বিদ্যুৎ আমদানি কার স্বার্থে?
ভারতের পাঁচটি উৎস থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২৫০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র থেকে আমদানি ব্যয় পড়ে প্রায় সাড়ে তিন টাকা। বাকিগুলো থেকে আমদানি খরচ ইউনিটপ্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা। যদিও চাহিদা না থাকায় আমদানি সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। এরপরও ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আমদানি করা হবে আরও এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে এ বিদ্যুৎ আমদানিতে ২০১৭ সালে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এ বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশকে উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে, বছরে যার পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। যদিও বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত রয়েছে। তাই এ বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে অনেকটাই অস্বস্তিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির এ বিদ্যুৎ আমদানির কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কারণ বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আর চাহিদা ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে শীতে এ চাহিদা সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। আবার সন্ধ্যার তুলনায় দিনে চাহিদা অনেকখানি কমে যায়। তাই উচ্চ ব্যয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত পুরোই অযৌক্তিক। এছাড়া এ বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ও অনেক বেশি পড়বে বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
তথ্যমতে, আদানি থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে ২০১০ সালে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছিল বাংলাদেশ। আর চূড়ান্ত চুক্তি হয় ২০১৭ সালে। আগামী বছরের (২০২২ সাল) শুরু থেকে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর কথা ছিল। তবে করোনার কারণে বেশ কিছুদিন কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। তাই এ ঝাড়খণ্ডের ওই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পিছিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আগামী বছর জুনে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
চুক্তি অনুসারে, আদানির বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিট তথা কিলোওয়াট/ঘণ্টা ক্যাপাসিটি চার্জ তিন দশমিক ৮০ সেন্ট। ফলে ৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) প্রতি মাসে এ বাবদ ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে তিন কোটি ৭৭ লাখ ২৬ হাজার ডলার বা ৩২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৪৫ কোটি ২৭ লাখ ১৭ হাজার ডলার বা প্রায় তিন হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। আর ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৯৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন শেয়ার বিজকে বলেন, আদানির সঙ্গে এ চুক্তিটা অনেক আগে সই করা হয়েছিল। এ বিদ্যুৎ আমদানিতে দুই ধরনের খরচ দিতে হবে। একটি হলো স্থায়ী ব্যয়। আদানি যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে এটা তার বিনিয়োগ খরচ। তবে বিষয়টিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বলা উচিত নয়। আরেকটি হলো পরিবর্তনশীল (ভেরিয়েবল) ব্যয়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে কয়লা কেনা ও অন্যান্য পরিচালন খরচ। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
যদিও এ ধরনের অযৌক্তিক চুক্তির বিরোধিতা করেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় উদ্বৃত্ত। চাহিদা না থাকায় নিজস্ব বেশকিছু কেন্দ্র বন্ধ রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। তাই বিদ্যুৎ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বিদ্যুৎ বিভাগ কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে বাংলাদেশের আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হবে। অথবা আদানির বিদ্যুৎ না কিনেই বাংলাদেশকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। এটা সরাসরি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। তাই এ প্রক্রিয়া কীভাবে বের হওয়া যায়, তা চেষ্টা করা উচিত।
যদিও আদানির বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি বাতিলের কোনো সুযোগ এই মুহূর্তে নেই বলে মনে করেন মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি করা হয়েছে। তাই এটি চাইলেও আর বাতিল করা বা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে জ্বালানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইফা) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে বাংলাদেশকে অনেক বেশি ব্যয় করতে হবে।
‘আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্লান্ট: টু এক্সপেনসিভ, টু লেট, টু রিস্কি ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, আদানির কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দর পড়বে ৮ টাকা ৭১ পয়সা। অন্যদিকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান এস আলমের কেন্দ্রের বিদ্যুতের দর পড়বে ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৫২ পয়সা। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি ৭ টাকা ৭১ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কেনা হবে। আর ভারতের কর্ণাটকে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪ টাকা ৮০ পয়সা খরচ পড়ছে। অর্থাৎ এস আলমের দর ও আদানির বিদ্যুতের দর তুলনা করলে বাড়তি ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
আইফা বলছে, আদানির বিদ্যুতের বাড়তি দামের কারণেই বাংলাদেশকে বাড়তি ব্যয় করতে হবে। এই দর বেশি পড়ছে দেশি কয়লার বদলে আমদানি করা কয়লার ব্যবহার, বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের খরচ বিদ্যুতের দামের মধ্যে দেখানো, সিস্টেম লসের অংশ বাংলাদেশের দরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে।
যদিও ৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টর তথা আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার ৮৫ শতাংশ ব্যবহার হবেÑএ যুক্তিতে আমদানি ব্যয় ধরা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ কম হলে ইউনিটপ্রতি দাম আরও বেশি পড়বে।
এদিকে পিডিবির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আদানির সঙ্গে চুক্তির দরকষাকষি প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। কারণ বাংলাদেশের হিসাবে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রতি ইউনিটে ক্যাপাসিটি চার্জ হওয়ার কথা তিন দশমিক ৩৩ সেন্ট। আর আদানি দাবি করেছিল তিন দশমিক ৯০ সেন্ট। তবে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের দরকষাকষি না করেই বাংলাদেশ সরাসরি তিন দশমিক ৮০ সেন্ট ক্যাপাসিটি চার্জ প্রস্তাব করে। পরে আদানি তা মেনে নিয়ে চুক্তি করে।
উল্লেখ্য, আদানি গ্রুপ ভারতের গুজরাটভিত্তিক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর পরিচালনা, অর্থনৈতিক অঞ্চল, ভোগ্যপণ্য, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.