মালদ্বীপ নিয়ে চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতা
ভারত মহাসাগরে দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে এশিয়ার দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও চীন। ১৯৬৫ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে মালদ্বীপ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ছিল এর প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর একটি। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী হিসেবে ভারত দীর্ঘ সময় মালদ্বীপের সঙ্গে বজায় রেখেছে ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্ব।
এদিকে, ২০১১ সালের আগে মালদ্বীপে কোনো দূতাবাসই ছিল না চীনের। মহাপ্রাচীরের দেশটি যখন আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য বাড়াতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআিই) কর্মসূচি হাতে নেয় তখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এশিয়ার অন্যতম ছোট দেশ মালদ্বীপ।
ভৌগলিক নৈকট্য ও ঐতিহাসিক যোগাযোগের কারণে ভারত কয়েক দশক থেকে মালদ্বীপের সঙ্গে জোরালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-মালদ্বীপ মিত্রদেশ হিসেবে বহুল পরিচিত। ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপের দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক মামুন আব্দুল গাইয়ুমের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হলে ভারত সেখানে সেনা পাঠায় এবং গাইয়ুমকে রক্ষা করে। ২০০৪ সালে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত মালদ্বীপকে সহায়তা করতে নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ ভরে ত্রাণ সামগ্রী পাঠায় ভারত।
কিন্তু, ২০১৩ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে গাইয়ুমের আত্মীয় আব্দুল্লা ইয়ামিন ক্ষমতায় এলে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ইয়ামিন ক্ষমতায় বসেই নতুন দিল্লীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দেন। কাছে ডেকে নেন বেইজিংকে। সে সময় তিনি দ্বীপরাষ্ট্রটি উন্নয়নে চীন থেকে কোটি কোটি ডলার অনুদান ও ঋণ পেতে শুরু করেন। ২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাষ্ট্রীয় সফরে মালদ্বীপ আসেন। তিনিই ছিলেন মালদ্বীপ সফর করা চীনের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।
মালদ্বীপ সফরে এসে শি চীনা বিনিয়োগের পথ সুগম করে দেন। ২০১৬ সালে চীনের দেওয়া ৮০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে দ্বীপরাষ্ট্রটির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করা হয়।
রাজধানী মালের কাছে হুলহুমালে দ্বীপ কৃত্রিমভাবে সম্প্রসারিত করে সরকারি আবাসন প্রকল্পের অধীনে সাত হাজার অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করা হয়। আর সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠে ‘চীন-মালদ্বীপ মৈত্রী সেতু’। চীনের দেওয়া প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় এই সেতু তৈরিতে। রাজধানী মালের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সংযোগ সৃষ্টিকারী ২ দশমিক ১ কিলোমিটারের এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি হয়ে উঠে আলোচনার মূল বিষয়।
সেতুটির কারণে খুব স্বল্প সময়েই রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি হওয়ায় জনগণের সুবিধা বেড়েছে। তবে এটি নির্মাণে স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগের কারণে জনমনে অসন্তোষও রয়েছে।
এই মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে মালদ্বীপে চীনের ক্রমাগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে ভারত। দ্বীপরাষ্ট্রটির সঙ্গে তার ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক পড়ে যায় হুমকির মুখে। নিজের প্রভাব বজায় রাখতে গত আগস্টে মালদ্বীপের উন্নয়নে ভারত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর মধ্যে রয়েছে ৬ দশমিক ৭ কিলোমিটারের সেতু ও কজওয়ে। এর মাধ্যমে মালের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলোর সংযোগ সৃষ্টি করা হবে।
এই সেতুর দৈর্ঘ ও নির্মাণ ব্যয় চীনের মৈত্রী সেতুর চেয়ে বেশি হওয়ায় ভারতের এই প্রকল্প নতুন জল্পনার জন্ম দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে। নতুন দিল্লী-ভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিস্টিংগুইশড ফেলো মনোজ যোশী সিএনএন’কে বলেন, ‘চীনকে নিয়ে ভারতের অনেক উদ্বেগ রয়েছে। মালদ্বীপ আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তার মতে, ‘মালদ্বীপে বসে চীনের জাতীয় নিরাপত্তায় কোনো হুমকি ভারত সৃষ্টি করতে পারবে না। কিন্তু, ভৌগলিক নৈকট্যের কারণে মালদ্বীপ থেকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারবে চীন।’
২০১৮ সালের নভেম্বরে ক্ষমতায় বসার পর থেকে মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ দেশটিতে চীনের ঋণের মোট পরিমাণ হিসাব করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে সিএনএন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালদ্বীপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্বাস সরকার সরাসরি চীনের কাছ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। সরকারের গ্যারান্টি নিয়ে মালদ্বীপের প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের কাছ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। তারা ঋণ পরিষোধে ব্যর্থ হলে মালদ্বীপ সরকারকে তা শোধ করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড ব্রিউস্টার বলেছেন, ‘মালদ্বীপ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। বিশেষ করে, চীন থেকে দেশটি যে ঋণ পরিমাণ নিয়েছে তা শোধ করার ক্ষমতা এর রয়েছে কি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে যে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেগুলো অর্থনৈতিকভাবে কতোটা সম্ভাবনাময় তা নিয়েও যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি প্রশ্ন আছে ঋণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা নিয়ে।’
মালদ্বীপে নতুন সরকার আসার পর তারা ভারতের সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক নতুনভাবে জোরালো করতে উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, সোলিহ ক্ষমতায় আসার পর ভারত দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থনৈতিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে ডেভিড ব্রিউস্টারের মত, ‘এই ঘোষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে ভারত পুরনো বন্ধুরাষ্ট্র মালদ্বীপকে পাশে রাখতে অনেক খরচ করতেও রাজি।’
তবে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিস্টিংগুইশড ফেলো মনোজ যোশী মনে করেন, করোনার কারণে ভারত নিজেই যখন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তখন এমন পরিস্থিতিতে মালদ্বীপকে নতুন দিল্লী ঠিক কতোটা সহযোগিতা করতে পারবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘ভারতের চেয়ে চীনের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী। ভারত সরকার যদি মালদ্বীপে অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করতে যায় তাহলে নিজ দেশেই প্রশ্ন উঠবে। কেননা, ভারতেই অবকাঠামো উন্নয়নের বেশ প্রয়োজন রয়েছে।’
এখন ভারতের দিক ঝুঁকে থাকলেও এখনকার বাস্তবতায় মালদ্বীপ বেইজিংকে এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করতে পারবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। করোনা মহামারিতে মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পে যখন ধস নেমেছে তখন চীনের পর্যটকরা এসে তা আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। গত জুলাইয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট সোলিহ চীনা বার্তা সংস্থা শিনহুয়াকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘চীন আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনি মালদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে থাকবে।’
তবে মালদ্বীপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের আগ্রহ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গত অক্টোবরে এশিয়ায় পাঁচ দেশ সফরে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, আমেরিকা মালদ্বীপে দূতাবাস খুলবে। তার আগের মাসে তথা সেপ্টেম্বরে দেশ দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছিল। করোনায় বিপর্যস্ত মালদ্বীপকে সহায়তা করতে হাত বাড়িয়েছে জাপান। গত সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপকে জাপান ৪৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মালদ্বীপে ভারতের মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সহায়তা করলে তা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে।
তবে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। তবে একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা মনে করি, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই আমরা সবসময়ই বলি, ভারত আগে।’
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.