আজারি জাতীয়তাবাদ : নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে ইরান
আজারবাইজান উৎসব করছে। তারা সম্প্রতি আর্মেনিয়া থেকে তাদের হারানো ভূমি উদ্ধার করেছে। সেই সাথে তাদের আজারি জাতীয়বাদকে তারা প্রমোট করছে। এতে নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ইরান
আজারবাইজানের প্রধান জাতিগোষ্ঠী আজারবাইজানি বা আজারিরা দক্ষিণের দেশ ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। ইরানের সবচেয়ে উত্তরের চারটি প্রদেশ- পশ্চিম আজারবাইজান, পূর্ব আজারবাইজান, আর্দাবিল ও জানজান জাতিগতভাবে আজারবাইজানি সংখ্যাগরিষ্ঠ। শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল আসলে আজারিদের মাতৃভূমির অংশবিশেষ। ঐতিহাসিকভাবে আজারবাইজান অঞ্চলটি ইরানীয় সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে ছিল হাজার বছর ধরে। এমনকি বিশেষজ্ঞরা বলেন যে আজারি জাতি মূলত ককেশাসীয় কিছু গোত্র ও ইরানীয় কিছু গোত্রের সংমিশ্রণে তৈরী। তা পরে তুর্কীয় কিছু গোত্রের সাথে মিশ্রিত হয়ে বর্তমান আজারবাইজানি জাতিতে পরিণত হয়। অবশ্য এই তুর্কীয়করণ প্রক্রিয়ার পরও আজারবাইজান প্রধানত পারস্য বা ইরান শাসিত বিভিন্ন সম্রাজ্যের অন্তর্গত রয়ে যায়। অবশ্য এসব সম্রাজ্যের অনেকগুলোরই শাসনকর্তা ছিল বিভিন্ন তুর্কীয় রাজবংশ।
১৫ শতকে কুর্দি বংশোদ্ভূত সাফাভী রাজবংশের ক্ষমতা দখলের পর ইরান ও আজারবাইজানসহ সাফাভী সম্রাজ্যের অধীনে থাকা বেশির ভাগ এলাকা ও বাসিন্দারা প্রধানত শিয়া ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। এ সময় শিয়া সাফাভীদের সাথে তুরস্কের সুন্নি ওসমানীয় রাজবংশের প্রচুর যুদ্ধবিগ্রহ হয়। আঠারো শতকের শুরুতে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে রুশ সম্রাজ্য আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে তুরস্ক ও ইরান দুই দেশের সাথেই তাদের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়, যা দশকের পর দশক ধরে চলেছিল। ১৮২৮ সালে রুশ-পারস্য যুদ্ধের পর তুর্কমেনচায়ের সন্ধির মধ্য দিয়ে আজারবাইজানিদের মাতৃভূমি আজারবাইজান অঞ্চলটি উত্তর আজারবাইজান বা বর্তমান আজারবাইজান রাষ্ট্র ও দক্ষিণ আজারবাইজান বা ইরানীয় আজারবাইজান- এই দুই অংশে বিভক্ত হয়। অন্য দিকে তুর্কীয়করণের পর থেকে আজারিরা বৃহত্তর তুর্কীয় জাতিগোষ্ঠীর একটি অংশে পরিণত হয়, যার মধ্যে রয়েছে কিরঘিজ, তুর্কমেন, কাজাখ, উজবেকসহ আরো অনেক জাতি, সর্বোপরি তুরস্কের তুর্কি জাতিও।
ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে জাতীয়বাদের প্রবল ঢেউ উঠলে মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও তার ব্যপক প্রভাব পড়ে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণুতার মুখে তুরস্কের বুদ্ধিজীবি ও সামরিক সমাজে তীব্র জাতীয় চেতনার অভ্যুদয় ঘটে, যার ফলাফল হয় তরুণ তুর্কি সংগঠনের জন্ম ও তাদের বিপ্লবের মুখে রাজতন্ত্রের পতন। এ সময় তরুণ তুর্কি নেতারা ও অন্য অনেক তুর্কি জাতীয়তাবাদী শুধু তুর্কি জাতির ঐক্যের কথাই বলেননি, তারা সমগ্র তুর্কীয় ভাষাভাষীদের একত্রিত করার কথা ভাবেন। নিকটতম তুর্কীয় জাতি আজারিদের মধ্যেও এই মতবাদের তীব্র আবেগ অনুরণিত হয়। বিশেষত তারা ছিল রুশ ও পারস্য সাম্রাজ্যের হাতে পরাধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি বাহিনী উত্তর আজারবাইজানিদের রাজধানী বাকুতে উপস্থিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলশেভিকরা রুশ সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা করলে আজারিদের স্বাধীনতা ও অন্য তুর্কীয় ভাইদের সাথে ঐক্যের বন্ধন গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থাকে ।
অন্য দিকে রুশ সাম্রাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ে একাধিকবার ইরানীয় আজারবাইজানসহ ইরানের উত্তরভাগ দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েতরা স্বল্প সময়ের জন্য ‘‘আজারবাইজান পিপল্স গভার্নমেন্ট’’ নামের একটি সমাজতন্ত্রী পুতুল সরকারেরও প্রবর্তন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কও দু'বার দক্ষিণ আজারবাইজান দখল করে। তবে আজারীদের দেশ এক করার এই সব প্রচেষ্টার কোনটিই ফলপ্রসু হয়নি।
নতুন করে ‘‘সাউথ আজারবাইজান ন্যাশনাল অ্যাওয়েকেনিং মুভমেন্ট’’ (সানাম)-সহ ইরানীয় আজারবাইজানের একাধিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে এই মুহূর্তে সমর্থন দিয়ে চলেছে তারা। এর পাল্টা জবাব হিসেবে ইরান সমর্থণ দিচ্ছে আরমেনিয়াকে, যার শুরু নব্বই দশকের শুরুতে নাগোর্নো-কারাবাখ সঙ্কটের শুরু থেকেই। এতে দক্ষিণ আজারিদের মধ্যে আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদ ও তুর্কীয় জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটছে এবং তারা আজারবাইজান ও তুরস্কের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে আরো বেশি। সাম্প্রতিক নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের পক্ষে ও আরমেনিয়ার বিপক্ষে ইরানীয় আজারবাইজানিদের ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ এবং তুরস্কপন্থী ও ইরানবিরোধী স্লোগান থেকে এমনটাই প্রমাণ পাওয়া যায়। ইরান বেশ সফলভাবেই সবধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমন করেছিল। কিন্তু তুরস্কের সমর্থনে আজারি বিচ্ছিন্নতাবাদের পুনর্জন্ম হলে তা ইরানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের হর্তাকর্তাদের।
তুরস্ক-ইরানের এই শীতল যুদ্ধের মধ্যে বৈশ্বিক তুর্কীয়বাদ কতখানি সফল হয় এবং ইরানের আজারবাইজানিদের ভাগ্যের কতখানি উন্নতি হয় এখন তাই দেখার বিষয়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.