছি যে কারা বিদেশে অর্থ পাচার করে? এমনকি পানামা পেপারসে যখন আমাদের দেশের কিছু মানুষের নাম প্রকাশ পেল তখনো কি আমরা বিষয়টি অনুসন্ধান করেছি? বছরের পর বছর যাদের কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের কি আমরা খুঁজে বের করতে পেরেছি? আমরা কি খুঁজে বের করতে পেরেছি যে কেন ঋণখেলাপিদের টাকা পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, সুদ মওকুফ হচ্ছে? টরন্টোর ‘বেগম পাড়া’য় যাদের বাড়ি আছে বা মালয়েশিয়ায় অবৈধ সেকেন্ড হোম যারা করেছেন, তাদের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? না, তাদের কারও বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করিনি। কারণ, তারা সবাই আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী। আমরা তাদের নাড়ানোর সাহস পাইনি। কখনো কখনো আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করি। সেটা করতে পারি তখনই, যখন ঘটনার মূল হোতাকে সামনে না আনা হয়, কিংবা আসল অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় না থাকে কিংবা আমাদের প্রতিবেদন তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.