ভারতের কৃষক বিদ্রোহের পেছনে কী পাক-চীন?
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ভারত সরকার পার্লামেন্টে আগ্রাসী প্রক্রিয়ায় তিনটি নতুন কৃষি সংস্কার বিল পাস করেছে। এই বিলগুলো নিয়ে সারাদেশে কৃষকদের বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ এখন ক্রমেই তুঙ্গে উঠছে। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ কৃষক রাজধানী দিল্লীতে জড় হয়েছেন। ভারতে এটাই এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় কৃষক বিক্ষোভ।
২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লীতে বিক্ষোভ করছেন কৃষকরা। তারা তিনটি বিতর্কিত বিল বাতিল ও ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ (এমএসপি) ব্যবস্থা বহালের দাবি জানাচ্ছেন।
তারা মনে করেন কৃষি সংস্কার বিলগুলো এমএসপি ধ্বংস করবে। তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা সীমিত হওয়ার আশঙ্কায় তারা উদ্বিগ্ন। এতে ভবিষ্যতে তারা বড় বড় কৃষি কোম্পানিগুলোর সামনে অসহায় হয়ে পড়বেন। সরকার বলছে বিলগুলো দেশের কৃষিপণ্যকে বাজারমুখি করবে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগ কাড়বে ও কৃষির উন্নয়ন হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বার বার আশ্বাস দিয়ে বলছেন যে এসব ‘ঐতিহাসিক বিল’ কৃষকদের উপকার করবে কারণ তখন মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। ফলে কৃষকরা আরো বেশি লাভজনক প্লাটফর্মে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।
কংগ্রেসসহ ভারতের বিরোধী দলগুলো সরকারের প্রতি কৃষকদের দাবি মেনে নিয়ে বিলগুলো বাতিলের দাবি করছে।
এখনো ভারতের কৃষি খাত হলো ক্ষুদ্র চাষীদের কৃষি ব্যবস্থা। ৮০% চাষীর দুই একর জমিও নেই এবং তাদের বাজার প্রতিযোগিতামূলক সামর্থ্য খুবই দুর্বল। তারা এখনো ন্যূনতম মূল্য পেতে সরকারের দ্বারস্থ হয়। খরার মতো চরম পরিস্থিতিতে তারা সরকারের কাছে ন্যূনতম মূল্যে শস্য বিক্রি করতে পারে। নতুন বিলগুলো কৃষকদের সরাসরি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সুপারমার্কেটের কাছে বেঁচতে বাধ্য করবে। এতে তাদের আয় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের অনেক এলাকায় সরকারি পরিবহন, পাইকারি বাজার ও রেলওয়ে ধর্মঘটে যোগ দিয়েছে। প্রায় ২৫ কোটি মানুষ কৃষকদের এই বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন যে তারা দিল্লীগামী সব হাইওয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন।
কৃষক বিক্ষোভের কারণ
প্রথমত, সরকারের পাস করা বিলগুলোর বিরোধিতা করার অনেক কারণ রয়েছে কৃষকদের। এগুলো উত্থাপনের আগে সরকার কৃষক সমিতিগুলোর মতামত নেয়নি। সরকার কৃষকদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে বিলগুলো পার্লামেন্টে অনুমোদনের জন্য পেশ করে।
পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বিলগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য বিশেষ কমিটি গঠনে বিরোধী দলগুলোর প্রস্তাবকে পাত্তাই দেয়নি। কণ্ঠভোটে বিলগুলো পাস হয়।
দ্বিতীয়ত, উত্তর ভারতের প্রধান দুই কৃষিপ্রধান রাজ্য পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সবচেয়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হচ্ছে। এই দুই রাজ্যে ভারতের সবচেয়ে বেশি শস্য উৎপন্ন হয়। ভারতের শস্যগোলা হিসেবে অভিহিত করা হয় পাঞ্জাবকে। এসব রাজ্যে অনুমোদিত দালালরা শস্য কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের আছে শক্তিশালী রাজনৈতিক লবিং গ্রুপ। ফলে বাজারের জন্য ক্ষতিকর কোন সংস্কার সাধন করা খুবই কঠিন।
তাছাড়া পাঞ্জাব শাসন করছে বিরোধী দল কংগ্রেস। আর মোদি সরকার বিক্ষোভ উষ্কে দেয়ার জন্য কংগ্রেসকে দায়ি করছে।
পাকিস্তান ও চীনের ভূমিকা কী?
বিজেপির সদস্য ও ভারতের ভোক্তা বিষয়ক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী রাওসাহেব দানবী দাবি করেছেন যে কৃষক বিক্ষোভের পেছনে পাকিস্তান ও চীনের হাত রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ভারত নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যকে দোষ দেয়। এখন বিক্ষোভের মূল অংশগ্রহণকারী হলো উত্তরাঞ্চলীয় কয়েকটি রাজ্যের লোকজন, হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়। কোন মুসলমান নয়। পাকিস্তানের ব্যাপারে দানবীর অভিযোগ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
ভারতে বর্তমান কৃষক দাঙ্গার মূল কারণ হলো দেশটির সরকার অনেক দিন ধরেই কৃষকদের স্বার্থ উপেক্ষা করে আসছে। বহুদিন ধরে কৃষকরা হতাশ ও অসন্তুষ্ট। সংস্কারের পর তাদের জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। ফলে, তারা সরকারকে ছাড় দিতে নারাজ।
আসলে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর আগ্রহ পাকিস্তান ও চীনের নেই। ভারতের কিছু অদ্ভুত রোগ আছে। তারা বাইরের যেকোন সমালোচনার শক্ত জবাব দিতে মুখিয়ে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দাবিদার দেশটি মনে করে তারা যাই করুক না কেন সব বৈধ।
ভারতীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রকৃতির কারণে বিভিন্ন শ্রেণী ও বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে প্রবেশের সুযোগ পায়। এমনকি মূর্খও এমপি হতে পারে। তীব্র বাকবিতণ্ডার মধ্যে ভারতের কিছু রাজনৈতিক নেতা কথা বলতে গিয়ে যেন খেই হারিয়ে ফেলেন। বছরের পর বছর ধরে ভারতের পক্ষে সংস্কারের পথে এগিয়ে যেতে না পারার অন্যতম কারণ হলো দুষ্ট গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলে সৃষ্ট স্বার্থের সংঘাত।
ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৭০ বছর ধরে আধুনিকায়নের পথ ছিলো অমসৃণ। আর সে কারণেই দেশটি সত্যিকারের কোন উন্নয়নশীল কাজ করতে সমর্থন হয়নি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.